হীরেন পণ্ডিত: সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্ট হ্যাক করা যাকে বলা হয় কম্পোমাইজ হয়ে যাওয়া অথবা নারীদের নামে ভুয়া এ্যাকাউন্ট তৈরি করা। যেসব নারীরা ফেসবুক বা অন্য মাধ্যমে অনলাইন ব্যবসার সঙ্গে জড়িত তাদের আইডির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে পেইজের নিয়ন্ত্রণ নেওয়া; এ ধরনের অপরাধ বেশি হয়। এছাড়াও সাইবার বুলিং, অনাকাক্সিক্ষত কনটেন্ট ছড়িয়ে দেওয়ার মতো অপরাধের শিকারও হন নারীরা। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোতে এখন নানা ধরনের বিড়ম্বনার শিকার হচ্ছেন নেটিজেনরা। ফেসবুক, ম্যাসেঞ্জার, টুইটার, ভাইবার, ইউটিউব, হোয়াটসঅ্যাপ, ইমো ইত্যাদির মাধ্যমে তারা সাইবার অপরাধীদের শিকারে পরিণত হচ্ছেন। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে সাইবার বুলিং। নারীরা ও শিশুরা এর প্রধান শিকার। ভার্চুয়াল প্ল্যাটফরমে কারো ব্যক্তিগত দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে হেয় প্রতিপন্ন করা, ভয় দেখানো বা মানসিক নির্যাতন বা অন্যায় কোনো কিছুতে প্রলুব্ধ করা। কিশোর-কিশোরীরাই প্রথম দিকে এ ধরনের হয়রানির শিকার হচ্ছিল। এখন মধ্যবয়সীরাও এ ফাঁদে পা দিচ্ছেন।
প্রতি ১২ সেকেন্ডে আমাদের দশে ১টি সোশ্যাল মিডিয়া আইডি খোলা হয় ফেসবুক, টুইটার, হোয়াটস অ্যাপ, ইনস্টাগ্রাম, টেলিগ্রামের মতো প্ল্যাটফর্মগুলোতে এসব আইডি খোলা হয়। এখন দেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রায় ১২ কোটি এর মধ্যে প্রায় ১১ কোটি মোবাইল ফোনে আর ১ কোটি ব্রডব্যান্ড ও পিএসটিএনএ। আর মোবাইল সিম ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রায় ১৭ কোটি ৮০ হাজারেরও বেশি (তথ্য বিটিআরসি)। তবে সূত্র হচ্ছে যেখানেই উন্নয়ন হবে সেখানেই বিচ্যুতি ঘটবে। ডিজিটাল মাধ্যমে সংঘটিত অপরাধের একটি বড় অংশ এখন হচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়াতে।
বাংলাদেশের সোশ্যাল মিডিয়ায় ও অনলাইনে নারীদের এভাবে ধর্ষণের হুমকি দেয়া, আপত্তিকর ভিডিও ভাইরাল করার হুমকি, আক্রমণাত্মক বা অপমানজনক মন্তব্য করা বা কুরুচিপূর্ণ প্রস্তাব দেয়ার নজির হরহামেশাই শোনা যায়। ডিএমপির অপরাধ তথ্য বিশ্নেষণ করে দেখা যায়, নগরীতে ধর্ষণ, শিশু নির্যাতন ও বিভিন্ন ঘটনায় আক্রান্ত হওয়ার সংখ্যাও বাড়ছে। রাজধানীতে উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে সাইবার অপরাধ। রাজধানীর সাইবার অপরাধের শিকার ৭০ ভাগই নারী। আক্রান্তদের বেশির ভাগের বয়সই ১৮-২৫ বছরের মধ্যে। সাইবার অপরাধের শিকার তরুণীরাই বেশি, তরুণ-তরুণী থেকে শুরু করে বিভিন্ন বয়সের মানুষ প্রতিদিনই সাইবার অপরাধে আক্রান্ত হচ্ছেন। ফেসবুক, টুইটার, ইনস্টাগ্রাম, গুগল, স্কাইপিতে ভুয়া আইডি খুলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ বিভিন্ন অনলাইন পোর্টাল, বøগে মিথ্যা মানহানিকর তথ্য প্রচার, বিভিন্ন অ্যাপসে অশ্নীল ছবি, ভিডিও ও ম্যাসেজ পাঠিয়ে উত্ত্যক্ত করছে সাইবার অপরাধীরা। ফিশিংয়ের মাধ্যমে অন্যের আইডি হ্যাক করে প্রতারণাও করা হচ্ছে।
অনেকে সাবলীল ও বন্ধুত্বপূর্ণ ব্যবহারের জন্য জনপ্রিয় মুখ হিসেবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাদের পরিচিত বন্ধুও থাকে অনেক। মেয়েদের গ্রæপেরও সক্রিয় সদস্য। তাদের ক্ষেত্রে দেখা যায় বন্ধুরাই তাদের নিয়ে নানা গুজব ছড়ায়। অনেকের নামে ফেক অ্যাকাউন্ট খুলে চ্যাট করে চ্যাট হিস্ট্রির স্ক্রিনশটও বিভিন্ন গ্রæপে ছড়িয়ে দেয় এর ফলে স্কুল কলেজে যাওয়া বন্ধ হয়ে যায় অনেকের। ইনবক্সে আসতে থাকে অশ্লীল সব বার্তা। মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে নারীরা বা স্কুল কলেজের ছাত্রীরা। কাউকে বিশ্বাস করাতে পারে না মেসেজগুলো তাদের নয়।
এমন অনেক ঘটনাই প্রতিদিন ও প্রতিনিয়ত ঘটছে আমাদের চারপাশে। সম্মান হারাচ্ছে নির্দোষ মানুষ। ব্যবসায়িক ও সামাজিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছেন অনেকে। একটা সময় ছিল, যখন তাঁরা এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারতেন না। কিন্তু সময় বদলেছে। এখন সাইবার বুলিজমে আক্রান্ত হলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া যায়। নিরাপত্তার স্বার্থে আপনি আক্রমণের শিকার হয়েছেন, এর সপক্ষে যথাযথ প্রমাণ সংগ্রহ এবং সংরক্ষণ করতে হবে। বুলিংয়ের শিকার যেহেতু নারীরা বেশি হন এবং তাঁরা তাঁদের সমস্যাগুলো এখনো পরিবারের সঙ্গে শেয়ার করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন না, তাই বুলিংয়ের শিকার হলে অবশ্যই একজন বন্ধু, আত্মীয়, ভাই বা বোনকে জানাতে হবে।
বাংলাদেশে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীসহ ফেসবুক ব্যবহারকারীদের একটি বড় অংশ সাইবার বুলিংয়ের শিকার। তথ্য বলছে দেশের ৪৯ শতাংশ স্কুলপড়ুয়া শিক্ষার্থী সাইবার বুলিংয়ের নিয়মিত শিকার। ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের হিসাব মতে, দেশের তিন-চতুর্থাংশ নারীই সাইবার বুলিংয়ের শিকার। তবে এ বিষয়টি অপ্রকাশিতই থেকে যায়। মাত্র ২৬ শতাংশ অনলাইনে নির্যাতনের বিষয়টি প্রকাশ করে অভিযোগ দায়ের করেন। বাকিরা ভয়ে থাকেন অভিযোগ করলেই তাদের সামাজিকভাবে হেয়প্রতিপন্ন হতে হবে। সাইবার বুলিং ছাড়াও মোবাইল ফোন বা ই-মেইলেও এ ধরনের নির্যাতনের ঘটনা অহরহ ঘটছে। এসবে ফলে নারীদের মধ্যে প্রচÐ হতাশা, পড়াশোনায় অমনোযোগিতা, অনিদ্রা ইত্যাদি নানা সমস্যার সৃষ্টি হয়। এমনকি আত্মহননের ঘটনাও ঘটে থাকে।
সাইবার বুলিংয়ে চুপ থাকার নীতিই বড় ক্ষতির অন্যতম কারণ। পরিবারের কথা ভেবে কিংবা সম্মান হারানোর ভয়ে অনেকেই সব ‘চুপচাপ’ সয়ে যান কিংবা চেপে যান। অপরাধীরা এর ফলে আরো বেশি সুযোগ নেয়। তারা আর্থিক সুবিধা আদায় করতে করতে একসময় ভিকটিমকে যৌন নির্যাতনের ফাঁদেও ফেলে। ইন্টারনেটের এই সময়ে এসে সাইবার আক্রমণ জটিল এক মনস্তাত্তি¡ক উপদ্রব। একজন ব্যক্তিকে সুনির্দিষ্টভাবে সবার সামনে দোষারোপ বা খারাপ ভাষায় আক্রমণ করা। আবার একজনের ছবি বা ভিডিও বিকৃতি করে অনলাইনে তুলে ধরাও বুলিংয়ের মধ্যে পড়ে। এটি একধরনের সাইবার অপরাধ। তবে এসব অপরাধ দমনে আইনও রয়েছে দেশে। দরকার শুধু সচেতন থাকা। যদি বিষয়টি পারিবারিক গÐির বাইরে চলে যায়। তবে আইনের আশ্রয় নিতেই হবে। এক্ষেত্রে পুলিশি সহযোগিতা এড়িয়ে চললেই বরং বিপদ। কিছু ধাপ অনুসরণ করলে এই কঠিন কাজই খুব সহজ হয়ে যায়। এর মধ্যে প্রথম কাজ হচ্ছে থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করা। সঙ্গে রাখতে হবে হয়রানির প্রমাণও। স্ক্রিন শট কিংবা মেসেজ। হয়রানির শিকার যে কেউ এখন ৯৯৯ অথবা পুলিশের ফেসবুকে পেজে নক করলেও সহায়তা পেতে পারেন। এ ছাড়া মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের হটলাইন ১০৯২১ নম্বরে গোপনীয়তা রক্ষা করে এ ধরনের সমস্যার সমাধান করা হয়। সরাসরি বিটিআরসি’র ফোনে ও ই-মেইলেও অভিযোগ করা যায়। বিড়ম্বনার শিকার যে অনলাইন জগতে সেই জগতেই এর সুরাহা সন্ধানেরও পথের দিশা পাওয়া যাচ্ছে।
ইন্টেলিজেন্স কোম্পানি সেনসিটির প্রতিবেদনে জানা যায়, ২০২০ সালে প্রায় ১,০৪,৮৫২ নারীর ছবির অপব্যবহার করে ডিজিটাল কায়দায় তাদের বিবস্ত্র করা হয়েছে। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই) ব্যবহার করে এসব ছবি থেকে নারী দেহের পোশাক সরিয়ে ফেলা হচ্ছে। আর ভুক্তভোগী ওই বিবস্ত্র নারীদের অনেকেই অল্পবয়সী। এসব ছবি সোশ্যাল মিডিয়াতে খোলাখুলিভাবে ব্যবহারও করা হয়েছে। ‘ডিপফেইক বট’ নামে প্রযুক্তি ব্যবহার করে নারীদের নগ্ন বানানোর কাজ চলছে। ডিপফেইক হলো কম্পিউটারে তৈরি এক ধরনের ছবি বা ভিডিও যা দেখলে ধরা যাবে না সেটি নকল। এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে প্রায়ই সেলেব্রিটিদের নিয়ে ভুয়া পর্নোগ্রাফিক ভিডিও ক্লিপ তৈরি করা হয়।
মেসেজিং অ্যাপ টেলিগ্রামের প্রাইভেট মেসেজিং চ্যানেলে একটি শক্তিশালী এআই বট (রোবট প্রোগ্রাম) ব্যবহার করা হয়। এর ব্যবহারকারীরা এই বটকে কোন নারীর ছবি পাঠাতে পারে। আর এআই প্রযুক্তি ব্যবহার করে বটটি কয়েক মিনিটের মধ্যে ছবিতে ঐ নারীর দেহ থেকে কাপড় সরিয়ে ফেলতে পারে। এর জন্য ম্যাসেজিং অ্যাপ টেলিগ্রামের গ্রাহককে কোন অর্থও দিতে হয় না। প্রযুক্তির দ্রæত পরিবর্তনের ফলে আমাদের সমাজ ব্যবস্থাও এত দ্রæত বদলে যাচ্ছে যে কল্পনা করা যায় না।
স্যোশাল মিডিয়ার ব্যবহার বাড়ার সাথে সাথে মেয়েদের হয়রানি, নিপীড়নও বাড়ছে৷ ২২টি দেশের স্যোশাল মিডিয়া ব্যবহারকারী শতকরা ৬০ ভাগ মেয়ে হয়রানির কারণে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এর প্রতি আগ্রহ হারাচ্ছেন। ২২টি দেশের নারীদের নিয়ে করা একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে যে, প্রায় শতকরা ৬০ ভাগ অল্প বয়সি মেয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় কোনো না কোনোভাবে নিপীড়ন বা হয়রানির মুখোমুখি হয়েছে। সবচেয়ে বেশি হয়রানির শিকার হয়েছে ফেসবুকে, এর পরে রয়েছে ইনস্টাগ্রাম, হোয়াটসঅ্যাপ এবং স্ন্যাপচ্যাট৷
সাইবার অপরাধীদের শিকার ৫২২ জনকে নিয়ে বাংলাদেশে পুলিশের এক গবেষণায় দেখা যায়, ভুক্তভোগীদের ৭০ শতাংশই নারী। তাদের মধ্যে ২৫ বছরের কমবয়সী নারী ৫৭ শতাংশ। সাইবার অপরাধের ধরনের মধ্যে রয়েছে চাঁদাবাজি সাত শতাংশ, সাইবার পর্নোগ্রাফি ১৪ শতাংশ, হ্যাকিং ২০ শতাংশ, মানহানি ১৮ শতাংশ, ভুয়া আইডি ২০ শতাংশ ও অন্যান্য ছয় শতাংশ। সাইবার অপরাধের ভিকটিম ৫৮ শতাংশই ফেক আইডি এবং আইডি হ্যাক করে মানহানিকারী অপরাধীর শিকার।
সাইবার অপরাধীদের শনাক্ত, গ্রেফতার ও অভিযোগ প্রমাণ করা সাইবার সিকিউরিটি অ্যান্ড ক্রাইম বিভাগের জন্য সময়সাপেক্ষ ও বেশ চ্যালেঞ্জিং। এসব চ্যালেঞ্জের মধ্যে রয়েছে- বিভিন্ন দেশের সঙ্গে মিউচুয়াল লিগ্যাল অ্যাসিস্ট্যান্ট ট্রিটি (এমএলএটি) না থাকা, ইন্টারনেট সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের লগ ডাটা সংরক্ষণে গাফিলতি, সংগঠিত অপরাধ সময়মতো না জানানো এবং ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহারকারীদের মধ্যে সচেতনতা ও দক্ষ জনবলের অভাব। সাইবার অপরাধ মোকাবেলায় ডিজিটাল ফরেনসিক ইনভেস্টিগেশন টিম, সাইবার ইনসিডেন্ট রেসপন্স অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন, ইন্টারনেট রেফারেল অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন, সোশ্যাল মিডিয়া মনিটরিং, ই-ফ্রড ইনভেস্টিগেশন ও সাইবার ক্রাইম নিয়ে তদন্তের জন্য বিভিন্ন টিম কাজ করছে।
লেখক: প্রাবন্ধিক ও রিসার্চ ফেলো,