হিমালয় কন্যা নেপালে দেখার রয়েছে অনেক কিছু


হীরেন পণ্ডিত: হিমালয় কন্যা নেপাল ভ্রমণ করার ইচ্ছা অনেকদিন থেকেই ছিলো কিন্তু ব্যাটে বলে হচ্ছিল না। নেপালি প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ভ্রমণে আপনাকে কম খরচে এবং কম সময়ে খুবই মুগ্ধ করবে। ঢাকা থেকে নেপাল ভ্রমণ কিভাবে যাবেন কম খরচে। আপনি হয়তো ভাবছেন যে নেপাল ভ্রমণ করবেন কিন্ত কিভাবে যাবেন? কত খরচ লাগবে? যাওয়া ও ফিরে আসার সময় কত লাগবে? কোথায় কোথায় ভ্রমণ করবেন? নেপালে কোথায় থাকবেন? নেপাল ভ্রমণ কি একা করবেন গ্রুপে ভ্রমণ করবেন? কিভাবে নেপাল ভ্রমণ করলে সবচেয়ে ভালো হয়। জন প্রতি কত খরচ হবে? খরচ খুব বেশি না। অনেকে শিলিগুড়ি দিয়ে বাসেও যেতে পারেন। নেপালী প্রচুর ছেলেময়ে আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পড়ে। ওরা এদিক দিয়েই বেশি আসা যাওয়া করে।
আমি অফিসের কাজে নেপাল গিয়েছিলাম। বাংলাদেশ বিমানের একটি ফ্লাইটে ঢাকা থেকে যাত্রা শুরু হলো প্রায় ১ ঘন্টা ৩০ মিনিটের মতো লাগলো নেপালের কাঠমান্ডু ত্রিভূবন ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট পৌঁছাতে। বিমান থেকে নেমে অন অ্যারাইভাল ভিসার পরম পূরণ করে পাসপোর্ট অটো স্ক্যান করে অতি অল্প সময়ের মধ্যেই ভিসা পেয়ে বিমান বন্দরের ইমিগ্রেশন ত্যাগ করি। অফিসিয়াল ভিজিটের একটা সুবিধা আছে সব কিছু আগে থেকেই রেডি থাকে। সেটা শ্রীলংকা ভ্রমণ, ভারতের তামিলনাড়ু– ভ্রমণ এমনকি নেপাল ভ্রমণের সময় সেই সুবিধাটা পাওয়া গিয়েছিলো। ট্যাক্সি খোঁজার ঝামেলা নেই। আগে থেকেই নামের ছোট ব্যানার নিয়ে হোটেলের ড্রাইভার এসে হাজির। দূর থেকে দেখতে পেলাম আমার নাম লিখে দাাঁড়িয়ে আছে একজন। বুঝতে অসুবিধা হলোনা লাগেজ গাড়ির পেছনে রেখে আমাকে গাড়িতে উঠার আহবান জানিয়ে সেও উঠে গেলো গাড়িতে। তবে অন এরাইভাল ভিসার জন্যে পাসপোর্ট, পাসপোর্টের ফটোকপি, রঙ্গিন পাসপোর্ট সাইজ ছবি, রিটার্ন টিকেট ও হোটেল বুকিং তথ্য অনেক সময় লাগতে পারে, ডলার এনডোরসমেন্ট, চাকুরিজীবী হলে এনওসি এবং স্টুডেন্ট হলে আইডি কার্ড লাগে।
ভিসা আবার ঢাকা থেকেও করে নিয়ে যেতে পারেন। ঢাকা গাবতলী বা শ্যামলী থেকে বুড়িমারি পোর্ট পর্যন্ত এসি বাস এবং নন এসি বাস ছেড়ে যায় এগুলোতে যাওয়া যায়। ঢাকার গাবতলী বা শ্যামলী থেকে এই সকল পরিহনগুলো রাত ৮টা থেকে ৯টার মধ্যে ছেড়ে যায় এবং বুড়িমারি স্থলবন্দর পরদিন সকাল ৬টা থেকে ৭টার মধ্যে পৌঁছে যায়। ভারতের চ্যাংড়াবান্ধা বর্ডার থেকে ভারতের রাণীগঞ্জ বর্ডারের উদ্দেশ্যে রওনা করতে হবে। চ্যাংড়াবান্ধা থেকে রাণীগঞ্জ পর্যন্ত দুইভাবে যেতে পারবেন। সময় লাগবে প্রায় ৩ঘন্টা।
দ্বিতীয় পথ হলো চ্যাংড়াবান্ধা বর্ডার থেকে কোচবিহার হাইওয়ে পর্যন্ত এর পর বাসে চলে যান শিলিগুড়ি। এখান থেকে আর একটি বাসে শিলিগুড়ি পানির ট্যাংকি যেতে হবে। তারপর পায়ে হেঁটে পৌঁছে যেতে পারবেন ভারতের রাণীগঞ্জ বর্ডার বা ইমিগ্রেশন অফিস। চ্যাংড়াবান্ধা বর্ডার থেকে ভারতের রাণীগঞ্জ বর্ডার সময় লাগবে ৩ঘন্টা থেকে ৪ঘন্টা।
আপনি চাইলে আকাশ পথেও বিমানে করে কাঠমান্ডু যেতে পারেন। সেক্ষেত্রে খরচ একটু বেশি লাগবে। বাংলাদেশ বিমানে ফ্লাইট ঢাকা থেকে প্রতিদিন কাঠমান্ডু চলাচল করে। ঢাকা থেকে বিমানে কাঠমান্ডু যেতে সময় লাগে প্রায় ১ঘন্টা ৩০মিনিট। বোর্ডিং পাস নেওয়ার সময় পাশের জানালার পাশে সিট নিতে পারলে কাঠমান্ডু এয়ারপোর্টে বিমান ল্যান্ডিংয়ের সময় হিমালয় কন্যাকে এক নজরে দেখে নিতে পারবেন।
আপনি যদি বাংলাদেশ বিমানে করে নেপালের কাঠমুন্ডু ত্রিভূবন এয়ারপোর্ট যান তাহলে ত্রিভূবন ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট থেকে বিনামূল্যে অন অ্যারাইভাল ভিসা পেয়ে যাবেন। ভিসা করার সময় পাসপোর্ট ও পাসপোর্ট সাইজের ছবি জমা দিতে হবে। যদি কোনো কারণে ছবি নিতে ভুলে যান তাহলে এখান থেকে ছবি তুলে নিতে পারবেন। আবার পাসপোর্ট স্ক্যান করার ব্যবস্থা এয়ারপোর্টেই আছে।
ত্রিভূবন ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট থেকে ডলার এক্সচেঞ্জ করে নিতে পারেন। কাঠমান্ডু পর্যটন এলাকার নাম হলো থামেল। এটি হলো কাঠমান্ডুর পুরোনো শহর এলাকার দিকে অবস্থিত। প্রতিটি গলিতে হোটেল, রেস্তোরাঁ এবং কেনাকাটার প্রচুর দোকান আছে এখানে। বেশিরভাগ ভ্রমণকারী থামেলেই থাকেন। ইন্টারনেট থেকে বাংলাদেশে বসেই দেখে নিতে পারেন আপনার বাজেট অনুসারে হোটেলগুলোর অবস্থা। সব থেকে ভালো হয় সরাসরি থামেল পৌঁছে পায়ে হেঁটে কিছু হোটেল দেখে নিয়ে বুকিং করা। চেক-ইনের সময় দেখে নিবেন হোটেলে গরম পানি, ওয়াই-ফাই ইত্যাদি প্রয়োজনীয় জিনিস আছে কিনা?
এই হোটেলগুলো প্রতি দিন ভাড়া পড়বে বাংলাদেশি ঢাকায় ১ হাজার ৫০০টাকা থেকে ২ হাজার ৫০০ টাকার মধ্যে। আপনার হোটেলের কাছাকাছি পেয়ে যাবেন খাবার হোটেল। কাঠমান্ডু থেকে একটি মোবাইল সিককার্ড কিনে নিতে পারেন ইন্টারনেটসহ যদি বেশ কিছুদিন থাকেন। নেপালে ফোন কলের খরচ অনেক বেশি তাই ইন্টারনেট থাকলে আপনি বিভিন্ন অ্যাপের মাধ্যমে ফ্রি যোগাযোগ করতে পারবেন। কাঠমান্ডু ও তার আশে পাশের ঐতিহাসিক দর্শনীয় স্থান দেখার আছে।
নগরকোটে সূর্যোদয় দেখে নিতে পারেন। সাধারণত যে হোটেলে থাকবেন সেখান থেকে পরের দিনের দর্শনীয় স্থানগুলো দেখার জন্য সার্ভিস নিতে পারেন। দার্জিলিং এ যেমন পাওয়া যায় এখানেও তেমনই পেয়ে যাবেন। প্রতিটি হোটেলেরই নিজস্ব গাড়ি বা পরিচিত এজেন্সি থাকে যেগুলো এই কাজে নিয়োজিত থাকে। আপনি পুরোদিনের জন্য গাড়ি ভাড়া করে নিতে পারেন। খরচ আনুমানিক ৫ হাজার থেকে ৭ হাজার বাংলাদেশি টাকায় পড়বে। নগরকোটে সূর্যোদয় দেখতে চাইলে আপনাকে মাঝরাতে রওনা দিতে হবে। অনেকটা দার্জিলিং এর টাইগার হিলের মত।
নেপাল ভ্রমণ প্রথম হলে ড্রাইভার বা গাইডের সাথে পরামর্শ করে নিতে পারেন আপনার ভ্রমণ পরিকল্পনা নিয়ে। নেপাল যাওয়ার আগে পূর্ব অভিজ্ঞতা থাকলে গুগল ম্যাপ দেখে আপনার পরিকল্পনা ঠিক করে ড্রাইভার বা গাইডকে জানান। কাঠমান্ডু ও তার আশে-পাশে মূল দর্শনীয় স্থানগুলো হলো কাঠমান্ডু দরবার স্কয়ার, শয়মভুনাথ মন্দির, বুদ্ধনাথ মন্দির, পশুপতিনাথ মন্দির এবং প্রাচীন ভক্তপুর শহর। এর বাইরেও রয়েছে বহু মন্দির এবং চক ও স্কয়ার।
সন্ধ্যায় ক্যাফে আর পাবগুলো জাক-জমক হয়ে ওঠে পোখারার লেক রোডে। ঘুরে দেখতে পারেন বিভিন্ন দোকান কেনাকাটার জন্য। পোখারায় বেশ কিছু নেপালি খাবারের দোকান আছে। রাতের খাবার এখানে করে নিতে পারেন। পোখারা থেকে কাঠমান্ডু বা থামেল ফিরে আসবেন বাসে করে। বিকেল ও সন্ধ্যাটা ঘুরেফিরে কিছু শপিং করে চলে যাবে।
হিমালয়কন্যা নেপালের সৌন্দর্যে মুগ্ধ বিশ্ববাসী। এজন্যই দূর-দূরান্ত থেকে পর্যটকরা নেপাল ভ্রমণে গিয়ে থাকেন। এ ছাড়াও মাউন্ট এভারেস্ট, শত বছরের পুরনো মন্দির, আকাশচুম্বী পর্বতমালা, জলপ্রপাত, বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতি, বিভিন্ন উৎসব রয়েছে দেশটিতে। পৃথিবীর যেসব দেশে সহজেই একা ভ্রমণ করা যায়, তার মধ্যে নেপাল অন্যতম। বিশ্বের পর্বতারোহীদের পছন্দের স্থান নেপাল। অন্নপূর্র্ণা কিংবা এভারেস্ট জয়ের জন্য সারা বছরই তারা এখানে ভিড় করেন। নেপাল পর্বতারোহীদের পছন্দের দেশ হলেও সাধারণ পর্যটরাও এখানে যান হিমালয়ের পাশ থেকে সূর্যোদয় কিংবা সূর্যাস্তের দৃশ্য দেখতে। অন্নপূর্ণা পর্বতের শুভ্র চূড়া দেখতেও কেউ কেউ ভিড় করেন সেখানে। প্রত্যেক বছর হাজারো পর্যটক ভ্রমণ করেন এই পাহাড়ি কন্যার দেশে।
সার্কের সদস্যদের মধ্যে ভূমিবেষ্টিত দেশগুলোর একটি হলো নেপাল, যার কোন সমুদ্র নেই, সমুদ্র পথে যবার কোন সুযোগও নেই। নেপাল বিখ্যাত হিমালয়ের সৌন্দর্যের দরজা হিসাবে কিন্তু শুধু হিমালয় াদেও নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডুতেও আছে আরও নানারকম দেখার মতো স্থান নিয়ে। কাঠমান্ডু নেপালের রাজধানী ও বৃহত্তম মহানগর যেখানে বাস করছে প্রায় ৫০ লাখ মানুষ। নেপালে ঘুরতে হলে কাঠমান্ডুতে আসাই ভালো। অনেকেই পাহাড় দেখবার আসায় কাঠমান্ডুর মতো শহরকে ঘুরবার তালিকায় প্রাধান্য প্রথমে দিতে চান না কিন্তু ঐতিহ্য, বাণিজ্য, নানাবিধ আরকিটেকচারাল নিদর্শন নিয়ে কাঠমান্ডু কিন্তু তার আপন মহিমায় উজ্জ্বল হয়ে আছে।
রয়েছে পশুপতিনাথ মন্দির যা হিন্দুদের পবিত্র ও নামকরা মন্দিরগুলোর মধ্যে নেপালের পশুপতিনাথ মন্দির সবচেয়ে বিখ্যাত। পশুপতিনাথ গড়ে উঠেছে শিবের সেবার জন্য এবং নেপাল ছাড়াও বছরে ভারত থেকে অজ¯্রমানুষ এখানে শিবের পূজা করবার জন্য ছুটে আসেন। এখানে দেখা পাওয়া যায় নানা প্রকৃতির সাধুদের।
নেপালের বিখ্যাত বৌদ্ধমন্দির গুলোর তালিকা করলে স্বয়ম্ভূনাথ থাকবে ১ থেকে তিনের মধ্যে। এটি কাঠমান্ডু শহরের পশ্চিমে পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থিত যেখানে যেতে হলে পাড়ি দিতে হবে গুণে গুণে ৩৬৫ টি পাথরের তৈরি সিঁড়ি। অবশ্য সিঁড়ি চড়বার আগেই নজর পরবে বানরের দিকে। মন্দিরের চত্বর ও তার আশে পাশে একশোর উপরে বানর বহুদিন থেকে বাস করে আসছে। এসমস্ত বানরকে নেপালীরা পবিত্র দূত মিনে করে। এই মন্দিরটি নেপালের প্রাচীনতম মন্দিরগুলোর একটি। পঞ্চম শতকের শুরুর দিকে এর অস্তিত্ব আবিষ্কার হয়। আশার কথা হচ্ছে ২০১৫ সালের ভূমিকম্প বলবার মতো কোন ক্ষতিই করতে পারেনি এই স্থানটির। মন্দিরটি অধিকাংশ সময় প্রবল পর্যটকের উপস্থিতিতে সরগরম থাকে। তাই সকাল ৭টা থেকে সাড়ে ৭টা হলো স্বয়ম্ভূনাথ মন্দির ঘুরবার জন্য সবচেয়ে ভাল সময়। মন্দিরের অংশগুলোর মধ্যে বুদ্ধ অমিদেভা পার্ক, পশ্চিমের স্তম্ভ, পূর্বের সিঁড়ি। একটি নির্দিষ্ট ফি এর মাধ্যমে মন্দিরটি ঘুরে দেখা যায় এবং লোকাল পুরোহিতকে আলাদা কিছু ফি দিলে সে আপনাকে মন্দিরের অভ্যন্তরে নিয়ে তাদের ধর্মীয় রীতিনীতিতে অংশ নেয়া সম্পর্কে ধারণা দেয়।
এ ছাড়াও কাঠমান্ডু, পাটান কিংবা ভক্তের মতো মধ্যযুগীয় শহরে ঘুরে বেড়াতেও পছন্দ করেন অনেকে। পুরো বছর এখানে পর্যটকের আনাগোনা থাকলেও অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর মাস এখানে ভ্রমণের জন্য সবচেয়ে ভালো সময়। কারণ এ সময় আকাশ পরিষ্কার থাকে, হিমালয়ও তার অপূর্ব সৌন্দর্য তুলে ধরে।
কাঠমান্ডু শহর থেকে ২৮ কিলোমিটার দূরে নাগরকোট। নেপালের যেসব স্থান থেকে সবচেয়ে মনোরম সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত দেখা যায়, নাগরকোট তার মধ্যে সবচেয়ে সেরা। হিমালয়ের মোট ১৩টি পর্বত রেঞ্জের মধ্যে ৮টিই নাগরকোট থেকে দেখা যায়। পোখারা নেপালের তৃতীয় বৃহত্তম শহর। কাঠমান্ডু থেকে ২০০ কিলোমিটার দূরে। পোখারায় দেখবেন ডেভিড ফলস, গুপ্তেশ্বর গুহা ও শ্বেতী নদী। এ নদীর পানির রং সাদা। বিখ্যাত ফেওয়া লেকে করতে পারেন নৌ-ভ্রমণ। আর সূর্যোদয় দেখতে খুব সকালে যেতে হবে সরংকোট।
নেপালের লোকাল খাবার হিসেবে তারা ভাতের থালিকেই প্রাধান্য দেয়। তাই কাঠমান্ডুর যেখানেই যাওয়া হোক না কেন ভাত না খেয়ে থাকা অসম্ভব। ভাতের সঙ্গে ডাল, মাছ, মুরগি, সালাদ, রায়তা, শাক ও পাঁপড় থালিতে থাকে।
যদি বিমানে আসেন তাহলে একটু সময় নিয়ে আগে চলে আসুন এয়ারপোর্টে। যথারীতি চেষ্টা করুন বাম পাশে জানালার কাছে সিট নিতে তাহলে আবারও হিমালয় দেখতে পাবেন। যারা বাই রোডে বাসে ফিরে আসবেন যথারীতি যেভাবে গিয়েছিলেন ঠিক একইভাবে ফিরে আসতে হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *