হীরেন পণ্ডিত: হাওর এখন বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ এবং বৈচিত্র্যের এক অপার লীলাভূমি। হাওরের আনাচেকানাচে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে অমূল্য সম্পদ। একদিন পর্যটনের অপার সম্ভাবনার হাতছানি দিয়ে দেশ-বিদেশের পর্যটকদের আকৃষ্ট করবে নিশ্চিতভাবে। শুধু প্রয়োজন সঠিক উদ্যোগ। এখানে পর্যটনশিল্পের বিকাশে বিভিন্ন মনোরম হোটেল, গেস্ট হাউস ইত্যাদি গড়ে তোলা প্রয়োজন। পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে হাওরের চেহারা আমূল পাল্টে যাবে, বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটবে, জীবন যাত্রার মানোন্নয়ন হবে।
হাওর বললেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে বিশাল জলরাশি। বর্ষায় দু’চোখ যেদিকে যায় শুধু পানি আর পানি। শুকনো মৌসুমে পানির পরিবর্তে মাঠজুড়ে ফসলের সমারোহ দু’চোখ ভরিয়ে দেয়। হাওর অঞ্চলে ছয় মাস শস্যক্ষেত্র থাকে পানির নিচে আর গ্রামগুলো পানিতে ভেসে থাকে দ্বীপের মতো। এটা বর্ষাকালের চিত্র। ছয় মাস থাকে শুকনো গ্রীষ্ম মৌসুমে। এ সময় যতদূর চোখ যায় মাঠের পর মাঠ, সবুজের সমারোহ ঢেউ খেলে যায়। হাওরের শিল্প-সংস্কৃতি আজ অনেককেই বিমুগ্ধ করছে। দিন যতই যাচ্ছে, হাওরের প্রতি মানুষের গভীর টান লক্ষ্য করা যাচ্ছে। পর্যটকদের আনাগোনা বাড়ছে। দেশি-বিদেশি পর্যটকরা এখন ভ্রমণের জন্য হাওর অঞ্চলকে বেছে নিচ্ছেন। এখানে তাই পর্যটনশিল্পের সম্ভাবনা বেড়েই চলেছে। কিন্তু আমরা তা কতটা কাজে লাগাতে পারছি সেটাই এক বিরাট প্রশ্ন?
হাওর অঞ্চল বলতে সিলেট, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, নেত্রকোণা, কিশোরগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়াÑ এই ৭টি জেলার হাওর অঞ্চলকে বুঝায়। ইতিহাস থেকে জানা যায়, সমুদ্রবক্ষ থেকে জেগে উঠেছে হাওর। হাওর অঞ্চল মোট ৩৭৩টা। এসব হাওরের মধ্যে কিশোরগঞ্জে ৯৭টি, সিলেটে ১০৫টি, সুনামগঞ্জে ৯৫টি, মৌলভীবাজারে ৩টি, হবিগঞ্জে ১৪টি, নেত্রকোণায় ৫২টি ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ৭টি হাওর রয়েছে। হাওরবেষ্টিত অঞ্চলে রয়েছে ৩ হাজারের অধিক জলমহাল, যেখান থেকে বছরে আহরিত হয় প্রায় ৪ লাখ টন মাছ। বর্ষাকালে হাওর অঞ্চল ১০-৩০ ফুট পানিতে নিমজ্জিত থাকে। আবার বর্ষা শেষে হাওর অঞ্চলে শুকনা মৌসুমে বিভিন্ন ফসলের সমারোহ দেখা যায়। মানুষের মন খুশিতে নেচে ওঠে এ সময়।
হাওর চ্যাপ্টা বেসিন, দূরচিত্রে যাকে দেখতে বাটির মতো মনে হয়। প্রায় ৮ হাজার বর্গ কিলোমিটার আয়তনের হাওর এলাকায় প্রায় ১৯.৩৭ মিলিয়ন মানুষের বাস। মোট চাষযোগ্য জমির পরিমাণ ০.৭৩ মিলিয়ন হেক্টর, যাতে বছরে ধান উৎপাদন হয় ৫.২৩ মিলিয়ন টন। এর আওতাভুক্ত এলাকার মানুষের জীবন যাত্রা ও আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়নে বিশ বছর মেয়াদী ১৭টি এরিয়ায় ১৫৩ টি প্রকল্পে বাজেট বরাদ্দ দেয়া হয় মোট ২৭ হাজার ৯৬৩ কোটি ৫ লাখ টাকা। যা পাঁচ, দশ ও বিশ বছর ২০১২-২০৩২ মেয়াদী এসব প্রকল্প তিনধাপে বাস্তবায়িত হচ্ছে।
ভূপ্রাকৃতিক সৌন্দর্যের পাশাপাশি ইতিহাস-ঐতিহ্যের দিকেও রয়েছে এ হাওর অঞ্চলের যথেষ্ট খ্যাতি। নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ ও বৃহত্তর সিলেটের একদিকে পাহাড় আর অন্যদিকে হাওর। বর্ষায় পাহাড়ি ঢল ওপর থেকে নেমে নিম্নাঞ্চলের দিকে আসবে, ওই পানি হাওরকে বছরের নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত জলমগ্ন রাখবে আবার চলে যাবে- এটিই প্রকৃতির স্বাভাবিক আচরণ। কিন্তু হাওরে বসবাসকারী মানুষের জীবন যেন পানিবন্দি সময়ের মতোই আটকে আছে অসহায়ত্বের এক চক্রের ভেতর। অপরিকল্পিত বাঁধ নির্মাণ, ব্যক্তিপর্যায়ে মাছ চাষের জন্য পুকুর খনন, ফল-ফসল আবাদের জন্য ছোট-বড় বাঁধ নির্মাণ- এই বিষয়গুলো যে পাঁচ দশক ধরে হাওরের স্বাভাবিক প্রক্রিয়া বিপর্যস্ত করেছে, এতে সন্দেহ নেই। এক কথায় এটিকে আমরা বলতে পারি মানবসৃষ্ট বিপর্যয়। অন্যদিকে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবও রয়েছে। কয়েক বছর ধরেই হাওরে চলছে অসময়ের বৃষ্টি ও বন্যার ঢল। হাওরে সাধারণত একটা ফসল। সাত-আট মাস পানিবন্দি থাকার পর অক্টোবর-নভেম্বরে পানি নেমে গেলে শুরু হয় কৃষিকাজ। এ অঞ্চলে কৃষি মানেই ধান চাষ। এই একটি ফসলে এ অঞ্চলের কৃষকের সারা বছরের রোজগার। ওই ফসলও যদি আগাম বন্যার পানিতে তলিয়ে যায়, তা হলে তাদের আর কিছুই থাকে না। অথচ সামনে থেকে যায় দীর্ঘ একটি বছর অর্থহীন, খাদ্যহীন। প্রতিবছরই এপ্রিল-মে মাসে গণমাধ্যমের খবর হয়ে আসে হাওর অঞ্চল। কৃষকরা অভিযোগ করেন, বাঁধ নির্মাণে অনিয়মের কারণে পানিতে তলিয়ে যাচ্ছে তার প্রাণের ফসল।
২০১৭ সালে অকাল বন্যায় বাঁধ ভেঙে তলিয়ে যায় সুনামগঞ্জের হাওরের বিস্তীর্ণ বোরো ফসল। সরকারি হিসাবে বাঁধ ভেঙে ১৫৪ হাওরের ২ লাখ ২৩ হাজার ৮২ হেক্টর জমির বোরো ফসল তলিয়ে যায়। ক্ষতিগ্রস্ত হয় ১ লাখ ৬১ হাজার হেক্টর জমির ফসল। তবে কৃষকদের হিসাবে এ ক্ষতির পরিমাণ ছিল প্রায় দ্বিগুণ। ওই বছর ফসলহানির পর পর বাঁধ নির্মাণে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। এর পর বাঁধ নির্মাণে ঠিকাদারি প্রথা বাতিল করে প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির (পিআইসি) মাধ্যমে বাঁধের কাজ করানো হয়। কিন্তু এতেও কৃষকের দিন ফেরে না। অনিয়মের বাঁধ এত শক্ত যে, তা ভেঙে বরাদ্দ কৃষকের মাঠে পৌঁছায় না। জমির বাঁধ আর শক্ত হয় না, বছর বছর বন্যায় ভেঙে পড়ে।
হাওরের মানুষ এখন দুষ্টুচক্রে আটকে আছে। তাদের অবস্থা হয়েছে ডাঙায় বাঘ জলে কুমিরের মতো। একে তো ঠিকমতো বাঁধ না দেওয়ায় জমির ফসল তলিয়ে যাচ্ছে, অন্যদিকে জলাভূমিগুলোও দখলে আছে ক্ষমতাবানদের। ফলে জমির ফসল ও জলের মাছ- কোনোটিই জুটছে না কৃষকের কপালে। আবার একদিকে ক্ষুদ্রঋণের নাম করে এনজিওগুলো বিছিয়েছে ঋণের জাল। ওই ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে নিতে হচ্ছে মহাজনী ঋণ। ঋণের এ জাল ছিঁড়ে কৃষকদেও বের করে আনতে উদ্যোগ নিতে হবে। শুধু বাঁধ নির্মাণ করে এ অঞ্চলের মানুষের জীবনমানের উন্নয়ন সম্ভব নয়। সারাবছর কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। ধান-মাছের বাইরেও বিকল্প অর্থনীতি দাঁড় করাতে হবে। সম্প্রতি পর্যটনের জন্য এই অঞ্চল বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। এ ক্ষেত্রে পর্যটনশিল্পে এই অঞ্চলের মানুষকে সম্পৃক্ত করতে হবে।
একটি সমন্বিত পরিকল্পনা-হাওর উন্নয়নের রোডম্যাপ হিসেবে এতে সম্ভাব্য সকল মূল বিষয়কে চিহ্নিত করা হয়েছে। পরিকল্পনায় কৃষি ক্ষেত্রে বলা হয়েছে, প্রকল্প বাস্তবায়ন করবে কৃষি সংশ্লিষ্ট সরকারি প্রতিষ্ঠান ও এনজিও। মনিটরিং করবে বোর্ড, কিন্তু তাঁদের রয়েছে সীমিতসংখ্যক লোকবল। হাওরের এ মহাযজ্ঞ বাস্তবায়নে বোর্ডকে শক্তিশালী করা একান্ত জরুরি। আধুনিক প্রযুক্তি জিআইএস ব্যবহার করে তথ্য সংগ্রহ, মূল্যায়ন এবং ছয় ধাপে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে প্রকল্প প্রণয়ন করা হয়।
প্রযুক্তি নির্ভর কৃষি ছাড়া বর্তমানে আমাদের টিকে থাকা কঠিন। কৃষি প্রযুক্তি আমাদের শ্রমের লাঘব, কম উৎপাদন খরচ, অধিক ফলন, কম অপচয়, বেশি লাভ ও পুষ্ট শস্য দানা উপহার দেয়। কৃষির যান্ত্রিকীকরণ ছাড়া অন্য কোন বিকল্প নেই। হাওর এলাকার ১৬টি উপজেলায় গভীর পানিতে বোনা আমন ধান চাষ হয়। এ সব জলাধান মাছের খাবার ও আশ্রয় যোগায়। ধান চাষের পর এ জমি পতিত থাকে। কিছু কৃষক এ সব জমিতে শুষ্ক মৌসুমে উচ্চ মূল্যের স্বল্পজীবী, অধিক ফলনশীল ধানের জাত উদ্ভাবনের উপর গুরুত্ব দিয়েছে। ধানের চেয়ে ফল, সবজি, মশলা, তৈল ও ডাল জাতীয় শস্য চাষ অধিক লাভজনক। তবে এ পরিকল্পনায় ধানের বীজ উৎপাদনের স্বতন্ত্র প্রকল্প থাকা অপরিহার্য।
আর্থ-সামাজিক ও ভৌগলিক অবস্থা বিবেচনা করে কৃষকদের চাষের পরামর্শ দেয়া হয়। জলবায়ু, ভূমির গঠন, শ্রেণী বিন্যাস করে ভূমির সকল প্রকার ব্যবহরের সম্ভাবতা যাচাই, জমির উর্বরতা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, সম্পদ, আপদ, বাজার, যোগাযোগ সব কিছু বিবেচনায় নিয়ে ডাটা বেইস করা ও শস্য বিন্যাস করা হচ্ছে। কীটনাশক ব্যবহার কমিয়ে সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে পরিবেশ রক্ষা করে ফসল উৎপাদনের উপায় উদ্ভাবনে প্রতি উপজেলা হতে কৃষক নিয়ে কৃষককে প্রশিক্ষিত করা হচ্ছে।
সমন্বিত শস্য ব্যবস্থাপনায় অনবায়নযোগ্য সামগ্রীর ব্যবহার সীমিত করে, কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি, অপচয় ও দূষণ কমিয়ে অধিক ফসল উৎপাদনই মূল লক্ষ্য। শস্য আবর্তন, সঠিক জাত প্রযুক্তি, অকৃত্রিম বৃহত্তর ব্যবহার হ্রাস, ভূমির ঢালু ও বন্য প্রাণীর আচার অক্ষুণœ রাখা হবে। হাওর এলাকার ১৬টি উপজেলার পাহাড়ি ঢালু ভূমিতে সুগন্ধি ও ওষধি গাছ-আগরের চাষ ও উৎপাদনের পরিকল্পনা করা হয়েছে।
সারা বছরব্যাপি বসতবাড়িতে সবজি, মাশরুম, ডাল, মশলা, ফলফলাদি চাষ বৃদ্ধির করে পুষ্টির যোগান এবং আয় বাড়ানোর একটি পরিকল্পনা। হাওর পরিকল্পনার সমন্বিত উদ্যোগ হিসাবে রয়েছে নদী খনন। খননকৃত মাটি দিয়ে উঁচু ভিটা তৈরি করাসহ মোট দুই হাজার গ্রামের ভিটায় তা বাস্তবায়ন করা হবে। দশ হাজার কৃষক বাছাই করে প্রশিক্ষণ, বিনামূল্যে সার, বীজ, কীটনাশক দিয়ে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনা হবে। পুকুর খনন করে আরো বেশী পরিকল্পিত গ্রাম সৃজন করে আধুনিক সুবিধা সম্বলিত বহুতল বিল্ডিং, সবজি, মাছ, ফল গাছ, গবাদি, হাঁস-মুরগীর পালনের মাধ্যমে অনেক গুণ আয় বৃদ্ধি সম্ভব।
বর্ষায় হাওরে শুকনো জমি দুষ্কর, সবজিও দুর্লভ বটে কিন্তু দ্রæত বর্ধনশীল জলজ উদ্ভিদ প্রচুর। হাওরে গ্রামের পাশে কিছু জায়গায় পানির প্রবাহ বা ঢেউ থাকে না। সেখানে এগুলো ব্যবহার করে ভাসমন সবজিতে লাল শাক, পুই শাক, করলা, লাউ, মিষ্টি কুমড়া, শসাসহ বিভিন্ন মশলা জাতীয় ফসলের আবাদে উদ্বুদ্ধকরণ।
উন্নত, অধিক ফলনশীল বোরো, আমন ধানের, সবজি, ডাল, তৈল, মশলার বীজ, সার, কীটনাশক, সেচ সুবিধা ও প্রশিক্ষণ প্রদান করা হবে। কৃষক সংগঠন, উৎপাদক ও ব্যবসায়ী, পানি ব্যবস্থাপনা সংগঠন গড়ে তোলা হবে। এ সংগঠনের মাধ্যমে পাওয়ার টিলার, ধান কাটা, মাড়াই, ঝাড়াই কৃষি যন্ত্রপাতি, সেচ পাম্প প্রদান করার পরিকল্পনা। ন্যায্যমূল্যে কৃষি উপকরণ প্রাপ্তি ও অকৃষিজীবী ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের জন্য বাজার ঘর তৈরি; নিয়মিত মূল্য ঘোষণা, মাননিয়ন্ত্রণ ও ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তি নিশ্চিতকরণ, সংরক্ষণ।
বাংলাদেশের জলাভূমির মারাত্মক সমস্যা এখন দাঁড়িয়েছে সেডিমেন্ট। এটা প্রতিহত করার সক্ষমতা আমাদের নাই তবে ম্যানেজ করার সুযোগ আছে। উজান থেকে ও পাহাড় থেকে পানি নেমে আসে, সাথে নিয়ে আসে সেডিমেন্ট, বছরে এক বিলিয়ন টন সেডিমেন্ট আসায় হাওর, জলাভূমি ও নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে যাচ্ছে। এই জলাধারগুলির প্রধান কাজ হলো এলাকার মরুকরণ প্রক্রিয়াকে প্রতিহত করা। একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ মাটি কেটে হাওরের নাব্যতা সারা বছরের জন্য বাড়ানো যায়। মাটি উত্তোলন করে উন্নয়নমূলক কাজে ব্যবহার করা যায় আবার বিদেশে রপ্তানিও করা যেতে পারে। জলাভূমির নাব্যতা বাড়াতে পারলে সারা বছর মাছ চাষ করে ৬-৭ গুণ বেশী আয় করা সম্ভব হবে ফলে জিডিপির আকার বড় হবে, একইসাথে সমাজে মানি ফ্লো তৈরী হবে।
হাওরে যে পরিমাণ মাছ চাষ করা সম্ভব তাতে আমাদের মাছের উৎপাদন অনেকগুণ বেশী হবে। পুষ্টি চাহিদা মিটবে এবং মিঠা পানির মাছ রপ্তানীও করা যাবে। হাওর ও জলাশয়ে ১০০ কোটি করচ গাছ লাগনো যেতে পারে। প্রাকৃতিকভাবে রাতারগুল পর্যটন এলাকার ন্যায় সকল হাওর রাতারগুল হতে পারে। গাছের গোড়ায় মাছ আশ্রয় নিবে এবং গাছের উপরে পাখী আশ্রয় নিতে পারবে। গাছগুলোর শিকড় বাধ কিংবা মাটি ক্ষয় হতে রক্ষা করে। কার্বন এমিশন ব্যাপকহারে কমে আসবে।
হাওর ও জলাভূমিতে পর্যটনের ব্যবস্থা করা যায়। মানুষ যেখানে দুই ঘন্টার বেশী থাকে সেখানে বাথরুম থাকতে হবে। যেখানে তিনঘন্টার বেশী থাকার প্রয়োজন হবে সেখানে খাবার হোটেল থাকতে হবে। কমিউনিটি বেইজড পর্যটন পরিচালনা করা যেতে পারে। স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ অথবা উপজেলা পরিষদ দেখভাল করতে পারে এবং তাদের আয়ও হতে পারে। বাড়িতে ভাড়া সিস্টেমে পর্যটক রাখা যেতে পারে একই সাথে পর্যটকদের খাবার সরবরাহও করা যায়। ফলে স্থানীয় লোকজন অর্থ উপার্জন করতে পারে আবার পর্যটনে তাদের আগ্রহ ও অংশগ্রহণ দু’টোই বাড়বে।
হাওরের মানুষের জীবন মান বাড়ানোর জন্য হাওরের গ্রামগুলিতে প্রটেকশন ওয়াল দিতে হবে সুইডেন মডেলে। গাছ লাগনো থাকবে বাগানের মতো, সোলার সিস্টেম থাকবে পুরো এলাকায়- লোকজন যেন আইটি সাপোর্ট পায়, ওয়াই ফাই ব্যবহার করতে পারে। স্যানিটেশন থাকবে পুরো পরিবারের মতো। খাবার পানি সবার জন্য সহজ লভ্য করতে হবে। বর্ষার দিনে চলাচলে ওয়াক ওয়ে তৈরী করা প্রয়োজন। সাইলো গোডাউন তৈরী করা অতিব জরুরি। মাছ রিজার্ভ করার জন্য স্টোরেজ নির্মাণ করা যেতে পারে।
হাওরের ৩৭টি উপজেলাকে সংযোগ করে ১০০ কিলোমিটার ফ্লাইওভার নির্মাণ করা হলে মানুষজনের মবিলিটি বাড়বে অপরদিকে পর্যটনের বিরাট সম্ভাবনার দুয়ার খুলে যবে। বাংলাদেশে যে পরিবেশ বিরাজ করছে তা মোটেই গ্রহণযোগ্য নহে। বাতাসে কার্বনের মাত্রা বেশি, ধুলাবালি বেশী, শব্দদূষণ বেশী, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা মারাত্মক দুর্বল। এর চেয়ে বেশী খারাপ মানুষের জীবন যাত্রার মান। ভারত, চায়না, নেপাল থেকে সেডিমেন্ট গড়িয়ে এসে আমাদের হাওর ও নদনদী ভরাট করে চলেছে। এজন্য নিয়মিত মাটি ড্রেজিং করে হাওর ও নদনদী সারাবছর নাব্য রাখা প্রয়োজন। মাটিগুলি দেশের উন্নয়নমূলক কাজে ব্যবহার করা যেতে পারে। জলাভূমি এলাকায় কয়েক কোটি গাছ লাগালে পরিবেশের উন্নয়ন ঘটবে। নারীদের জন্য সেলাই প্রশিক্ষণ, হাঁস পালন প্রশিক্ষণ, শুটকী মাছ প্রস্তুতকরণ, পুরুষদের জন্য ইলেকট্রিশিয়ান, ড্রাইভিং, ভাষা শিক্ষা ইত্যাদি বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেয়া যেতে পারে।
সুন্দরবন এলাকা ইতোমধ্যেই বিশ্ববাসীর মন কেড়েছে। এখানে পরিদর্শন সহায়ক ও ইকোসিস্টেম উন্নত করার জন্য বিশেষ প্রকল্প নেয়া যেতে পারে। টাংগুয়ার হাওর ও হাকালুকি হাওর প্রকৃতিকে করেছে অপরূপ। হাওরের করচের তেলে বায়োডিজেল উৎপাদন হতে পারে যুগান্তকারী পদক্ষেপ। ভারতেও এ তেল কেরোসিনের পরিবর্তে কুপি জ্বালানো, রান্নাবান্না, পাম্পমেশিন চালানো, পাওয়ারট্রিলার ও ট্রাক্টর চালানো; বাস, ট্রাক ও জেনারেটর চালানো ইত্যাদি কাজে ব্যবহার হয়ে থাকে। করচের তেল জ্বালানি, লুব্রিক্যান্ট, সাবান কারখানা, চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণ এবং পেইন্টিংয়ের কাজে ব্যবহৃত হয়। বাতের ব্যথা, চর্মরোগের ওষুধ হিসেবে এর তেল ব্যবহার হয়ে থাকে। করচের তেল এবং শুকনো পাতা পোকামাকড় দমনের জন্য ব্যবহৃত হয়।
করচের খৈল পোলট্রি ফিড হিসেবে ব্যবহার হয়। করচের খৈল মাটিতে প্রয়োগ করলে মাটির উর্বরতা বাড়ে। এ ছাড়াও বায়োগ্যাস উৎপাদনের জন্য খৈল গোবরের চেয়ে উত্তম উপাদান বলে অনেকের অভিমত। হাওরের কালো মাটি সাশ্রয়ী, সহজলভ্য ও কাঠসহ অন্যান্য জ্বালানির চেয়ে দীর্ঘক্ষণ জ্বলার কারণে এর চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। শুষ্ক নদী ও হাওরের তলদেশ ৫ ফুট থেকে ১০ ফুট গভীরতায় কালো মাটি পাওয়া যায়। এ কালো মাটি সাশ্রয়ী, সহজলভ্য এবং কাঠসহ অন্যান্য জ্বালনির চেয়ে দীর্ঘক্ষণ জ্বলে।
হাওরের রাজধানী আর লোকসংস্কৃতির অন্যতম আধার সুনামগঞ্জে জন্ম নিয়েছেন মরমি সাধক দেওয়ান হাসন রাজা, বাউলসম্রাট শাহ আব্দুল করিম, ধামাইল গানের জনক রাধারমণ দত্ত, দুর্বিন শাহ এবং পণ্ডিত রামকানাই দাশ প্রমুখ। বাউলসম্রাট শাহ আব্দুল করিমের বর্ণনায় বর্ষার ভাসান জলে হাওরের মানুষের মাছ ধরে খাওয়া আর মনের আনন্দে গান গাওয়ার চিত্র খুঁজে পাওয়া যায়। নৌকাবাইচ আর যাত্রাপালার দেখা মেলে বর্ষার হাওরে।
হীরেন পণ্ডিত: প্রাবন্ধিক ও গবেষক