হীরেন পণ্ডিত: বাংলাদেশে নারী মুক্তির ইতিহাস দীর্ঘদিনের, স্বাধীনতাযুদ্ধে নারীর সরাসরি অংশগ্রহণ থেকে শুরু করে নারীর ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অগ্রগতি প্রশংসনীয়। সুদৃঢ় প্রশাসনিক ও আইনি কাঠামো, সচেতন নাগরিক সমাজের কারণে বাংলাদেশের নারী আন্দোলন শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়েছে, যা নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় এবং নারীবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টিতে কার্যকর ভূমিকা রেখেছে। বাংলাদেশ শুরু থেকেই নারীর প্রতি সব ধরনের বৈষম্য দূরীকরণ সনদে (সিডও) স্বাক্ষর করেছে। সব ধরনের শিক্ষায় নারীর প্রতি বৈষম্য দূর করা, বিশেষ করে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষাসহ উচ্চশিক্ষায় নারীদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি নারীর ক্ষমতায়নকে ত্বরান্বিত করা ছিল অন্যতম প্রধান লক্ষ্য। জেন্ডার সমতা এবং নারীর ক্ষমতায়নকে টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (এসডিজি) ও লক্ষ্যমাত্রাগুলোতে (টার্গেটগুলোতে) অন্যতম প্রধান বিষয় হিসেবে ধরে নেওয়া হয়েছিল।
কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, জেন্ডার সমতা ও নারীর ক্ষমতায়ন দারিদ্র্যবিমোচনের ক্ষেত্রে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। বাংলাদেশ প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে জেন্ডার বৈষম্য অনেকটাই কমিয়ে আনতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে। মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়েও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ছাত্রী ভর্তি হয়েছে। তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ে জ্ঞান অর্জন জেন্ডার সমতা তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। জাতীয় জীবনে নারীর যথাযথ মর্যাদা ও স্বীকৃতি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সরকার জাতিসংঘ সিডও সনদসহ বেশ কিছু আন্তর্জাতিক নীতি ও সনদে স্বাক্ষর করেছে। এত কিছুর পরও কেন পিছিয়ে থাকবে নারী? জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত এবং দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাসের পরিপ্রেক্ষিতে লিঙ্গসমতার অগ্রগতি একবিংশ শতাব্দীর অন্যতম বড় বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ। জলবায়ু পরিবর্তন এবং স্থায়িত্বের সমস্যাগুলো আমাদের পরিবেশ, অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের ওপর গুরুতর এবং দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলেছে, তা অব্যাহত থাকবে। নারী আন্দোলনের দীর্ঘ পথপরিক্রমায় নারী সমাজের যথেষ্ট অগ্রগতি হলেও লিঙ্গসমতার
বিষয়টি এখনো পুরোপুরি প্রতিষ্ঠিত হতে পারেনি। এ চিত্র শুধু বাংলাদেশেই নয়, পৃথিবীর সর্বত্র দৃশ্যমান। অথচ দেশ কিংবা সমাজের উন্নয়ননির্ভর করে জনগোষ্ঠীর সামগ্রিক অবদান ও অংশগ্রহণের ওপর।
শিল্পক্ষেত্রে নারীশ্রমিকের বঞ্চনা একটি আলোচিত বিষয়। যৌতুকপ্রথা, বাল্যবিয়ে, ধর্মীয় কুসংস্কার, পারিবারিক জীবনে পুরুষতান্ত্রিক মনোভাবের আধিপত্য, প্রথা, পুরোনো ধ্যানধারণা আমলের মনোকাঠামো ইত্যাদি নারী অগ্রগতির পথে বড় বাধা। এসব অতিক্রম করার নিরন্তর প্রচেষ্টা চলছে দেশে। সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে নেওয়া হচ্ছে নানা উদ্যোগ। কিন্তু আবহমানকালের প্রথাগত সামাজিক চিত্রটি একেবারে মুছে ফেলা সম্ভব হয়ে উঠছে না। দেশের প্রধানমন্ত্রী নারী, জাতীয় সংসদের স্পিকার নারী, বিরোধীদলীয় নেত্রী নারী। নারীসমাজের উন্নয়নের জন্য এর চেয়ে বড় ইতিবাচক শর্ত আর কী হতে পারে? বাংলাদেশের সংবিধানসহ বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নীতিমালায় নারীর রাজনৈতিক-সামাজিক ক্ষমতায়ন ও অংশগ্রহণের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতীয় জীবনের সব ক্ষেত্রে নারীর সমণ্ডঅধিকারের বিষয়টি সংবিধানে নিশ্চিত করেছেন। নারী তার মেধা ও শ্রম দিয়ে যুগে যুগে সভ্যতার সব অগ্রগতি এবং উন্নয়নে করেছে সমণ্ডঅংশীদারত্ব। আর তাই সারা বিশ্বে বদলে যাচ্ছে নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি। এখন নারীর কাজের মূল্যায়ন হচ্ছে, বৃদ্ধি পাচ্ছে স্বীকৃতি। লিঙ্গসমতা ও নারীর ক্ষমতায়নে বাংলাদেশ এখন রোলমডেল। জেন্ডার রেসপন্সিভ বাজেটের মাধ্যমে নারীর প্রতি বৈষম্য হ্রাস ও সুযোগের সমতা সৃষ্টি। জেন্ডার বাজেটের যথাযথ বাস্তবায়নের মাধ্যমে নারীর রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষমতায়ন, প্রাথমিক ও মাধ্যমিকে জেন্ডার সমতা, শিশু ও মাতৃমৃত্যু হ্রাস, স্বাস্থ্য ও টিকাদানের ক্ষেত্রে ব্যাপক অগ্রগতি অর্জিত হয়েছে। নারীর আর্থসামাজিক অগ্রগতির মাধ্যমে নারীর উন্নয়ন ও ক্ষমতায়ন দৃশ্যমান হয়। এজন্য দরকার নারীর কর্মসংস্থান সৃষ্টি, উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তোলা ও সামাজিক নিরাপত্তার ক্ষেত্রে সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা এবং আর্থিক বরাদ্দ নিশ্চিত করা।
আওয়ামী লীগ সরকারের ১৪ বছরের অর্জন আছে অনেক। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকার ২০২১ সালের রূপকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে নারী ও শিশুদের উন্নয়নে বিভিন্ন উদ্যোগ বাস্তবায়ন করা হয়েছে। এখন লক্ষ্য ২০৩০ সালে এসডিজি অর্জন ও ২০৪১ সালে উন্নত স্মার্ট বাংলাদেশ অর্জন। গত ১৪ বছরে নারী ও শিশুর উন্নয়নে প্রণীত নীতিমালা, আইন ও বিধিমালাগুলোর জন্য সরকার গত ১৪ বছরে নারী ও শিশুর উন্নয়নে বেশ কিছু আইননীতি ও বিধিমালা তৈরি করেছে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি ২০১১; জাতীয় শিশুনীতি ২০১১; শিশুর প্রারম্ভিক যত্ন ও বিকাশের সমন্বিত নীতি ২০১৩; মনোসামাজিক কাউন্সেলিং নীতিমালা ২০১৬ (খসড়া); জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি বাস্তবায়নকল্পে কর্মপরিকল্পনা ২০১৩-১৫; পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন, ২০১০; ডিঅক্সিরাইবোনিউক্লিক অ্যাসিড (ডিএনএ) আইন, ২০১৪; পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) বিধিমালা ২০১৩; বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন, ২০১৭।
দুস্থ নারীদের জন্য রয়েছে নিরাপত্তামূলক ভিজিডি কার্যক্রম। দরিদ্র মায়েদের মাতৃত্বকালীন ভাতা প্রদান, কর্মজীবী ল্যাকটেটিং মাদার (স্তন্যদানকারী মা) সহায়তা, শিক্ষিত বেকার মহিলাদের আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে জাতীয় মহিলা সংস্থার মাধ্যমে দেশের সব কটি জেলার শিক্ষিত বেকার নারীদের কম্পিউটার ও তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিয়ে আসছে। নারী উদ্যোক্তা উন্নয়নে ‘জয়িতা’: দেশের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নারী উদ্যোক্তাদের উৎপাদিত পণ্য ও সেবা বিপণন এবং বাজারজাতকরণের লক্ষ্যে জয়িতার মাধ্যমে একটি নারী উদ্যোক্তাবান্ধব আলাদা প্রতিষ্ঠান পর্যায়ক্রমে দেশব্যাপী গড়ে তোলার প্রয়াস নেওয়া হয়েছে। নারী নির্যাতন প্রতিরোধকল্পে মাল্টিসেক্টরাল প্রোগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ওয়ান-স্টপ ক্রাইসিস সেন্টার (ওসিসি) স্থাপন করা হয়েছে।
স্বাস্থ্যসেবা, পুলিশি ও আইনি সহায়তা, মানসিক ও সামাজিক কাউন্সেলিং, আশ্রয়সেবা এবং ডিএনএ পরীক্ষার সুবিধা ওসিসি থেকে দেওয়া হয়। নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধে ন্যাশনাল হেল্পলাইন সেন্টার, ১০৯ নম্বরে ফোন করে নির্যাতনের শিকার নারী ও শিশু, তাদের পরিবার এবং সংশ্লিষ্ট সবাই প্রয়োজনীয় তথ্য, পরামর্শসহ দেশে বিরাজমান সেবা এবং সহায়তা সম্পর্কে জানতে পারে। কিশোর-কিশোরী ক্লাব, কর্মরত নারী গার্মেন্ট শ্রমিকদের আবাসনের জন্য হোস্টেল নির্মাণ, শিশুদের মানসিক বিকাশের জন্য সাংস্কৃতিক প্রশিক্ষণ প্রদান। পিছিয়ে পড়া শিশুদের জন্য চা বাগান, সিটি করপোরেশনের বস্তি, কেন্দ্রীয় কারাগার, যৌনপল্লীসহ প্রান্তিক শিশুদের জন্য পুরস্কার বিতরণ প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়েছে।
জয় মোবাইল অ্যাপস প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সার্ভিস ইনোভেশন ফান্ড নির্যাতনের শিকার কিংবা নির্যাতনের আশঙ্কা রয়েছে এ রকম নারী ও শিশুদের তাৎক্ষণিকভাবে সহয়তা দেওয়ার জন্য এই অ্যাপ ব্যবহার করা হয়। শিক্ষা ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীর তথ্য-সংক্রান্ত বিভিন্ন ফরমে বাবার পাশাপাশি মা অথবা ‘আইনগত অভিভাবকের’ও স্বীকৃতি দিয়েছে হাইকোর্ট। এর ফলে দীর্ঘ অপেক্ষার পর সমাজে নারী পেল প্রাপ্য স্বীকৃতি। হাইকোর্টের এই রায়ের ফলে অভিভাবকের ঘরে বাবা অথবা মা অথবা আইনগত অভিভাবক- এই তিন বিকল্পের যেকোনো একটি উল্লেখ করেই শিক্ষার্থীরা এখন থেকে ফরম পূরণ করতে পারবে। তবে নারী অধিকারকর্মী ও সংশ্লিষ্ট অন্যান্য বিশিষ্টজন মনে করেন উচ্চ আদালতের এই সিদ্ধান্ত নারীর অধিকার অর্জনের প্রথম ধাপ, এখনো অনেকদূর যেতে হবে।
আসলে মা হচ্ছেন একজন পূর্ণাঙ্গ নারী, যিনি গর্ভধারণ, সন্তানের জন্ম তথা সন্তানকে বড় করে তোলার ক্ষেত্রে জগতের সবচেয়ে উপযুক্ত ব্যক্তি। আন্ডারস্ট্যান্ডিং মাদারস জেনেটিকস নামের এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, মায়ের সঙ্গ, ছোঁয়া, আবেগ শিশুর আইকিউ উন্নত করে। একজন শিশুর বুদ্ধিমত্তানির্ভর করে তার মায়ের জিনের ওপর। গবেষণায় দেখা যায়, শিশুর ইন্টেলিজেন্স কোশেন্ট (আইকিউ) কতটা উন্নত হবে তা নির্ভর করে কন্ডিশনিং জিনের ওপর। এই জিন শিশু তার মায়ের কাছ থেকে পায়। তাই মায়ের একক অভিভাবকত্বের দাবিটিও দীর্ঘদিনের। সুনির্দিষ্ট আইনগত কোনো বিধান না থাকা সত্ত্বেও এতকাল ধরে বাবা-মার পরিচয়বিহীন শিশুরা শিক্ষালাভের অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়ে আসছিল। এ যুগান্তকারী রায়ের সুষ্ঠু বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে সব শিশুর শিক্ষাগ্রহণের অধিকার নিশ্চিত করা সম্ভব হবে এবং অভিভাবকত্বের ক্ষেত্রে বৈষম্য নিরসন হবে। স্বাধীনতার ৫১ বছর পর আদালতের একটি রায়ের মাধ্যমে মায়েরা, বিশেষ করে একক মায়েরা (সিঙ্গেল মাদার) নিজ পরিচয়ে সন্তানকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি করাতে পারবেন। এ রায় ভুক্তভোগী মায়েদের জন্য কতটা স্বস্তিদায়ক হলো, তা শুধু তারাই অনুভব করতে পারবেন। তাদের জন্য সামাজিক এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করাটা খুব কষ্টকর ছিল। এই গ্লানি ও অসম্মানের মধ্য দিয়ে যাদের যেতে হয়নি, তারা বুঝতেই পারবেন না এই একটুখানি পাওয়া তাদের জন্য কতটা বেশি পাওয়া।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও গবেষক