হীরেন পণ্ডিত: সকলের সহযোগিতা নিয়ে বাঙালি সংস্কৃতির অগ্রযাত্রাকে নিষ্কণ্টক রাখতে হবে এবং সবাই কাজ করতে অঙ্গীকারাবদ্ধ আছে। বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বাঁচিয়ে রাখতে দেশের উন্নয়ন বিরোধী সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তুলতে সাংস্কৃতিক কর্মীদের এগিয়ে আসতে হবে। আমাদের জাতিসত্তার উত্থানে সাংস্কৃতিক আন্দোলন মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে। সংস্কৃতির অঙ্গণ থেকে অপসংস্কৃতিকে দূরে সরিয়ে বাঙালির হাজার বছরের ঐতিহ্যকে তুলে ধরতে হবে।: জালাল উদ্দিন খাঁ ২০২৪ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক মরণোত্তর একুশে পদকে ভূষিত হয়েছেন। তাঁর মৃত্যুর ৫২ বছর পর হলেও এই জাতীয় স্বীকৃতি আমাদের সবাইকে আনন্দ দিয়েছে। যদিও অনেক আগেই তাঁর এই সম্মান পাওয়া উচিত ছিল। মহান সাধক জালাল উদ্দিন খাঁ’র জন্ম ২৫ এপ্রিল ১৮৯৪, মৃত্যু ১৯৭২ সালে। তাঁর মৃত্যুবার্ষিকীতে প্রতি বছর কেন্দুয়ার তাঁ নিজের গ্রামে পারিবারিক ভাবে পালন করা হয়। এখন উপজেলা পর্যায়েও অনুষ্ঠিত হয় মেলা। জালাল উদ্দিন খাঁ তাঁর গানে বলেছেন- “ভবে মানুষ রতন করো তারে যতন-যারে তোমার মনে চায়ও রে”। গুণী বাউল সাধক জালাল উদ্দিন খাঁর জীবন-কর্ম ও তার চিন্তাভাবনা সাধারণ মানুষের কাছে তুলে ধরাই এই মেলার উদ্দেশ্য।
যেখানে কোন আদর্শ কাজ করে না। আর আদর্শহীন সংস্কৃতি হচ্ছে অপসংস্কৃতি। সেই অপসংস্কৃতিকে সংস্কৃতি বলে চালিয়ে দেয়ার একটা চতুর প্রক্রিয়া এখন সংস্কৃতির পরিমণ্ডলের মধ্যে খুব সূক্ষ্মভাবে কাজ করতে পারছে বলে সাধারণের চোখে তা ধরা পড়ছে না। সংস্কৃতি সম্পর্কে এক এক জনের ধরনের ধারণা এক এক রকম। একটি আংশিক ধারণা মাত্র। আসলে সংস্কৃতির মানে আরও ব্যাপক, বিস্তৃত, ব্যাপ্ত এবং অনেকক্ষেত্রে অবিনাশী। কারণ, সংস্কৃতি হচ্ছে মানুষের জীবনচর্যার একটি বিশালতম প্রেক্ষাপট, যাকে ভাষার অবয়বে সম্পূর্ণ ব্যাখ্যা করা অনেকটাই অসম্ভব।
আজকাল সেক্যুলার রাজনীতি বা ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির কথা খুব শোনা যায়। কিন্তু বাউলরা আধ্যাত্মিকতাকেও ধর্মনিরপেক্ষ করে তুলেছিলেন। তাঁদের কৃতিত্বটা একবার ভেবে দেখা আমাদের সকলের প্রয়োজন। আজকাল গণমুখী কথাটার খুব কদর। কিন্তু বাউল গান জিনিসটা গণসংগীত ছাড়া আর কী? ওদের চাইতে বিপ্লবীই বা কে।
মনোবিজ্ঞানেরও অগ্রদূত প্যাভলভ বলেন, শরীরটাই সব এবং শরীরের অভ্যাসটাই আত্মা। সিগমন্ড ফ্রয়েড বলেন শরীর নয়, প্রাণ ও প্রাণের তাড়নাই সব। ডেভিড অ্যাডলার বলেন দেহ প্রাণ নয়, মনের অহমিকাই মুখ্যশক্তি। ইয়ং মি বলেন ওসব নয়, জীবন বোধ বোধই নিয়ামক শক্তি। শহর বা নগরে আমরা যে-সব নাচ-গান-নাটক আমরা প্রতিনিয়ত আমরা দোখ, তাকেই আমরা ইতিবাচক বা নেতিবাচক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার-বিশ্লেষণ করি। কিন্তু যারা এই সংস্কৃতির ধারক-বাহক অর্থাৎ এই সংস্কৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করেন, তাদের অধিকাংশই এটা করেন সংস্কৃতির প্রতি ভালোবাসা থেকে নয়, এ-থেকে ফায়দা লোটা যায় বলে।
সেই পরিপ্রেক্ষিতে বিবেচনা করলে সংস্কৃতিকে নিয়ে যেতে হবে বিশ্বের অভ্যন্তরীণ প্রবাহের মধ্যে, যেখান থেকে সারা পৃথিবী তথা মানুষের যাবতীয় কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়। আমরা চোখে যা দেখি কিংবা যা আমাদের দৃষ্টিতে প্রত্যক্ষ, তাকেই আমরা সংস্কৃতির আধার বলে মনে করি। তার ফলে সংস্কৃতি সম্পর্কে ধারণা যেমন খÐিত হয়ে যায়, তেমনি বাস্তব ক্ষেত্রেও সংস্কৃতি হয়ে ওঠে সীমিত পটভূমিকায় একটি কুসংস্কারের আধার।
অষ্টাদশ থেকে ঊনবিংশ শতাব্দি ছিল বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চল সুফি ঘরানার তত্ত¡ভিত্তিক বাউলের উৎসভূমি। তাত্তি¡কতায় কামরূপের প্রভাব ছিল বলে এখানকার বাউলদের মাঝে বৈরাগ্যের পাশাপাশি গৃহীবাদের সুবৈশিষ্ট লক্ষ্যণীয়। যার ফলে ময়মনসিংহ তথা কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোণা, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ এবং সিলেটের বেশ কিছু অংশ নিয়ে সংসারবাদী অর্থাৎ গৃহীবাউলের প্রভাবে গড়ে উঠে ছিল বৈঠকী বাউল গানের বলয়।
এই বলয়ের বড় বৈশিষ্ট ছিল- আত্মানুসন্ধান, বৈচিত্রগায়কী ও সঙ্গীত রচনা বা তৈরি করা। তৎকালীন বাউলগণ গান রচনা বা মুখে মুখে বিভিন্ন তত্ত¡কথার গীত তৈরী ও নিজেরাই সুর করে আবৃত্তি করতেন আবার নিজেই গাইতেন বলে তাদেরকে বলা হতো বাউলকবি। আবার ¯্রষ্টার সৃষ্টির নিগূঢ়তত্ত¡ উদঘাটন করতে জীবনভর তথ্য ও তত্ত¡ সাধনে মত্ত থাকায় তাঁদেরকে বলা হতো বাউলসাধক।
তাঁরা পরম ও পরমেশ্বর-জড় ও জীবজগৎ এবং সৃষ্টির রহস্যন্মোচনে নির্লোভ-নিরলস তপ, জপ, ধ্যান ও সাধনমার্গে জীবন সমাপ্ত করেছেন। তারা বিত্তকে পরিহার করে দৈনকে অঙ্গবিভূষিত করে মানবপ্রেমে ব্রতী হয়েছেন। তাঁরা যুগযুগ কাটিয়ে দিয়েছেন লোভ মোহ ত্যাগ করে স্রষ্টার ধ্যানে।
তারই ধারাবাহিকতায় ঊনবিংশ শতাব্দি হতে এই অঞ্চলে বাউলের নতুন সূর্যালোয়ে ঝলসে উঠা একঝাঁক বাউল কবি ও বাউল সাধকের উত্থান। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন বিতলংসাধু, আতরচান, ফকিরচাঁদ, রশিদউদ্দিন, উকিল মুন্সি, চান খাঁ পাঠানসহ আরো অনেকে।
বাউল কবি ও বাউল সাধকদের মধ্যে-বাউলকবি রশিদ উদ্দিন, উকিল মুন্সি, জালাল উদ্দিন খাঁ’র বাউল দর্শনে তিনটি ধারা পরিলক্ষিত হয়। যেমন মানবতা ও সুফিবাদ, মরমী ও সহংবাদ এবং চর্যাপদের অস্তিত্ব। এর মধ্যে বাউল সাধক জালাল উদ্দিন খাঁ’র ১৪টির মধ্যে ১৩টি বাউল তত্তে¡ও প্রায় প্রতিটিতেই শরীরী ও অশরীরী মুক্তির বার্তা বহন করে। এ তত্ত¡গুলোর গায়ে বিচ্যুরিত হয় জীবনের আড়ালে লুকিয়ে থাকা জীবনের জ্যোতি। আর এ জন্যেই জালাল খাঁ স্বতন্ত্রধারার আত্মসন্ধানী বাউলকবি ও সাধক।
আত্মতত্ত¡, পরমতত্ত¡, নিগূঢ়তত্ত¡, লোকতত্ত¡, দেশতত্ত¡ ও বিরহতত্তে¡র নামাঙ্কিতের মাঝে জালাল উদ্দিন প্রায় সহ¯্রাধিক গান রচনা করেছিলেন। প্রখ্যাত এই লোক কবি মালজোড়া গানের আসরেও ছিলেন অনন্য। তার জীবদ্দশায় চার খÐের ‘জালাল-গীতিকা’ গ্রন্থে ৬৩০টি গান প্রকাশিত হয়েছিল। তার মৃত্যুর পর প্রকাশিত হয় ‘জালাল-গীতিকা’ পঞ্চম খÐ। মোট ৭০২টি গান নিয়ে ২০০৫ সালের মার্চে প্রকাশিত হয় জালাল গীতিকা সমগ্র। জালাল খাঁ তাঁর গানগুলোকে বিভিন্ন তত্তে¡ বিন্যস্ত করে প্রকাশ করেন। আবার জালাল খাঁ অনেক গানই কোনো তত্ত্বের অন্তর্ভুক্ত করেননি। সেগুলো ভাটিয়ালি, মুর্শিদি ও মারফতি নামে পরিচিত।
সুদীর্ঘ সময় পর হলেও বাংলাদেশ সরকার তাকে যথাযথ মূল্যায়ন করেছেন। জালাল অত্যন্ত জনপ্রিয় গীতিকার এবং বলিষ্ঠ মতবাদের মানুষ। তাঁর যুক্তিবাদী আধুনিক-মনস্কতা বিশেষভাবে তাঁর গানকে আকর্ষণীয় করেছে। জালালের গান আমাদেও দেশের পরম্পরায় খুব গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর গানগুলোর আলাদা টিকাভাষ্য লেখার প্রয়োজন নেই, কারণ তাঁর রচনা খুব প্রাঞ্জল ও হৃদয়গ্রাহী। ¯্রােতের বিপক্ষে সর্বাধুনিক ভাবনা ছিল জালালের ছিল সর্বাধুনিক ভাষা। জালাল তাঁর গানে সর্বধর্ম সমন্বয়ের কথা বলেছেন। বিশ্বাস থেকে লিখেছেন: হিন্দু কিংবা মুসলমান, শাক্ত বৌদ্ধ, খ্রিস্টান বিধির কাছে সবাই সমান পাপ-পুণ্যের বিচারে।
জালাল শেষ পর্যন্ত মানবপন্থী, তাই বলতে পেরেছেন আরবে মক্কার ঘর, মদিনায় রসুলের কবর এবং বায়তুল্লায় শূন্যের পাথর, সবই মানুষের হাতের সৃষ্টি। এমনকি ফেরেশতা যেখানে যেতে পারে না, মানুষ সেখানেও গেছে।’ ষাটের দশকে ড. মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ, ড. মুহম্মদ এনামুল হক, অধ্যাপক মনসুরউদ্দিন প্রমুখের সঙ্গেও তাঁর সাক্ষাৎ ও দীর্ঘ সময়ব্যাপী আলোচনা হয়েছিল বলে শোনা যায়। এসব সাক্ষাৎকালেও তাঁর স্বভাবসুলভ সারল্য ও দৃপ্তভঙ্গি অক্ষুণœ ছিল বলে তাঁর সংগীতের বর্ণনায় শোনা যায়।
কৃষি সমাজের মানুষের সারল্য ও অকপটতা তাঁর চরিত্রে এক ভিন্নমাত্রা এনে দিয়েছিল, তাই ঢাকার এই সুধীমÐলীতে পল্লীপ্রান্তনিবাসী জালাল উদ্দীন খাঁর বিচরণে কোনো সংকোচ বা জড়তা ছিল না। অনিকেত মানুষের এই লোককবি প্রত্যক্ষ প্রেরণা পেয়েছিলেন এ অঞ্চলেরই আরেকজন প্রখ্যাত লোককবি ও গীতিকার রশিদ উদ্দিনের কাছ থেকে। বিগত শতাব্দীর বিশের দশকেই রশিদ উদ্দিন খ্যাতিমান হয়ে উঠেছিলেন। জালালের চেয়ে বছর পাঁচেকের বড় ছিলেন তিনি। অগ্রজ এই কবির বাড়তি ছিল নেত্রকোণা শহরের পাশের গ্রাম বাহিরচাপড়ায়।
জালাল খাঁ কিছুদিন নেত্রকোনা দত্ত হাইস্কুলে পড়াশোনা করেছিলেন। সেই সূত্রেই রশিদের ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে এসে জালালের কবিপ্রতিভা তথা সংগীতপ্রতিভা বিকশিত হয়েছিল। রশিদ উদ্দিন ছাড়াও ময়মনসিংহ গীতিকা অঞ্চলে জালালের সমসাময়িক অগ্রজ ও অনুজ কবি-গীতিকারদের মধ্যে ছিলেন- উকিল মুন্সি, চান খাঁ পাঠান, তৈয়ব আলী, মিরাজ আলী, দুলু খাঁ, আবেদ আলী, উমেদ আলী, আবদুল মজিদ তালুকদার, আবদুস সাত্তারসহ আরো অনেকে।
জালাল রচিত গীতিগুলোতেও এ রকমই স্বাধীন চিন্তা ও বিদ্রোহী চেতনার স্পষ্ট ও সার্থক অভিব্যক্তি ঘটেছে। জালালের সংগীত ভাবনা তথা জীবনদর্শনে দ্বৈতবাদের কোনো স্থান নেই। সীমার মাঝে অসীম এর বোধটিও এবং ‘বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য’ এর ধারণাটিও, জালালের গানে অভিব্যক্তি পেয়েছি।
একজন প্রকৃত আধুনিক মানুষের মতোই তিনি লক্ষ্য করেছেন যে ধর্মব্যবসায়ীরা জনসাধারণের আত্মজ্ঞান লাভের পথে বাধার সৃষ্টি করে রেখেছে, ধর্মের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে মানুষকে ভাষা শিক্ষা থেকেও বঞ্চিত রাখতে চেয়েছে। তাইতো তিনি বলেছেন, ‘বিজাতি ইংরেজি শিক্ষায় বেহেশ্ত না পাওয়া যায় মাল্লাজিদের কথা শুনে শিখল না মানুষে, সকল ভাষা সমান বুঝে ধর এবার কষে- কবে আবার সুদিন উদয় জালালে কয় চল্ সাহসে। যেসময়ে পল্লির মানুষ জন্মনিয়ন্ত্রণকে পাপ বলে মনে করেছে, সে সময়েই জালাল বলেছেন, জন্মনিরোধ না করিলে সুখ পাবে না এ-সংসারে। একশো বছর আগের চিন্তা এখনো প্রাসঙ্গিক।