কবি নির্মলেন্দু গুণের সামাজিক দায়বদ্ধতার অংশ কাঁশবন ও কবিতাকুঞ্জ


হীরেন পণ্ডিত: নির্মলেন্দু গুণ স্বাধীনতা, বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ, জাতীয় চেতনা, ইতিহাস ও ঐতিহ্যের ধারক; বোহেমিয়ান জীবনে বিশ্বাসী, গৃহসন্ন্যাসী, মূর্ত প্রেমের আবাহনে নিজেকে আবৃত রাখার এক কবি। কখনো বিপ্লবী, কখনো প্রেমিক। সাধারণ মানুষের জীবনের সপক্ষে তাঁর কণ্ঠ নিরন্তর উচ্চকিত। নানা ব্যঞ্জনে বিস্তৃত, বহুত্ববাদ, সামাজিক দায়বদ্ধতার স্বরূপে চিত্রিত, বিচিত্র বিষয়ে পূর্ণ তাঁর কবিতাভুবন। বিষয়বৈচিত্র্য, স্বতঃস্ফূর্ততা, আবেগের সাথে মানবিকতার যোগ তাঁর কবিতার লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য। এ কারণে সম্ভবত তাঁর কবিতা বহুল পঠিত, জনপ্রিয়তায় শীর্ষে। তাঁর কবিতা শিল্পময়তার অনন্য সম্ভার, যা তাঁকে বাংলা কবিতার অন্যতম প্রধান কবি হিসেবে অভিষিক্ত করেছে এবং তার স্বীকৃতি রাষ্ট্র ও সমাজ দিয়েছে অনেক আগেই।

সামাজিক দায়বদ্ধতা একটি নৈতিক পরিকাঠামো যা অনুযায়ী প্রতিটি ব্যক্তির অন্যান্য ব্যক্তি ও সংগঠনসমূহের সাথে একত্রে কাজ করা উচিত যাতে বৃহত্তর সমাজের লাভ হয়। প্রতিটি ব্যক্তিই অর্থনীতি ও বাস্তুতন্ত্রগুলির মধ্যকার সাম্যের ব্যবস্থা বজায় রাখার জন্য সামাজিকভাবে দায়বদ্ধ। কবি, সাহিত্যিক, বা দার্শনিক বা যেই হোন না কেন মানুষের সামাজিক অবস্থান তাঁর চেতনাকে নির্ধারণ করে। স্বাভাবিকভাবে শিল্পী, কবি-সাহিত্যিকরা যা কিছু করেন তাতে সামাজিক অবস্থানের চিত্রই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। শিল্প শিল্পের জন্য, আনন্দ আর অনুভবের জন্য কোনভাবেই শিল্পী বা কবির সামাজিক দায়ের বিষয়টিকে সক্রিয়ভাবে বিবেচনা করা হয়নি।
নির্মুলেন্দু গুণ বাংলা কবিতায় বহুল আলোচিত, নন্দিত কবি। কবিতায় তিনি বহুবর্ণে শোভিত ও প্রসারিত। মগ্ন সাধকের মতো কবিতায় দীর্ঘ পরিভ্রমণে তিনি নিজেই আজ এক সফল সাধক। বহুবিধ অনুষঙ্গে, বিচিত্র অনুরণনে তাঁর কবিতা ধ্বনিত। ষাটের দশকের ঘটনাবহুল এক অস্থির সময়ের জাতক তিনি। সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় প্রতিবন্ধকতা সে সময়ে এক অসহ্য, বিরূপ পরিবেশ-পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। সাহিত্য, শিল্প, সংস্কৃতির বলয়কে অবরুদ্ধ করে রাখার অপপ্রয়াস মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে।

কবিতায় রাজনীতিই প্রথম আর একজন সচেতন কবির কবিতায় সেই রাজনীতি হয়ে ওঠে বিপুল মানুষের চিন্তা আর কল্পনা বিকাশে সহায়ক শক্তি হিসেবে। কারণ সমাজে কবির অবস্থানটাই তার চেতনাকে আবদ্ধ করে রাখে যদিও তিনি একজন অগ্রসর মানুষ।

নির্মলেন্দু গুণ বাংলাদেশের পাঠকনন্দিত কবি, তাঁর অসংখ্য কবিতা মানুষের মুখে মুখে। নেত্রকোণার বারহাট্টায় জন্ম ২১ জুন ১৯৪৫ সালে, সে হিসেবে তিনি এখন ৭৯তম বসন্তকে সামনে নিয়ে এগিয়ে চলছেন। মা বীণাপাণি দেবী ও বাবা সুখেন্দু প্রকাশ গুণ। কবি এবং চিত্রশিল্পের পাশাপাশি গদ্য এবং ভ্রমণকাহিনীও লিখেছেন। তাঁর লেখায় মূলত প্রেম, শ্রেণী-সংগ্রাম এবং স্বৈরাচার বিরোধিতা প্রকাশ পেয়েছে। ১৯৭০ সালে প্রথম কাব্যগ্রন্থ’ প্রেমাংশুর রক্ত চাই প্রকাশিত হবার পর জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। তাঁর ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে লেখা হুলিয়া কবিতাটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে এবং পরবর্তীতে এর উপর ভিত্তি করে তানভীর মোকাম্মেল একটি পরীক্ষামূলক চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছিলেন। সামাজিক দায়বদ্ধতা নিয়ে তিনি কাজ করেছেন সারা জীবন।

১৯৯১ সালে কবির এমপি হবার ইচ্ছা হয়। তিনি আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চেয়ে বঞ্চিত হন। কিন্তু তিনি দমে যাবার পাত্র নন। স্বতন্ত্র হিসেবেই নির্বাচন করলেন কুমির প্রতীক নিয়ে। নির্বাচনে তিনি জয়ের মুখ দেখলেন না। বিপুল ভোটে হারলেন। ভাগ্য ভালো বাংলা সাহিত্য ও বাংলা কবিতার। যদি তিনি এমপি হয়ে যেতেন তাহলে আইন প্রণয়নের ব্যস্ততার কারণে হয়তো কবিতা লেখার হয়তো খুব একটা সময় পেতেন না।

সামাজিক দায়বদ্ধতার অংশ হিসেবে নির্মলেন্দু গুণ নেত্রকোণার বারহাট্টায় তাঁর নিজ গ্রামের বাড়িতে কাঁশবন বিদ্যানিকেতন স্থাপন করেছেন এবং নেত্রকোণা জেলা শহরে কবিতাকুঞ্জ প্রতিষ্ঠা করেছেন শিক্ষা ও জ্ঞান চর্চাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়ার জন্য। শৈলজা সংগীত বিদ্যালয় নামে সংগীত শিক্ষার একটি প্রতিষ্ঠান করেছেন। পাঠাগার গড়ে তুলেছেন। সামাজিক কাজের অংশ হিসেবে। কবিতাকুঞ্জে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ কবিদের বই সংগ্রহ করেছেন। কাব্যামোদীরা কবিতা নিয়ে গবেষণা করতে পারছেন। বর্তমানে এখানে বিভিন্ন ভাষার কয়েক হাজার কবির কবিতার বই সংগ্রহ করা হয়েছে। শুধু কবিতাকে ঘিরে এক অনন্য আয়োজন রয়েছে এখানে। কবিতা লেখার পাশাপাশি এই কাজগুলোকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ মনে করেন কবি।

মানুষের মুক্তির পথ উন্মোচনে জাগ্রত শিল্পীসমাজ দেশের মানুষের সাথে অভিন্ন বোধ ও সংগ্রামে শামিল হন। গভীর দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে নতুন জীবনবোধে এ বন্ধ্যাত্ব মোচনে জেগে ওঠেন কবি নির্মলেন্দু গুণ। কবিতাকে শিল্পাশ্রিত করে নবচেতনার অনিরুদ্ধ দিগন্তের দ্বার উদঘাটন করেন। এ ক্ষেত্রে তাঁদের কৃতিত্বের বিষয়টি উজ্জ্বতর মহিমায় চিহ্নিত। তিনি এ প্রবহমানতায় এক প্রতিভাদীপ্ত সাহসী সারথি। তিনি নিজে কবিতা লেখার পাশাপাশি সামাজিক দায়বদ্ধতাকেও সমানভাবে দেখেন।

কবি নির্মলেন্দু গুণকে সম্পূর্ণ জানতে হলে যেতে হবে কাঁশবন, কবির গাঁয়ে। গ্রামে ঢুকতেই হাতির-সংবর্ধনা, কবির প্রতিষ্ঠিত স্কুল, প্রবেশমুখে স্যার আইজাক নিউটন ও কাজী নজরুল ইসলামের ভাস্কর্য আপনাদের অভ্যর্থনা জানাবেন, মূল বাড়ি যেন অন্য এক জগত-ঢুকতেই শহীদ মিনার, পাশে উন্মুক্ত মঞ্চ, লাইব্রেরি। চিত্রশালা অজপাড়াগাঁয় শিশুরা ছবি আঁকে ভেবে অবাক হতে পারেন এছাড়াও রয়েছে কবিগুরু ও মধুকবির ভাস্কর্য।

কেউ কাঁশবনে গিয়ে ভাবতে পারেন, হাতিরপুল বাজারে ফুটপাথের চা খাওয়ার ছবি বা কামরাঙ্গির চরে নয়াগাঁও নিজ আবাসস্থল বুড়িগঙ্গা দেখে যাঁরা পুলকিত, তাঁরা কি সবাই বিশ্বাস করবেন কবি নির্মলেন্দু গুণ এত কিছু করতে পারেন, এটাই কবির সামাজিক দায়বদ্ধতার অংশ।

মা, মাটি, মাতৃভূমিকে ভালোবাসেন নিজের চেয়েও বেশি। তিনি দেশপ্রেমের যে-দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন, তা সত্যিই বিরল। ১৯৬৬ এর ছয় দফা আন্দোলনের সঙ্গে আত্মিকভাবে জড়িত ছিলেন তিনি; এরপর বাদ পড়েনি স্বাধীনতার পূর্বের ও পরের কোনো বিপর্যয়, যতবার এ রাষ্ট্র বিপথগামী হয়েছে-কলম ধরেছেন তিনি, লিখেছেন একের পর এক শ্রেণীসংগ্রাম এবং স্বৈরাচার-বিরোধী কবিতা। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে প্রতিকূল রাজনৈতিক পরিবেশে যে-ক’জন কবি ও লেখক সোচ্চার থেকেছেন, তিনি ছিলেন অগ্রগণ্য।

অথচ এই কবিকে প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের জন্য অনেকের কাছে ধর্না দিতে হয়েছে, কিন্তু কেউ রাজি হননি। আসল সত্য হলো তখন আধুনিক কবিতার বইয়ের বাজার একদম কম ছিলো। কিন্তু পরে খান ব্রাদার্স নিজ থেকে প্রকাশ করতে আগ্রহী হওয়ায় তিনি খুশি হন। এরপর আর পেছনে তাকাতে হয়নি। উল্লেখ্য, নেত্রকোণা থেকে প্রকাশিত ‘উত্তর আকাশ’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয় তার প্রথম কবিতা ‘নতুন কাণ্ডারী’।

তাঁর প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা শতাধিক তার মধ্যে অন্যতম ‘প্রেমাংশুর রক্ত চাই’, ‘কবিতা, অমীমাংসিত রমণী’, ‘দীর্ঘ দিবস দীর্ঘ রজনী’, ‘বাংলার মাটি বাংলার জল’, ‘তার আগে চাই সমাজতন্ত্র’, ‘দূর হ দুঃশাসন’, ‘চিরকালের বাঁশি’, ‘দুঃখ করো না, বাঁচো’, ‘আনন্দ উদ্যান’, ‘পঞ্চাশ সহস বর্ষ’, ‘প্রিয় নারী হারানো কবিতা’, ইত্যাদি।

‘আপন দলের মানুষ’ শিরোনামে রয়েছে তার একটি গল্পগ্রন্থ। এ ছাড়া লিখেছেন ‘সোনার কুঠার’ নামের একটি ছড়াগ্রন্থ। ‘আমার ছেলেবেলা’, ‘আমার কণ্ঠস্বর’ ও ‘আত্মকথা-৭১’ শিরোনামে রয়েছে তিনটি আত্মজীবনী।

কবিতার জন্য নিজের ইচ্ছাধীন এক জীবন কাটান তিনি। কবিতা বা শিল্প কার জন্য, মানুষের জন্য শিল্প নাকি শিল্পের জন্য শিল্প, শিল্প আগে না জীবন আগে? শিল্পের জন্য মানুষের জীবন বিসর্জন দেওয়া লোভের প্রকাশ। এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজেন অত্যন্ত সাবলীলভাবে।

কবিতা ও অমরত্বের বাসনা থেকেই লেখা তাও তাঁর সরল উক্তি থেকে আমরা পাই। নশ্বর জীবনকে একটা অবিনশ্বর রূপ দেওয়ার প্রয়াস সব সময়েই থাকে। জীবনের মূল তাড়না এটাই। মানুষ সামাজিক কর্ম, জনহিতকর যত কাজ করে, সবই তার গ্রহণযোগ্যতাকে বৃদ্ধির মানসেই করে।

পরাধীন চিত্ত নিয়ে বড় হওয়ার চেয়ে স্বাধীন চিত্ত নিয়ে ছোট থাকাটাকেই বেশি পছন্দ করেন কবি। কবি মুক্তিযুদ্ধ করেছেন। স্বাধীনতা ছিল তাঁর পরম আকাক্সিক্ষত বিষয়। আদতে তিনি স্বাধীনতাকামী। স্বাধীনতা তাঁর আরাধ্য। তিনি জন্মের প্রয়োজনে বড় হয়েছেন, আবার মৃত্যুর প্রয়োজনে ছোট হচ্ছেন। আরো অনেক কিছু যে দেয়ার আছে আপনার, আমাদের প্রিয় বাংলাদেশকে।

স্বাধীনতা পুরস্কারপ্রাপ্ত বরেণ্য কবি নির্মলেন্দু গুণের জন্মস্থান নেত্রকোণা জেলা শহরের মালনী এলাকায় মগড়া নদীর তীরে প্রতিষ্ঠিত ‘কবিতাকুঞ্জ’ শেখ হাসিনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অঙ্গ-প্রতিষ্ঠান হিসেবে অনুমোদন পেয়েছে। শেখ হাসিনা বিশ্ববিদ্যলয়ের অঙ্গ-প্রতিষ্ঠান হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব দেওয়া হয় বিশ্ববিদ্যলয় কর্তৃপক্ষকে। এ প্রস্তাব এবং বাংলা সাহিত্য ও ইংরেজি সাহিত্যের পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়টিতে তুলনামূলক সাহিত্য ও বিশ্বকাব্যকে একটি অন্যতম বিষয় হিসেবে চালু করার বিবেচনায় প্রস্তাবটি অনুমোদন হয়।

হীরেন পণ্ডিত : প্রাবন্ধিক, গবেষক ও কলামিস্ট।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *