একুশে ফেব্রুয়ারি আত্মদর্শনের জন্য একটি সুযোগ


হীরেন পণ্ডিত: একুশে ফেব্রুয়ারি এদেশের মানুষকে আত্মত্যাগের চেতনা শিখিয়েছে, বাঙালিকে করেছে মহান। জাতি হিসেবে আমরা আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রতিষ্ঠায় অনুপ্রাণিত হয়ে ভাষাভিত্তিক বাঙালি জাতীয়তাবাদী আদর্শের সাথে মিলিত অসাম্প্রদায়িকক চেতনা গ্রহণ করেছি। মহান ভাষা আন্দোলনের পথ ধরে এসেছে মহান স্বাধীনতার চেতনা। প্রকৃতপক্ষে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ মাতৃভাষার অধিকার রক্ষায় ভাষা আন্দোলন শুরু হয়। ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ গ্রন্থে তিনি লিখেছেন, ‘আমরা দেখলাম, বাংলাকে বাদ দিয়ে উর্দুকে জাতীয় ভাষা করার বড় ষড়যন্ত্র চলছে। পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ এবং তমদ্দুন মজলিশ প্রতিবাদ করে এবং বাংলা ও উর্দু উভয়কেই রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানায়। আমরা মিটিং করে প্রতিবাদ শুরু করি। এ সময় পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ ও তমদ্দুন মজলিস যৌথভাবে সর্বদলীয় সভা আহ্বান করে এবং ‘রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ গঠন করে। সভায় ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চকে ‘বাংলা ভাষার দাবি’ দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়।

৭১ বছর আগে ১৯৫২ সালের এই মাসে মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষায় গণআন্দোলনে পূর্ণ সমর্থন দিয়েছিল সকল বাঙালি। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রæয়ারি বাংলার সাহসী ছেলেরা রাজপথে নেমে বাংলা ভাষাকে মাতৃভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করে, শক্তিশালী প্রতিরোধ গড়ে তোলে। বাংলা ভাষাকে মাতৃভাষা করার জন্য মাটির অনেক সাহসী সন্তান প্রাণ উৎসর্গ করেছেন, যা পৃথিবীর ইতিহাসে এক বিরল ঘটনা। তাদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে মাতৃভাষা বলার অধিকার, মাতৃভাষার মর্যাদা এবং সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেরণা। ফেব্রæয়ারি মাস একদিকে শোকাবহ হলেও অন্যদিকে রয়েছে এর গৌরবময় অধ্যায়।

কিন্তু বিশ্বজুড়ে অনেক ভাষাই বিলুপ্ত হয়ে গেছে। মানুষ তাদের কথ্য ভাষা হারাতে ভোগে। কিন্তু বাঙালির বীরত্ব এই বিরল আত্মত্যাগের স্বীকৃতিস্বরূপ তার ভাষাকে সম্মানজনক স্থানে অধিষ্ঠিত করেছে, ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর ইউনেস্কো ২১ ফেব্রæয়ারিকে বিশ্বজুড়ে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা উদযাপন হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। বাঙালির সাংস্কৃতিক ও আর্থ-সামাজিক বিকাশের চড়ান্ত পর্যায়ে তার অস্তিত্বের সংগ্রাম শুরু হয়। বাংলা ভাষাকে টিকিয়ে রেখেছে এটা তাদের কাছে কম কৃতিত্ব নয়। সেই একটি ভাষায়, তারা সকাল, সন্ধ্যা এবং রাতে সাবলীলভাবে কথা বলে এবং স্বপ্ন দেখে। মানুষ আজ প্রায় ১৭ কোটি।

মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে ভাষণ দিয়ে বলেন, ‘পাকিস্তানের প্রদেশগুলো তাদের দাপ্তরিক কাজে যেকোনো ভাষা ব্যবহার করতে পারে, কিন্তু রাষ্ট্রভাষা হবে একটিই, সেটি হবে উর্দু। সে সময় কার্জন হলে উপস্থিত কিছু ছাত্র ‘না’ ‘না’ বলে চিৎকার করে প্রতিবাদ করে এবং পরে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর কাছে স্মারকলিপি দেয়, যাদের অনেকেই সেই সময়ে জিন্নাহর মুসলিম লীগের সদস্য ছিলেন। স্মারকলিপিতে বাংলাকে অন্যতম জাতীয় ভাষা করার দাবি করে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের উদাহরণ দেওয়া হয়েছে, যেখানে একাধিক জাতীয় ভাষা গ্রহণ করা হয়েছে।
পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিনের ‘উর্দু এবং শুধুমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা’ এই বক্তব্যের প্রতিবাদে, ১৯৫২ সালের ৩১ জানুয়ারি, যৌথ উদ্যোগে ‘অল-ইউনিয়ন সেন্ট্রাল স্টেট ল্যাঙ্গুয়েজ স্ট্রাগল কাউন্সিল’ গঠিত হয়। সকল রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক দল এবং কাজী গোলাম মাহবুবের আহ্বায়ক করে গঠিত সংগ্রাম পরিষদ ২১ ফেব্রুয়ারিকে ‘ভাষা দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করে এবং সারা দেশে ধর্মঘটের ডাক দেয়। অন্যদিকে তৎকালীন নুরুল আমিন সরকার ১৪৪ ধারা জারি করে ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা মেডিকেল কলেজ প্রাঙ্গণে জড়ো হওয়া শিক্ষার্থীদের ওপর অন্যায় ও অগণতান্ত্রিকভাবে গুলি চালায় যার ফলে রফিক উদ্দিন আহমেদ, আবুল বরকত, আবদুল জব্বার, আবদুস সালাম, শফিউর রহমান শহীদ হন। অহিউল্লাহ নামে একজন যিনি ঢাকার নবাবপুর রোডে পুলিশের গুলিতে নিহত হন।

এরপর ১৯৫২ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি রাতারাতি প্রথম শহীদ মিনার নির্মিত হয় এবং উদ্বোধন করেন শহীদ শফিউরের বাবা। পরবর্তীতে, ১৯৫৪ সালে, পাকিস্তানের গণপরিষদ বাংলাকে একটি জাতীয় ভাষা হিসাবে স্বীকৃতি দেয় এবং ১৯৫৬ সালে, সাংবিধানিকভাবে বাংলাকে জাতীয় ভাষার মর্যাদা দেওয়া হয়, যা বাঙালি জাতির গৌরবের ইতিহাসে অন্যতম অর্জন। পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্র, বুদ্ধিজীবী এবং রাজনীতিবিদরা উপলব্ধি করেন যে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার প্রধানত পাঞ্জাবি শাসক শ্রেণী উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার আড়ালে ইসলামের নামে বৈষম্য ও শোষণ চাপানোর পরিকল্পনা করেছে। এই ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে উর্দুভাষী পাঞ্জাবি শাসকগোষ্ঠী পূর্ব পাকিস্তানের জনগণকে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ও চাকরি থেকে বঞ্চিত করার এবং পূর্ব পাকিস্তানের উনয়নকে ব্যাহত করার সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা গ্রহণ করে। উল্লেখ্য যে, সেই সময়ে পশ্চিম পাকিস্তানের ৪০ শতাংশ মানুষ পাঞ্জাবি বলতেন, যেখানে উর্দু ছিল মাত্র ৪ শতাংশের ভাষা।

কেন্দ্রীয় সরকারের এই বৈষম্যমূলক অর্থনীতির কারণে দিন দিন পূর্ব পাকিস্তান শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও পরিকাঠামোর দিক থেকে দুর্বল হয়ে পড়ে। জাতীয় ভাষা হবে উর্দু না বাংলা, সেই দ্বন্দ্বের ফলেই বাংলাদেশের জন্ম। পাকিস্তান সৃষ্টির আন্দোলনে বাঙালি মুসলমানদের আশা ছিল যে, মুসলমানদের জন্য একটি স্বাধীন দেশ হলে তারা ভূস্বামী ও সাম্রাজ্যবাদীদের হাত থেকে মুক্ত হয়ে নিজেদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করবে। এমতাবস্থায় আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি লাহোরে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর এক সম্মেলনে ঐতিহাসিক ছয় দফা পেশ করেন। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের ঐতিহাসিক ছয় দফা ঘোষণা বা সনদ এবং পরবর্তীতে ১৯৬৬ সালের ৬ দফা। বাংলাদেশের জন্ম। ছয় দফা দাবির মূল উদ্দেশ্য ছিল পাকিস্তানকে যুক্তরাষ্ট্রের মতো ফেডারেল রাষ্ট্রে পরিণত করা এবং প্রতিটি রাষ্ট্রকে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন দেওয়া।
১৯৬৬ সালে প্রণীত ছয় দফা সনদ আজকের আধুনিক বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর চিন্তাধারার চেয়েও ভালো। যুক্তরাষ্ট্র তার দেশের অগ্রগতির জন্য সর্বদা সঠিক পথ অবলম্বন করে। তবে পাকিস্তানের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র সেদিন ছয় দফা বাস্তবায়ন ভালো পরামর্শ ও সহযোগিতা করলে দেশটি সত্যিকারের বন্ধুত্বের পরিচয় দিত। এইভাবে পাকিস্তানের বৈষম্য ও শোষণ নীতি তাড়াতাড়ি স্বাধীনভাবে বাঁচার আশাকে নস্যাৎ করে দেয়, যার ফলে গণ-আন্দোলন এবং রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের ফলে ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম হয়।
ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমেই স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের জন্ম এবং তারই ধারাবাহিকতায় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের যুদ্ধে জয়ী না হলে সে দেশকে সত্যিকার অর্থে স্বাধীন দেশ বলা যাবে না। ফেব্রæয়ারি আজকের ভাষা আন্দোলনের অমর স্মারক মাস। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দিতে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকায় পুলিশের গুলিতে যারা প্রাণ দিয়েছিলেন, এই মাসজুড়ে আমরা তাদের স্মরণ করছি। পাকিস্তানে সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়া সত্তে¡ও শাসকগোষ্ঠী বাংলাকে ‘একমাত্র রাষ্ট্রভাষার’ মর্যাদা দিতে রাজি ছিল না। এমনকি পাকিস্তান রাষ্ট্রের নেতা হিসেবে বিবেচিত মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ এই বিষয়ে অত্যন্ত নেতিবাচক অবস্থান নিয়েছিলেন, যা এই অঞ্চলের ছাত্র ও শিক্ষিত সম্প্রদায়কে ক্ষুব্ধ করেছিল। এর পরবর্তী ইতিহাস সবারই জানা।

ভাষা আন্দোলনে উদ্ভূত চেতনাই আমাদের স্বাধীনতার বোধ নিয়ে আসে। পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ এটিকে অপমান করতে থাকলে তা আরও তীব্র হয়। আমাদের অনন্য ইতিহাস ও ঐতিহ্য ধীরে ধীরে এগিয়ে আসে। সাহিত্যের আমাদের পরিচয় ও অধিকারের প্রশ্ন প্রবলভাবে উঠতে শুরু করে। ভাষা আন্দোলনে আত্মত্যাগের ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় এ অঞ্চলের বাঙালি কবিদের লেখা কবিতা আজও গভীর আবেগে পাঠ করা হয়। শুধু নিজের ভাষার প্রতি ভালোবাসা নয়, নিজের মানুষের কল্যাণের কথাও এভাবে সামনে আসে। স্বায়ত্তশাসনের দাবি বাড়াতে থাকে। কয়েক দশকের সামরিক শাসন দিয়েও তা দমনের চেষ্টা করা হয়। এরই মধ্যে বাঙালির গৌরব ক্ষুণœ ও বিনষ্ট করার অপচেষ্টা চলছে। রবীন্দ্রনাথকে অস্বীকার করার অপচেষ্টা বরং ফিরে আসে। পূর্ব বাংলার গ্রামীণ সমাজ থেকে উঠে আসা শিক্ষিত সম্প্রদায় নজরুলের পাশাপাশি রবীন্দ্রনাথকে সাহিত্য ও সংস্কৃতির প্রধান উৎস হিসেবে ঘোষণা করে। ১৯৬০ এর দশক জুড়ে, বাঙালির রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জাগরণ হাত ধরে চলেছিল, কখনও কখনও একে অপরের সাথে জড়িত ছিল। এটি অনিবার্যভাবে আমাদের স্বাধীনতার দিকে নিয়ে যায়। তাই এটা বলা খুবই যুক্তিযুক্ত যে, ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়েই স্বাধীন বাংলাদেশ নামে স্বাধীনতা এসেছে।

বিশ্বের বিভিন্ন ভাষাভাষী মানুষ বাংলাদেশের কারণেই বাংলাকে জানে ও সম্মান করে। তারা সম্মান করে যে, বাঙালি মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষায় শুধু আত্মত্যাগই করেনি, যোগ্য স্থানেও প্রতিষ্ঠা করেছে। বিশ্ববাসী আজ জানে যে, এ অঞ্চলের মানুষও ভাষাভিত্তিক জাতীয়তার ভিত্তিতে একটি দেশ প্রতিষ্ঠা করেছে। স্বাধীনতা-উত্তর সংবিধানে তারা জাতীয়তাবাদকে রাষ্ট্রের একটি মৌলিক নীতি হিসাবে অন্তর্ভুক্ত করেছিল, যা পরবর্তীতে একটি সামরিক সরকার বাতিল করার চেষ্টা করেছিল। জাতীয়তা ও নাগরিকত্বকে বিভ্রান্ত করে তারা এদেশের মানুষকে বিভ্রান্ত করার কৌশল নিয়েছে। কিন্তু মানুষকে বেশিক্ষণ বিভ্রান্ত করে রাখা যায়নি। তারা আবারও মূলধারার জাতীয়তাবাদে ফিরে এসেছে। দেশ মুক্তিযুদ্ধের পথে ফিরে আসায় আমাদের জাতীয় চেতনা রাজনৈতিকভাবে শক্তিশালী হয়েছে।

দেশ অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে যাচ্ছে। একসময় ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ হিসেবে আখ্যায়িত দেশটি এখন চালসহ অনেক প্রধান খাদ্যশস্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ। বাংলাদেশ শুধু বিদেশে জনশক্তি পাঠিয়ে নয়, দেশীয় উৎপাদিত পণ্য রপ্তানির মাধ্যমেও সমৃদ্ধ হয়েছে। বাংলাদেশ এখন নিজস্ব অর্থায়নে বড় বড় উনয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে পারে। বলা হয়, ভাষা আন্দোলনের ফলে সৃষ্ট দেশে কোনো অপুষ্টির শিকার মানুষ নেই। গ্রামের মানুষের জীবনযাত্রায় ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। স্বাধীনতার ৫২ বছরে পাল্টেছে দেশের চিত্র। বাংলাদেশ কৃষি থেকে শিল্পের দিকে অগ্রসর হচ্ছে এবং এখানে সেবা খাতও বিকশিত হচ্ছে। একাত্তরের শহীদরাও নিশ্চয়ই এমন একটি দেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন।

বাংলাদেশে আমরা প্রত্যাশিত সবকিছু পেয়ে গেছি এটা বলা যাবে না । এক্ষেত্রে শুরুতেই শিক্ষার কথা উল্লেখ করতে হবে। আমরা শিক্ষার প্রসার ঘটিয়েছি তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আমরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা, এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বাড়াতে পেরেছি; প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি, টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটিও কম নয়। কিন্তু মানসম্মত শিক্ষা কতটা নিশ্চিত হচ্ছে তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। প্রাথমিক স্তর থেকে শিক্ষার বিভিন্ন ধারা আমাদের নতুন প্রজন্মকে একই পায়ে দাঁড়াতে দিচ্ছে না। ধনী পরিবারের সন্তানরা যেমন ভিন্ন ধরনের শিক্ষা নিয়ে এগিয়ে যায়, তা আবার বৈষম্যের কারণ। আমরা মাতৃভাষাকে শিক্ষার মাধ্যম করব বা সর্বস্তরে বাংলার প্রচলন করব এই ছিল আমাদের অঙ্গীকার। তা সম্পন্ন করার জন্য যে সমন্বিত প্রচেষ্টা প্রয়েজিন তা আমরা কতটুকু নিতে পেরেছি? উচ্চশিক্ষা পর্যায়ে বাংলা মানসম্পন্ন বই লেখা এমনকি অনুবাদেও কতটা অগ্রগতি হয়েছে? ভাষা আন্দোলনের অমর স্মারক মাসে বইমেলার আয়োজন করছে বাংলা একাডেমি।

সময়ের সাথে সাথে মেলার প্রসার ঘটেছে এবং এর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ছে বহুদূরে। এ উপলক্ষে সাহিত্যসহ নানা ধরনের বইও প্রকাশিত হচ্ছে। কিন্তু মানের দিকে লক্ষ্য করলে অনেক ক্ষেত্রেই হতাশ হবেন। ভাষার ব্যবহারেও চলছে নৈরাজ্য। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাষার বিষয়ভিত্তিক ব্যবহারও এর জন্য দায়ী। তবে অনলাইনে বাংলায় লেখা অনেক বেড়েছে। তরুণদের অংশগ্রহণ উল্লেখযোগ্য। ইংরেজিসহ বহুল ব্যবহৃত ভাষায় লেখা, বাংলায় লেখা উচ্চমানের সাহিত্যের মানসম্মত অনুবাদ ও প্রচার প্রয়োজন। জাতির আশা আকক্সক্ষা ও মননের প্রতীক বাংলা একাডেমিকেও এ কাজে এগিয়ে আসতে হবে। ভুলে গেলে চলবে না যে বাংলা একাডেমি ভাষা আন্দোলনের প্রত্যক্ষ ফসল।

তবে ২১শে ফেব্রæয়ারিকে এখন জাতিসংঘের শিক্ষা, সংস্কৃতি ও বিজ্ঞান বিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কো ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করেছে। এই স্বীকৃতিও আমাদের জন্য সম্মানের। এ ধরনের স্বীকৃতির মর্যাদা রক্ষার জন্য আমাদের দেশের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর কথ্য ভাষা রক্ষায় আবারও মনোযোগ দিতে হবে। তাদের সন্তানরা যাতে তাদের মাতৃভাষায় শিক্ষা গ্রহণ করে এবং একই সঙ্গে উন্নয়নের মূল স্রোতধারায় যুক্ত হয় সে ব্যবস্থা করতে হবে। ভাষা আন্দোলন যেমন আমাদের গর্বিত করেছে, তেমনি কিছু কাজের জন্যও আমাদের দায়ী করেছে, যা এড়ানো যায় না। আমরা যদি শিক্ষা, সংস্কৃতিতে অগ্রসর হতে না পারি এবং উন্নত মানবসম্পদ হতে না পারি তাহলে আমরা আমাদের ভাষা ও দেশকে মহিমান্বিত করতে পারব না। দেশকে এগিয়ে নিতে পারব না। এক্ষেত্রে সুযোগের সমতা নিশ্চিত করতে বৈষম্য দূরীকরণের পদক্ষেপ নিতে হবে। যা খুব জরুরি।

ভাষা আন্দোলনের ফলে সৃষ্ট এ দেশে অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য কাজ করার পাশাপাশি রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হবে। পাকিস্তান আমলে আমরা সাংস্কৃতিক বিভাজন প্রত্যাখ্যান করেছি এবং গণতান্ত্রিক চেতনাকে লালন করে এগিয়েছি, যা এড়ানো উচিত নয়। বিভক্তি নয় ঐক্যের পথে এগিয়ে যেতে হবে। প্রগতিশীলতার চর্চা করতে হবে। পরিবর্তিত বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে, প্রতিটি দেশে এই পশ্চাৎপদ উপাদানগুলির মধ্যে আলাদাভাবে এগিয়ে যাওয়া কঠিন। এই স্রোতে এগিয়ে যাওয়ার কোন বিকল্প নেই। বাঙালির প্রশ্নে অসাম্প্রদায়িক চেতনা ও গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি, সুবিধাবাদ ও আপস বরদাস্ত করা যায় না। এতে জাতীয় জীবনে বিরাট বিপর্যয় ঘটবে। এর ফলশ্রুতিতে একদিন হয়তো দেখা যাবে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাবে এগিয়ে যেতে পারলেও আমরা অনেক পিছিয়ে পড়েছি। এই লড়াইয়ের মূলে রয়েছে শিক্ষা। তাই শিক্ষাক্ষেত্রে বিভক্তির পরিবর্তে ঐক্যের ভিত্তি মজবুত করতে হবে। দুর্ভাগ্যবশত, এই অগ্রগতি সত্ত্বেও, রাষ্ট্রীয় অর্থায়ন লিখিত এবং মুদ্রিত পাঠ্যপুস্তকগুলি অপ্রত্যাশিত বিতর্কের সম্মুখীন হচ্ছে। তাতে বিভাজনের রেখা, ক্ষমতার বিবৃতি দিয়ে হাজির হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধের সমর্থকদের এসব বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে।

ভাষা আন্দোলনের মাস ও চেতনার মাস ফেব্রুয়ারি আমাদের আত্মদর্শনের সুযোগ এনে দেয়। আমরা এত বড় অর্জনের উচ্ছ্বসিত আলোচনায় আবদ্ধ না হই যেগুলি এখনও অর্জিত হয়নি বা অবমূল্যায়িত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

হীরেন পণ্ডিত, প্রাবন্ধিক ও গবেষক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *