ভালোবাসার এক অপূর্ব নিদর্শন তাজমহল


হীরেন পণ্ডিত: হঠাৎ করেই দিল্লী যাত্রা, আমন্ত্রণ এশিয়া প্যাসিফিক ব্রডকাস্টিং ইউনিয়ন এর। ৫৯তম বার্ষিক সভা এবং মাস্টারক্লাস জেন্ডার মেইনস্ট্রিমিং ইন মিডিয়া পলিসি এন্ড প্যানিং কর্মশালায় অংশগ্রহণের আমন্ত্রণ। অফিসের প্রয়োজনীয় নমিনেশন ও প্রয়োজনীয় কাগজপত্রসহ ভিসার জন্য জমা দেওয়া এবং পরবর্তীতে আয়োজনকারী ও অফিসের বিশেষ উদ্যোগে খুব অল্প সময়ে ভিসা পাবার কারণে কোন রকম সমস্য ছাড়াই ভিসাপ্রাপ্তি এবং নির্দিষ্ট দিনে ভ্রমণ।
এক সপ্তাহের কর্মসূচিতে শুধু সেশন আর সেশন যাক আয়োজকদের একদিন মনে হলো সবাইকে তাজমহল দেখাবে ৮৫ টি দেশের ৩৬০ জন ডেলিগেট এক বিশাল আয়োজন। সবাইকে নিয়ে আগ্রার তাজমহন দেখাবে সবাইকে। ভোর ৬টায় রওয়ানা দিতে হবে ডিসেম্বরে প্রথম দিল্লী ১৩ ডিগ্রী তাপমাত্রার মধ্যে বিশাল সাইজের ৯টি বাস আসলো পর্যটর্নে প্রত্যক গাড়িতে একজন স্থানীয় গাইড দেয়া হলো। দিল্লী থেকে আগ্রার দূরত্ব ২৫৩ কিলোমিটার। যমুনা এক্সপ্রেস হাইওয়ে দিয়ে এগিয়ে বাস প্রায় ৪ ঘন্টায় আগ্রা পৌঁছানোর পর হোটেল তাজ এ দুপুরের খাবার সেরে আগ্রা শহর কর্তৃপক্ষের ছোট গাড়ি দিয়ে প্রটোকল অফিসারের মাধ্যমে তাজহলের কাজে যাই। বলে রাখা ভালো, ৩৬০ জন বিদেশী ডেলিগেট থাকার কারণে দিল্লী পুলিশ যথাযথ নিরাপত্তা ও প্রটোকল দিয়ে ও সামনে পিছনে পুলিশের গাড়ি দিয়ে নিরাপত্তা প্রদান করে।
তাজমহলে ঢুকতে গেলেই যদি সার্কদেশের নাগরিকদের জন্য ৫৫০ রুপি আর মমতাজ ও শাহজাহানের কবর দেখার জন্য আরো ২৪০ রুপি জমা দিতে হবে সার্কদেশের বাইরের পর্যটকদেও জন্য প্রায় ১৫০০ রুপি। আমাদের ব্রিফ করার জন্য মিনিস্ট্রি অব কালচার এবং মিনিস্ট্রি অব ট্যুরিজমের প্রতিনিধি সব সময় ইতিহাস এবং প্রতিটি কাজের জন্য বর্ণনা করেছেন উপস্থিত ডেলিগেটদের সাথে। তবে ভারত সরকারের ডেলিগেট হিসেবে আমাদের কোনরকম চার্জ না দিয়ে তাজমহল দেখার সুযোগ একটি গৌরবের বিষয় ছিলো।
আগ্রায় যমুনা নদীর তীরে অসামান্য সুন্দর এই সৌধটি তৈরি করা হয়েছিল সপ্তদশ শতাব্দীতে। মোগল সম্রাট শাহজাহান তার মৃত স্ত্রী মমতাজের স্মৃতি ধরে রাখতে তাজমহল তৈরি করেছিলেন। ইট, লাল রংয়ের পাথর এবং সাদা মার্বেলের তৈরি এই সৌধটি জুড়ে সূ² কারুকার্য আর শিল্পকলা সারা পৃথিবীর মানুষকে মুগ্ধ করেছে। সম্রাট শাহজাহান অনেকসময় যমুনা নদী দিয়ে নৌকায় করে তাজমহলের আসতেন। সিঁড়িবাধা একটি ঘাটে নেমে তাজমহলে ঢুকতেন তিনি।
তাজমহলের নিচে ভূর্গভস্থ ঐ কক্ষগুলো তৈরি করা হয়েছিলো তাহখানার অংশ হিসেবে। মোগলরা গরমের মাসগুলোতে শরীর শীতল রাখতে এমন ভূর্গভস্থ কক্ষ তৈরি করতো। এটা নিশ্চিত যে সম্রাট যখন এই সৌধে আসতেন তখন এসব প্রশস্ত, সুন্দর এবং শীতল কক্ষগুলো ছিলো তার সহযোগীদের এবং তার নারীদের আর্দশ বিশ্রামের জায়গা।
ভারতীয় প্রত্নতত্ত্ব সংরক্ষকগণ ২০ বছর আগে তাজমহলের ভূগর্ভস্থ একটি অংশে ঢুকেছিলেন। সেখানে গিয়ে চমৎকার কারুকার্যে মোড়া একটি করিডোরের সন্ধান পেয়েছিলেন। ঐ করিডোর দিয়ে প্রশস্ত একটি চত্বরে যেতে হয়। এ থেকে পরিস্কার সোঝা যায় সম্রাট এই করিডোর গিয়ে ঢুকতেন। দিল্লীতে ইতিহাসবিদ রানা সাফাভি, যিনি আগ্রায় বড় হয়েছেন তিনি বলেন ১৯৭৮ সালে এক বন্যার আগ পর্যন্ত তাজমহলের ভূগর্ভস্থ ঐ অংশে পর্যটকরা যেতে পারতেন। একবার বন্যার পানি তাজমহলের ভেতর ঢুকে গিয়েছিল, পানি নামার পর মাটির নিচের ঐ ঘরগুলোর মেঝেতে পলির আস্তরণ পড়েছিল। দেয়ালে, মেঝেতে ফাটল দেখা দিয়েছিল। তারপরই কর্তৃপক্ষ জনসাধারণের জন্য ঘরগুলোতে ঢোকা বন্ধ করে দেয়। ওগুলোর ভেতর কিছুই নেই।
অনেক পুরনো সৌধের মত তাজমহলকে ঘিরেও অনেক গল্প, জনশ্রæতি রয়েছে। যেমন, কথিত রয়েছে যে শাহজাহান মূল তাজমহলের ঠিক উল্টোদিকে একটি “কালোরঙের তাজমহল” বানাতে চেয়েছিলেন। এমন বিশ্বাস রয়েছে তাজমহলের স্থপতি ছিলেন একজন ইউরোপীয়। অনেক পশ্চিমা বুদ্ধিজীবী বিভিন্ন সময় বলেছেন যে মুসলিম সমাজে নারীদের যে নিচু অবস্থান ছিল তাতে এটা অসম্ভব যে শাহজাহান তার মৃত স্ত্রীর স্মৃতির প্রতি সম্মান দেখাতে তাজমহল তৈরি করেছিলেন।
তাজমহল নিয়ে জনমনে কৌতূহলের শেষ নেই। তাজমহলকে সত্যিকারের ভালোবাসার এক প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। যমুনা নদীর তীরে অসামান্য সুন্দর এই সৌধটি তৈরি হয়েছিল সপ্তদশ শতাব্দীতে। মোগল স¤্রাট শাহজাহান তার মৃত স্ত্রী মমতাজের স্মৃতি ধরে রাখতে তাজমহল তৈরি করেছিলেন। ১৯৮২ সালে তাজমহলকে বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ ঘোষণা করে ইউনেস্কো। তাজমহল শুধু ভারত নয়, সারা বিশ্বের মধ্যেই পর্যটনের অন্যতম প্রধান একটি আকর্ষণ।
ভারতীয়, ফরাসি ও ইসলামিক শৈলীর স্থাপত্যের সংমিশ্রণে নির্মাণ করা হয় তাজমহল। তাজমহলের স্থপতির নাম আহমেদ লাহৌরি। তাজমহলে নির্মাণকাজে নিযুক্ত ছিলেন প্রায় ২০ হাজার শ্রমিক। টানা ২২ বছর ধরে তারা সবাই অক্লান্ত পরিশ্রম করে নির্মাণ করেন এই স্মৃতিস্তম্ভ¢। তাজমহল নির্মাণে খরচ হয় প্রায় ৩২০ মিলিয়ন রুপি। তাজমহলে ব্যবহৃত মার্বেল পাথর রাজস্থান, তিব্বত, আফগানিস্তান ও চিন থেকে আনা হয়েছিল। দিনের বিভিন্ন সময় তাজমহলকে ভিন্ন রঙে দেখা যায়। অনেকের ধারণা, এই পরিবর্তিত রংগুলো নারীর পরিবর্তনশীল মেজাজকে চিত্রিত করে। তাজমহল বিশ্বের সেরা বিস্ময়গুলোর মধ্যে অন্যতম। এটি একটি ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট হিসেবে চিহ্নিত। তাজমহল প্রাঙ্গনে একটি মসজিদ আছে। তাজমহল শুক্রবারে বন্ধ থাকলেও নামাজ পড়তে যাওয়া ব্যক্তিদের তাজমহলের ভেতরে অনুমতি দেওয়া হয়। ১৯ শতকের শেষের দিকে তাজমহল ব্রিটিশ সৈন্যদের দ্বারা বিকৃত হয়ে গিয়েছিল। স্মৃতিস্তম্ভের দেয়াল থেকে মূল্যবান পাথর বের করা হয়েছিল। তাজমহলের ৪টি মিনার একটু বাইরে তৈরি করা হয়েছে। যাতে মিনারগুলো পড়ে গেলেও মূল কাঠামোতে আঘাত লাগবে না।
তাজমহলকে দূষণ থেকে রক্ষা করতে অনেক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। আপনাকে জুতোর ওপর কাপড়ের বানানো বিশেষ জুতা পায়ে প্রবেশ করতে হবে। ভেতরে ছবি তোলা নিষেধ সারিবদ্ধভাবে মমতাজ বেগমের ও শাহজাহানের কবর জিয়ারত করতে হবে। আকারে শাহজাহনের কবরের চেয়ে মমতাজ বেগমের কবর একটু বড়। তবে নিরপত্তা ব্যবস্থা খুব চমৎকার। তবে সম্রাট শাহজাহনের ভালোবাসার নিদর্শন আজো দৃশ্যমান সারা পৃথিবীর মানুষের কাছে, তাজমহল দাঁড়িয়ে আছে বিশে^র সপ্তম আশ্চর্যের একটি হয়ে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *