হীরেন পণ্ডিত: কোলকাতা থেকে শিলিগুড়ি বাসে এক লম্বা জার্নি। বাসস্ট্যান্ড থেকে বাসটা ছাড়ার সময়েই ঘন কুয়াশা। শীতকালে ঘন কুয়াশায় বেশিদূর দেখা যায় না। বাস থেকে নেমেই ভাবলাম কি করে দার্জিলিং যাওয়া যায়। অনেকেই জানালেন জীপ গাড়ি হলেই ভালো, পাহাড়ি রাস্তা। একটা জীপে উঠে বসি। একজন লোক একজন সুন্দরী মহিলাকে তুলে দিল। তার সুটকেশ উপরে তুলে দিল। আমার পাশের সিট খালি। ড্রাইভার খুব সম্মান দিয়ে তাকে আমার পাশে বসিয়ে দিল। নেপালী বা পাহাড়ি গোর্খা বলে মনে হয়। সুগন্ধীর মন মাতাল হয়ে উঠার অবস্থা। উনি আমাকে দেখলেন তারপর সিটে বসলেন। আকা বাকা পাহাড়ি রাস্তায় সুন্দরী নারী দেখে পাহাড়ি পথ পাড়ি দিয়ে যাচ্ছি ভালোই লাগছিল। একটু পরে নারী আমার উল্টোদিকে বসল। চোখাচোখি হল। একটু হাসল। আমি ইতস্তত বোধ করলাম। ভাবলাম এই মধ্য বয়সে কি ভাবছি এসব। আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন দার্জিলিং। আমি হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লাম।
জীপ চলতে লাগলো কালিমপং পাড়ি দিয়ে উপরে উঠছি। ঠান্ডায় হাত পা জমে যাচ্ছে। এর ভিতর নারী হয়তো অনেক কিছু ভাবছে তার পরিবার, ব্যবসা এসব। আমিও আমার রাজ্যে ডুবে থাকার চেষ্ট করলাম। সময় কিভাবে কেটে গেল বুঝতেই পারলাম না। জীপ দার্জিলিং বাস ষ্টান্ডে এসে দাড়াল। জীপ থেকে নামার সময় দৃষ্টি বিনিময় করে দু’জন নিজ নিজ গন্তব্যে চলে গেলাম। আমি নেমে কাছেই একটা হোটেলে উঠলাম প্রথমে ভাবলাম হোটেল রকবিল না পরে সিদ্ধান্ত পাল্টিয়ে হোটেল পূর্ণিমায় উঠলাম।
দার্জিলিং ভ্রমণের এক বিচিত্র অভিজ্ঞতা। হোটেলের সাথে অনেক জীপের যোগাযোগ আছে আপনি ইচ্ছে করলে সেভেন পয়েন্টস দেখতে পাবেন বা ফাইভ পয়েন্টস। এর মানে হলো আপনাকে সাতটি বা পাঁচটি দর্শনীয় স্থান দেখাবে, একটি নির্দিষ্ট চার্জ বা খরচের বিনিময়ে। আপনি মিরিক যেতে পারেন বেড়ানোর জন্য প্রাকৃতিক সৌন্দর্য কাকে বলে আপনি গেলেই বুঝতে পারবেন। কেন এই মিরিকের লেক বিখ্যাত।
টাইগার হিল ভ্রমণ দার্জিলিং ভ্রমণের অন্যতম আকর্ষণ। আপনাকে রাত তিনটার সময় উঠে রওয়ানা দিতে হবে টাইগার হিলের সুর্যোদয় দেখার জন্য। বিশে^র ভ্রমণ পিপাসুদের কাছে এটি একটি বড় আকর্ষণ। টাইগার হিল দার্জিলিং ভ্রমণের দর্শনার্থীদের প্রধান আকর্ষণ যেখানে আপনি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় দশ হাজার ফুট উঁচুতে অবস্থিত হিমালয়ের বরফ দিয়ে দেখতে পাবেন সূর্যোদয়ের ঝিকিমিকি হাসি। যা দার্জিলিং শহর থেকে মাত্র ১১ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত।
দার্জিলিংয়ের অন্যতম আকর্ষণ টাইগার হিলে বন্ধ হয়েছে বিনামূল্যের পরিষেবা। এখন থেকে ৫০ টাকা প্রবেশমূল্য দিতে হচ্ছে। ভোরের অসাধারণ সূর্যোদয় এবং কাঞ্চনজঙ্ঘার অসাধারণ সৌন্দর্য দেখতে টাইগার হিল অনেক পর্যটকই যান। আবার ভাগ্য ভালো থাকলে এবং আকাশ পরিষ্কার থাকলে দেখা মিলতে পারে এভারেস্ট-এরও।
স্যাংচুয়ারি অঞ্চলে রাজস্ব বাড়ানোর জন্যই এই প্রবেশমূল্য বসানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এই স্যাংচুয়ারি অঞ্চলে যে সব গ্রাম রয়েছে সে সব গ্রামের ফরেস্ট ম্যানেজমেন্ট কমিটির কাছে যাচ্ছে প্রবেশমূল্যের ৪০%। এই ৪০% অর্থ ওই অঞ্চলের গ্রামবাসীদের উন্নতির কাজে লাগানো হচ্ছে। ডিভিশনাল ফরেস্ট বিভাগ জানিয়েছে এই উদ্যোগের ফলে ওই অঞ্চলের আরও উন্নতি হবে, গ্রামগুলিরও উন্নতি হবে।
টাইগার হিল পর্যটকদের কাছে এক অন্যতম আকর্ষণ। প্রতি বছর বহু পর্যটক এখানে আসেন। দার্জিলিং শহর থেকেই কাঞ্চনজঙ্ঘার দৃশ্য দেখা যায়। তবে টাইগার হিল থেকে এর দিক পরিবর্তন হয়ে একদম সামনে থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘার ওপরে সূর্যের আলোর প্রতিফলন চাক্ষুষ করা যায়। যা অপরূপ বা অপূর্বই বলা যায়।
দার্জিলিং জায়গাটি প্রাচীন গোর্খা রাজধানী হিসেবে পরিচিত ছিল। কিন্তু পরবর্তীতে দার্জিলিং, উপহার হিসেবে ব্রিটিশদের দিয়েছিলেন সিকিমের মহারাজা। হিমালয়ের পাদদেশে অবস্থিত সুন্দর এই শহরে প্রায় পুরো বছর জুড়ে ঠান্ডা থাকে যা মেঘের স্বর্গ রাজ্য হিসেবে পরিচিত। চা, ভূ-প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং হিমালয় রেলওয়ের জন্য বিখ্যাত এই স্থানটি ভ্রমণপিপাসুদের কাছে একটি অন্যতম গন্তব্যস্থল। ভৌগোলিক পরিবেশ ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য সবমিলিয়ে পর্যটকদের সবচেয়ে পছন্দের জায়গা এটি। সব মিলিয়ে বেড়ানোর জন্য এখানে প্রায় ১৭ টি স্থান রয়েছে। যেহেতু ভ্রমণের উদ্দেশ্যে আপনি দার্জিলিং যাবেন তাই যাবার পূর্বে সেখানের জায়গা সম্পর্কে কিছুটা ধারণা নিয়ে যাওয়াই উত্তম।
দার্জিলিংয়ে যাবেন আর টয় ট্রেনে চাপবেন না এমনটা হতেই পারে না। ভারতীয় উপ-মহাদেশের যেকোনো প্রান্তে গেলে অবশ্যই একটি প্রাচীন শিব মন্দির খুঁজে পাবেন। ধীরধাম মন্দিরটি ‘টয় ট্রেন’ রেলওয়ে স্টেশনের ঠিক উপরে। এই মন্দিরটি খুবই সুন্দর। বর্ণময় মন্দিরের এই ভবন সনাতন ধর্মালম্বীদের দেবতা শিবের নিবাসস্থল এবং এটি দার্জিলিং শহরের সবচেয়ে প্রাচীনতম মন্দির। তাই, অবশ্যই এই জায়গাটি আপনাকে দেবে মনোরম ও প্রশান্তিময় পরিবেশ।
এপ্রিল থেকে জুন ও অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর মাসের সময়টাতে এখানের আবহাওয়া সবচেয়ে বেশি ভালো থাকে যা আপনাকে দেবে প্রশান্তিময় এক অপরূপ পরিবেশ। তাই, যারা ভ্রমণপিপাসু এবং ভ্রমণের জন্য দার্জিলিংয়ে যাওয়ার কথা ভাবছেন তাদের জন্য সেরা সময় হবে এটি। সেইসাথে বসন্ত ও শরৎকাল অর্থাৎ মার্চ থেকে এপ্রিল মাসের মধ্যেও সেখানে ভ্রমণের উদ্দেশ্যে যেতে পারেন। কারণ, বসন্ত ও শরৎকাল দার্জিলিং ভ্রমণের শ্রেষ্ঠ সময় হিসেবে বাছাই করা হয়েছে পর্যটকদের মতামতের ওপর ভিত্তি করে।
দার্জিলিং শহর পেরিয়ে খুব কাছে আর একটি শহর যার নাম হচ্ছে কাঞ্চনজঙ্ঘা। যেখানে থেকে দেখা যায় প্রায় ৮ হাজার তিনশত প্রচুর ফুট উঁচু বরফে ঢেকে যাওয়া হিমালয় পর্বতমালা।
বাংলাদেশ থেকে দর্শনার্থীরা দার্জিলিং যেতে পারেন সড়ক পথ, আকাশপথ। এই দুইটি উপায় অবলম্বন করে বাংলাদেশ দর্শনার্থীরা দার্জিলিং ভ্রমণ করতে পারেন। শিলিগুড়ি থেকে জিপ গাড়ির মাধ্যমে মাত্র আড়াই ঘণ্টার ব্যবধানে আপনি পৌঁছে যাবেন কাঙ্ক্ষিত দার্জিলিং শহরে।