টেকসই উন্নয়নের জন্য মানসম্মত শিক্ষা প্রয়োজন

হীরেন পণ্ডিত: টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট ৪ হলো সকলের জন্য গুণগত বা মানসম্মত শিক্ষা। এটা আসলে সবার জন্যই প্রয়োজন। শিক্ষা আমাদের মৌলিক অধিকারের একটি অংশ। শিক্ষা মানসম্মত না হলে সে শিক্ষা গ্রহণ করেও কোন লাভ হচ্ছেনা। শিক্ষা নিয়ে আর হেলাফেলা করার দিন নেই। আমাদেরকে এগিয়ে যেতে হবে সামনের দিকে। আমাদেরকে জোর দিতে হবে মানসম্মত শিক্ষার ওপর। দেশের ভবিষ্যত প্রজন্মকে ধ্বংস না করে, তাদেরকে সঠিকভাবে শিক্ষিত করে তোলার দায়িত্ব আমাদের সকলের, আমাদের মানসম্মত শিক্ষার জন্য শিক্ষকদের যেমন দায়িত্ব রয়েছে, তেমনি পিতামাতার দায়িত্ব রয়েছে, নাগরিক সমাজের ভূমিকা রয়েছে, তেমনি প্রশাসনেরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। সাধারণ অর্থে জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জনই শিক্ষা।
শিক্ষা কোনো ব্যক্তির অন্তর্নিহিত গুণাবলির পূর্ণ বিকাশের জন্য উৎসাহ দেয় এবং সমাজের একজন উৎপাদনশীল সদস্য হিসেবে প্রতিষ্ঠালাভের জন্য যেসব দক্ষতা প্রয়োজন, সেগুলো অর্জনে সহায়তা করে। আর কারিকুলাম হলো শিক্ষার একটি বিশেষ স্তরের শিক্ষণীয় বিষয়ের সমষ্টি বা পূর্ণাঙ্গ রূপরেখা। শিক্ষার লক্ষ্য, উদ্দেশ্য, বিষয়বস্তু, শিক্ষাদানের পদ্ধতি, মূল্যায়নের কৌশল, বিভিন্ন উপকরণ ও শিক্ষাসংক্রান্ত বিদ্যালয়ের অন্যান্য কর্মসূচি এই সবকিছুই কারিকুলামের অন্তর্ভুক্ত। তাই শিক্ষার ক্ষেত্রে কারিকুলাম বা শিক্ষাক্রমের গুরুত্ব অপরিসীম।
প্রায় শতভাগ শিশুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি নিশ্চিতকরণ, ঝরে পড়ার হার কমিয়ে আনা, প্রাথমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত ভর্তির ক্ষেত্রে ছেলেমেয়ের সমতা অর্জন, উপবৃত্তি, বছরের শুরুতেই অদিবাসীসহ সব শিক্ষার্থীর জন্য বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক বিতরণ, বিপুলসংখ্যক প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ, প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পর্যাপ্তসংখ্যক নারী শিক্ষক নিয়োগ এবং শিক্ষা ও সাক্ষরতার হার বৃদ্ধির লক্ষ্যে কাজ চলছে। করোনাকালে বর্তমান সরকারের বহুমুখী প্রয়াসের মাধ্যমে উল্লিখিত অর্জনগুলো ধরে রাখার জন্য তারা প্রশংসার দাবি রাখে।
করোনা মহামারির কারণে শিক্ষার ক্ষতির গভীরতা, ব্যাপকতা, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে এর অভিঘাত নিরসন ও শিক্ষাব্যবস্থাকে কাক্সিক্ষত ধারায় ফেরানোর জন্য সমন্বিত শিক্ষা পুনরুদ্ধার কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে উদ্যোগ নেওয়া জরুরি। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা বৃদ্ধি, ভৌত অবকাঠামোর জরুরি সংস্কার, শিক্ষণ-শিখন সামগ্রীর নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ, বিদ্যালয় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা, নিরাপদ খাবার পানি এবং স্বাস্থ্যসম্মত বিধিব্যবস্থা নিশ্চিত করার জন্য জরুরি ছিলো।
শিক্ষা ব্যবস্থাকে যুগোপযোগী সংস্কার তথা প্রগতিশীল করার উদ্যোগ নেওয়ার লক্ষ্যে শিক্ষাসংশ্লিষ্ট সব অভিভাবক, শিক্ষক প্রতিনিধি ও শিক্ষক সংগঠনগুলোকে যুক্ত করা প্রয়োজন। শিক্ষানীতিতে বলা হয়েছে, শিক্ষা খাতে ক্রমান্বয়ে বৈষম্য দূর করা হবে-শহর ও গ্রামের, সরকারি-বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকদের মধ্যে বৈষম্য, নারী-পরুষ, সাধারণ ও কারিগরি-বৃত্তিমূলক শিক্ষার মধ্যে বৈষম্যের অবসান ঘটানো হবে। স্বাধীনতার পর থেকে শিক্ষাব্যবস্থায় বিভিন্ন সময় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়েছে বারবার। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে ডক্টর কুদরাত-এ-খুদাকে প্রধান করে একটি কমিশন গঠিত হয়। যা কুদরাত-এ-খুদা কমিশন নামে পরিচিতি পায়। সর্বশেষ জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০ এর আগে ৬টি কমিশন কাজ করে। কমিশনের রিপোর্ট অনুযায়ী শিক্ষাব্যবস্থায় সব বিষয় কার্যকর হয়নি বা অনেক কমিশনের রিপোর্ট আলোর মুখ দেখেনি। বারবার শিক্ষাপদ্ধতিতে রদ-বদল করেও সঠিক মান অর্জন করা সম্ভব হচ্ছে না বলেই মনে হয়। এতে শিক্ষাব্যবস্থার অগোছালো ভাবই প্রকাশ পেয়েছে। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে শিক্ষা কারিকুলামেও পরিবর্তন আসবে এটাই স্বাভাবিক।
সম্প্রতি অনুমোদন পাওয়া বিষয়গুলো আলোচনার আগে জানা দরকার কি কি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন রয়েছে নতুন কারিকুলামে। চ‚ড়ান্ত অনুমোদন দেওয়া ‘জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখা-থেকে জানা যায় এ শিক্ষানীতি কার্যকর হচ্ছে এ বছর থেকে। ২০২৩ সালে প্রাথমিকে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণিতে এবং মাধ্যমিকে ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে এবং ২০২৪ সালে তৃতীয়, চতুর্থ এবং অষ্টম ও নবম শ্রেণিতে এ কারিকুলামে পাঠদান করা হবে। ২০২৫ সালের মধ্যে পুরোপুরি কার্যকর হবে এ কারিকুলাম। কারিকুলামে উঠে আসা মূল আলোচিত বিষয়গুলো হলো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে দুদিন ছুটি, তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পরীক্ষা না রাখা, সব শ্রেণিতেই শিক্ষকদের হাতে নম্বর, পিএসসি, জেএসসি ও জেডিসি পরীক্ষা বাতিল, স্কুলপর্যায়ে বিভাগ বিভাজন না থাকা, পাবলিক পরীক্ষায় যোগ হবে শিখনকালীন মূল্যায়ন, এসএসসি পরীক্ষা এসব কাজে শিক্ষককে অবশ্যই কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করতে হয়, কারণ তিনিই সবচেয়ে উপযুক্ত ব্যক্তি, যিনি নিশ্চিত করতে পারেন যে তাঁর শিক্ষার্থী যা বারবার শুনছে, বলছে, পড়ছে, করছে, দেখছে, তা নির্ভুল। এখানে শোনা, বলা, পড়া, করা ও দেখার বিষয়টা নির্ভুল হওয়াটা জরুরি, কারণ বিষয়গুলো ভুল হলে শিক্ষার্থী ভুলই শিখবে। এই তত্ত¡ অনুযায়ী শিক্ষার্থী তার মস্তিষ্কে বা মনে এমন কোনো ক্ষমতা নিয়ে জন্মায় না যা দিয়ে সে ভুল ও শুদ্ধ নির্ণয় করতে পারে। অর্থাৎ আচরণবাদ অনুযায়ী যেহেতু কেবল অভিজ্ঞতার মাধ্যমেই মানুষ শেখে, শিক্ষক যেভাবে যে অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীকে নিয়ে যাবেন, শিক্ষার্থী ঠিক সেভাবে এবং ঠিক তাই শিখবে।
গুণগত শিক্ষা অর্জনের জন্য শিক্ষার্থীদের বুদ্ধিমান হতে হবে। কিন্তু প্রথাগত অঙ্ক, বিজ্ঞান বা অন্যান্য বিষয় পড়িয়ে ওদের কেবল এক ধরনের বুদ্ধিমত্তায় পরিবর্তন আনা সম্ভব, অন্যগুলো নয়। মানুষের বুদ্ধির আরও অনেক মাত্রা আছে। শিক্ষার্থীদের একেক জনের বুদ্ধি একেক ক্ষেত্রে বেশি থাকে। সেটি বুঝে ব্যবস্থা নিতে পারলেই তাদের বুদ্ধি দ্রæত বিকশিত হয়। এখনকার মতো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যদি কেবল এক ধরনের বুদ্ধিচর্চা অব্যাহত থাকে, তাহলে শুধু অল্প কিছু শিক্ষার্থীর বুদ্ধিমত্তায় পরিবর্তন আসবে, অন্যরা পিছিয়ে পড়বে।
নতুন শিক্ষাক্রমে উল্লিখিত সাত রকমের বুদ্ধির প্রতিটিকে বিকশিত ও শাণিত করার বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে যেসব স্কুলে পাইলটিং চলছে, সেখানকার শিক্ষার্থীরা এখন খুব আনন্দ ও আগ্রহের সঙ্গে এসব বুদ্ধি চর্চায় নিমগ্ন। আগে মূলত ভাষিক ও গাণিতিক বুদ্ধিচর্চার সুযোগ ছিল। ফলে যেসব শিক্ষার্থীর এসব ক্ষেত্রে আগ্রহ ছিল, তারাই আনন্দ পেত বা ভালো করত, অন্যরা মনমরা হয়ে কষ্টে-সৃষ্টে পরীক্ষার বৈতরণী পার হতো। নতুন শিক্ষাক্রমে সবাই যেহেতু নিজের পছন্দমতো বুদ্ধিচর্চার সুযোগ পাবে, এখন ওইসব ক্লাসে এমন কাউকে পাওয়া দুষ্কর যে, স্কুলে যেতে কিংবা স্কুলে আরও বেশি সময় থাকতে চাইবে না। আশা করা যাচ্ছে, শিক্ষার্থীদের দিক থেকে নতুন শিক্ষাক্রমের কোনো সমস্যা থাকবে না। সমস্যা হবে শিক্ষক প্রশিক্ষণে।
পুস্তকসহ সব শিক্ষা উপকরণের দাম বেড়েছে। বৈশি^ক কারণে মানুষের আয় কমেছে, করোনা মহামারীতে দেশের সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় শিক্ষার্থী কমেছে। সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে কীভাবে ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের ক্লাসে ফিরিয়ে আনা যায়। করোনার কারণে পড়াশোনায় আগ্রহ কমে গিয়েছিলো, মানসিক ও সামাজিক নানা সমস্যা, সহিংসতার ঝুঁকি বৃদ্ধি, প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার আগেই কর্মক্ষেত্রে প্রবেশÑএমন বিভিন্ন পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে কিশোর-কিশোরীকে। শিক্ষার ব্যাপারে অভিভাবক ও কিশোর-কিশোরীর নেওয়া সিদ্ধান্ত আমাদের নতুন প্রজন্মকে প্রভাবিত করবে। তাই শিক্ষায় যে ক্ষতি হয়েছে, এ বিষয়ে যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে কর্তৃপক্ষেরÑ যাতে তা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়।
বইয়ের দাম শিক্ষার্থীর অভিভাবকদের সহনীয় পর্যায়ে রাখা যায় সে ব্যাপারে ভাবতে হবে। কিছুদিন আগে ডিজিটাল বাংলাদেশ এখন আমরা ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ দেখার অপেক্ষায়; কিন্তু এ স্মার্ট বাংলাদেশ আমরা কীভাবে গড়তে পারব, বর্তমান বিশ্বে টিকে থাকতে হলে কিংবা স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে হলে প্রথমেই মানসম্মত শিক্ষাব্যবস্থার দিকে নজর দিতে হবে। শিক্ষার্থীদের জন্য শিক্ষাব্যবস্থায় পরিবর্তন আনার যে প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে তার গতিকে আরো ত্বরান্বিত করতে হবে।

চীনের দিকে যদি একটু তাকানো যায় তাহলে দেখা যায় যে, বিজ্ঞান শিক্ষা ও সক্ষমতায় সেখানে নাটকীয় পরিবর্তন ঘটেছে। বিজ্ঞানে চীনের এই আধিপত্য বিশ্বে ক্ষমতার ভারসাম্য পরিবর্তন করে ফেলে কিনা, তা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের মধ্যে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে চীন সরকার বিগত বছরগুলোতে যেসব নীতি নিয়েছে, তারই ফল দেশটির আজকের এই সাফল্য। গত তিন দশক চীন সরকার দেশটির গবেষণা সক্ষমতা বাড়াতে অনেক গুণ বিনিয়োগ বাড়ায়।
২০১৫ সালের এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, দেশে স্নাতক পাস করেছে ৫ লাখ ১৬ হাজার ৬৬৬ জন শিক্ষার্থী। এর মধ্যে ৩৫টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রি নিয়েছে ৪০ হাজার শিক্ষার্থী। আর ৮৫ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক পাস করেছে ৬১ হাজার ৪৮২ জন। বাকি প্রায় চার লাখ ১৬ হাজার পাস করেছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ও উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। দেশে অনেক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান নিয়েও নানা প্রশ্ন রয়েছে। তার চেয়েও নাজুক অবস্থা জাতীয় ও উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখান থেকে পাস করা শিক্ষার্থীই সবচেয়ে বেশি, যারা উচ্চ শিক্ষা শেষ করছে মুখস্থবিদ্যার ওপর ভর করে, গতানুগতিক পদ্ধতিতে এমনটি শোনা যায়।

আগের দুই-তিন বছর মিলিয়ে ১৫-২০টি প্রশ্নের উত্তর নির্বাচন করে মুখস্থ করলেই পরীক্ষায় ভালো নম্বর তোলা যায় বলে শোনা যায়। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ালেখাও হয়ে গেছে শিটনির্ভর। শিট কয়েকটি পেলেই হলো। শিক্ষকরা ক্লাসে যে দুই-চারটি শিট ধরিয়ে দেন তা পড়লেই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া যায়। এখানে শুধু ফটোকপির ওপর ভরসা করতে হয়। আর মেধাবী শিক্ষকের অপ্রতুলতা মানসম্মত শিক্ষার জন্য একটা বড় চ্যালেঞ্জ। এখন মেধাবী শিক্ষার্থীরা পড়ালেখা শেষ করে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, ব্যাংকার, মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে চাকুরি করেন; কিন্তু যারা এই মেধাবী জনসম্পদ তৈরি করেন অর্থাৎ শিক্ষক, তাদের অর্থনৈতিক, সামাজিক উন্নয়নে রাষ্ট্রের ভূমিকা নগণ্য। ফলাফল, মেধাবীরা শিক্ষকতায় কম আসছেন, যা মানসম্মত শিক্ষা উন্নয়নে একটি অন্যতম প্রধান বাধা।

আমাদের দেশে কর্মসংস্থানের সুযোগ খুবই কম। এরপর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন কলেজগুলো থেকে পাস করা শিক্ষার্থীদের মানও ভালো না বলে অভিযোগ রয়েছে। শহরকেন্দ্রিক কলেজগুলো মোটামুটিভাবে চললেও মফস্বলের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর অবস্থা খুবই খারাপ। যত্রতত্র অনার্স খোলা হয়েছে। প্রয়োজনীয় মানসম্মত শিক্ষক নেই। শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা নিয়মিত ক্লাসে উপস্থিত থাকে না। প্রথাগতভাবে এই শিক্ষার্থীদের দেখে মনে হচ্ছে পড়ছে, সার্টিফিকেট নিচ্ছে। কিন্তু চাকরির বাজারে তারা টিকতে পারছে না। এ জন্য প্রাথমিক শিক্ষা থেকে উচ্চশিক্ষা সব শিক্ষাই মানসম্মতভাবে প্রদান করা জরুরি।
প্রতিবছর পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আসনসংখ্যা সামান্য হলেও বাড়ছে। তবে বাজারে কর্মীর চাহিদা রয়েছে যেসব খাতে, সে সব খাত-সংক্রান্ত বিষয় খোলার হার তেমনভাবে বাড়ছে না। ভালো কোনো বিষয়ে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ না পেয়ে চাকরির বাজারে চাহিদা না থাকা বিষয়েই ভর্তি হচ্ছে অনেক শিক্ষার্থী। বর্তমান যুগ তথ্য-প্রযুক্তির। অথচ এ বিষয়ে পড়ার জন্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে আসন সংখ্যা খুবই কম। এ ছাড়াও যেসব বিষয়ে শিক্ষার্থীদের আগ্রহ রয়েছে সেখানেও আসন কম। এক দুই দশক আগেও একজন শিক্ষার্থী মাধ্যমিক শিক্ষা সম্পন্ন করত তখন তার বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান সব বিষয়েই ভালো ধারণা থাকত। কিন্তু এখন সেটা হচ্ছে না। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে আসন খুব সীমিত। বেশির ভাগ শিক্ষার্থীই পড়ে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন কলেজগুলোতে। যাদের পড়ালেখায় বিরতি আছে তারা পড়ে উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে। এতে ছাত্রসংখ্যা বাড়লেও উচ্চশিক্ষার উৎকর্ষ সাধন হচ্ছে কিনা তা প্রশ্নের সম্মুখিন এবং কেউ মানসম্মত শিক্ষা অর্জন করতে পারছেনা।

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো এত বড় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গুণসম্পন্ন পড়ালেখা করানোটা অসম্ভব হয়ে পড়ছে। এগুলো কি এখন বেকার তৈরির মিছিলকে সমৃদ্ধ করছে কিনা সময় বলবে! তবে সরকারি কলেজগুলোকে বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন নেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে। এতে উচ্চশিক্ষার মান কিছুটা হলেও বাড়বে। আর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন যেসব কলেজ থাকবে সেখানে সিলেবাস, কোর্স পদ্ধতি ও পরীক্ষায় বড় পরিবর্তন আনতে হবে। তাদের পড়ালেখায় স্বকীয়তা ও সৃজনশীলতার সমন্বয় ঘটাতে হবে। আর যেসব কলেজে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নেই সেখান থেকে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ বন্ধ করতে হবে। যে কোনো দেশের উন্নয়নের মূল ভিত্তি হলো শিক্ষিত ও দক্ষ মানবসম্পদ। আর শিক্ষিত মানব সম্পদের জন্য প্রয়োজন মানসম্মত শিক্ষা। এই মানসম্মত শিক্ষা দেশের অগ্রগতির জন্য খুব প্রয়োজন। মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করার মাধ্যমে টেকসই উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করা সম্ভব।

হীরেন পণ্ডিত, প্রাবন্ধিক ও গবেষক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *