মোনায়েম সরকার একজন সৎ ও নির্লোভ রাজনীতিবিদ

হীরেন পণ্ডিত: রাজনীতিবিদ, লেখক, কলামলেখক মোনায়েম সরকারের বয়স বাড়ছে না থেমে আছে এক জায়গায়, তিনি চিরসবুজ, চিরযুবক, আটাত্তর তার কাছে একটি সংখ্যা, বয়স নয়। ১৯৪৫ সালের ৩০ মার্চ পৃথিবীর আলো দেখেছিলেন। এখনো প্রতিদিন ভোর হয়, বিকেল গড়িয়ে রাত, এভাবেই দিন যায়, মাস যায়, বাঙালি জাতির কল্যাণে ব্যস্ত থাকেন সব সময়। কিন্তু বার্ধক্যের কোনো ছাপ তার ভেতর দেখি না, তার চিন্তায়, মেধা মননে কিংবা তার কর্মে। মোনায়েম সরকারের জীবনে আলস্যের কোনো অবকাশ নেই। পরিবার বলতে তার সংগঠনই সবচেয়ে বড় পরিবার। জীবন ও রাজনীতি মিলে একাকার হয়ে গেছে তার জীবনে।
তার লেখার সঙ্গে সেই ১৯৮৬ সালের শেষের দিকেই পরিচয়, সবে মাত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নবীন এক ছাত্র হিসেবে এসেছি ঢাকায়। দীর্ঘদিন লেখার সঙ্গে পরিচয় থাকলেও যোগাযোগ হয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কল্যাণে অনেক পরে। বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন ফর ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ পরিদর্শন করার পর, আগ্রহ বাড়ছে প্রতিনিয়ত, যত দেখি ততই মুগ্ধ হই, দেশ নিয়ে ভাবনা, রাজনীতি নিয়ে ভাবনা, রাজনীতির জ্ঞানগর্ভ বিশ্লেষণ, প্রগতিশীল রাজনীতির অগ্রযাত্রা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় নতুন প্রজন্মকে শানিত করার নিরলস প্রচেষ্টা সত্যিই বিমোহিত করে আমাদের। জাতির যেকোনো ক্লান্তিলগ্নে বীরদর্পে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন এবং এখনো সব সময় দিয়ে যাচ্ছেন। ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের হাল ধরার জন্য বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনাকে দলের সভাপতির দায়িত্ব দিয়ে ১৭ মে ১৯৮১ সালে স্বদেশ প্রত্যাবর্তনে যারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন তিনি তাদের অন্যতম। জননত্রেী শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের কারণেই আজ বাংলাদেশের দৃপ্ত পদচারণা মাটি থেকে মহাকাশে। উন্নয়নের রোল মডেল। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা প্রাতিষ্ঠায় নতুন মাত্রা পেয়েছে।
স্বাধীনতাবিরোধী দেশি-বিদেশি চক্রের হাতে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের পর কালো অন্ধকার গ্রাস করেছিল বাংলাদেশকে, সেই অন্ধকার তাড়াতে আলোর মশাল জ্বালিয়েছিলেন তিনিই প্রথম। সে মশাল, প্রাথমিক সংকট-সীমাবদ্ধতার পর দিকে দিকে আলোকিত করতে থাকে, শুরু হয় বাঙালির ও বাংলাদেশের রাহু মুক্তির পালা। সব আবর্জনা দূর করতে প্রভাতে যেমন বাঙালি একাকার হয়, প্রতিশ্রুতিতে সমৃদ্ধ হয়, তেমনি এক শুভ প্রতিশ্রুতির বাতাস বইতে দেখা যায় জননেত্রী শেখ হাসিনার দেশে ফেরার দিন ১৯৮১ সালের ১৭ মে থেকে।
মোনায়েম সরকারের সাংগঠনিক শক্তির সঙ্গে পরিচিত হই সব সময়। নেতৃত্বদানের মাধ্যমে সবাইকে উদ্বুদ্ধ করার সেই এক অসাধারণ ক্ষমতা লক্ষ করি তার মাঝে। কবি শামসুর রাহমানের ওপর মৌলবাদী জঙ্গিদের আক্রমণের প্রতিবাদের কর্মসূচি গ্রহণের জন্য আয়োজিত সংস্কৃতিসেবীদের সভা এমন অসংখ্য প্রতিবাদ সভায়। কক্সবাজারের রামু, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর, সুনামগঞ্জের শাল্লা, কুমিল্লার শহরের ঘটনা, পাবনার সাঁথিয়া, রংপুরের গঙ্গাছড়া, যশোরের ঋষিপাড়াসহ সাম্প্রদায়িক দুঃখজনক ঘটনাগুলোতে তার মন কেঁদে ওঠে, এই বাংলাদেশ তো তিনি চাননি, আবার আস্থা রাখেন জননেত্রী শেখ হাসিনার ওপর এই ভেবে, অন্ধকার কেটে যাবে এক দিন, মৌলবাদী ও ধর্মান্ধগোষ্ঠীর পরাজয় হবেই। এসব দুঃখজনক ঘটনার প্রতিবাদে আয়োজন করেন সমমনাদের নিয়ে বিভিন্ন প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ সমাবেশ।
মোনায়েম সরকার দক্ষতার সঙ্গে আলোচনাকে নিয়ে আসেন সামনে। আমাদের বিদ্যমান সমাজ ও রাজনৈতিক বাস্তবতাকে হৃদয় ও বুদ্ধি দিয়ে বুঝে চলেছেন প্রতিনিয়ত, আমাদের সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছেন প্রতিনিয়ত। বাস্তবতার এবং এর ভেতর নির্মমতা ও তার ভেতরকার অন্যায়, বিশেষ করে ধনী-গরিবের বৈষম্য তার লেখায় জীবন্ত হয়ে ওঠে। এটা বুঝেছেন এবং আমাদের বুঝতে সাহায্য করেছেন যে অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলাটাই যথেষ্ট নয়; মানুষের মুক্তি আনতে হলে যে কাঠামোগত পরিবর্তন দরকার।
মোনায়েম সরকার ইচ্ছা করলে অনেক কিছু হতে পারতেন এবং সে ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য কাজ অবশ্যই করার কথা ছিল; কিন্তু রাজনীতিই ছিল তার নেশা। পেশা যদি বলতে হয় তবে সেটাও ওই রাজনীতিই। তবে সে রাজনীতি ক্ষমতা লাভের নয়। মন্ত্রী নয়, এমনকি সংসদ সদস্যও নয়, রাজনীতির কর্মীই রয়ে গেলেন সারাটা জীবন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘মোনায়েম সরকার আমাদের পার্মানেন্ট সরকার, প্রধানমন্ত্রী অত্যন্ত আপনজন মনে করেন তাকে।’
মোনায়েম সরকারের বিভিন্ন সময় লিখিত ও প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ১১৬টি। লেখকের বাস্তব রাজনৈতিক অভিজ্ঞতার প্রতিফলন লক্ষ করা যায় তার লেখনীতে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে সেক্যুলার, উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক ধারাই হলো মূলধারা এই ঐতিহাসিক সত্যটি আজ প্রতিষ্ঠিত। আজকের সমাজ ও রাজনীতির বাস্তবতায় বাংলাদেশের রাজনীতির মূলধারা প্রতিষ্ঠার জন্য মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির ইস্পাত কঠিন ঐক্যের খুব প্রয়োজন।
পঁচাত্তর-পরবর্তী প্রায় ৪ বছর প্রবাসী জীবনে তিনি শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী, পি এন হাকসার, ভূপেন গুপ্ত, রমেশ চন্দ্র, রাজেশ্বর রাও, ডি টি রনধিকে, অধ্যাপক শান্তিময় রায়, গণেশ ঘোষ, মনুখ নাথ গুপ্ত প্রমুখ বিখ্যাত ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলেন। শওকত ওসমান রচিত ডায়েরি উত্তর-পর্ব মুজিবনগর পড়লে মোনায়েম সরকারের ভূমিকা যথার্থভাবে জানা যায়। ১৭ জানুয়ারি ১৯৭৯ তারিখে ডায়েরিতে তিনি লিখেছেন; দেশাত্মবোধের সঙ্গে জীবন সংগ্রামের চিন্তাধারা এমনভাবেই মিলেছে যে বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাকাণ্ডের পরপর আর দেশে থাকতে পারেনি। এখানে সে যেন সব রাজনৈতিক রিফিউজিদের অভিভাবক হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছিলেন। অভ্যাসের জন্য টাকাপয়সা জোগাড় করা থেকে রাজনৈতিক প্রবাহ বজায় রাখার জন্য কতভাবে না নিজেকে ব্যাপৃত রেখেছিলেন।
বঙ্গবন্ধু বাংলার মানুষের জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। এই প্রেরণাবোধ মোনায়েম সরকারের চেতনায় দারুণভাবে নাড়া দেয়। নিজিকে উৎসর্গ করেন মানুষের কল্যাণে। তার নিজের জীবনে কোনো চাওয়া-পাওয়া নেই। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শকে বুকে ধারণ করে তার এই ত্যাগের দৃষ্টান্ত সবার জন্য শিক্ষণীয়। বঙ্গবন্ধুর ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত অসাম্প্রদায়িক সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠার জন্য নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন নিরন্তর।
মোনায়েম সরকার একজন স্থির, বিচক্ষণ, নির্লোভ এবং সৎ রাজনীতিকের প্রতিভূ। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাংলাদেশের রাজনীতির সব আন্দোলনে যেমন ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪-এর যুক্তফ্রন্ট গঠন, ১৯৬২ শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৯ গণ-অভ্যুত্থান, ১৯৭০-এর নির্বাচন, ১৯৭১ স্বাধীনতাসংগ্রাম থেকে আজ পর্যন্ত সব স্থানে তার অনিবার্য উপস্থিতি ছিল। কৈশোরের ১৯৫২ সালে ভাষা-আন্দোলনের মধ্য দিয়ে তার প্রগতিশীল রাজনৈতিক আন্দোলনে অংশগ্রহণের যে সূচনা, তা আজকের বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নময় সোনার বাংলাদেশের মাটিতে অনেক শক্তভাবে প্রোথিত। বাংলাদেশের রাজনীতির উত্থান-পতনের একজন দক্ষ বিশ্লেষক হিসেবে তার সু-লেখনী সবার মধ্যে প্রশংসিত। রাজনীতি, সমাজনীতি এবং সাংস্কৃতিক আন্দোলনের এই অগ্রপথিকের দীর্ঘায়ু কামনা করি আমরা। আমরাও বিশ্বাস করি, তিনি তার শেষ দিন পর্যন্ত বাঙালি-বাংলা-বাংলাদেশের মানুষের কল্যাণে নিবেদিত থাকবেন।
১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের পর দেশ গভীর সংকটে নিমজ্জিত। সম্পূর্ণরূপে স্বাধীনতাবিরোধী এবং সাম্প্রদায়িক অশুভশক্তির হাতে দেশ। মোনায়েম সরকার দেশের এই অরাজকতা দূর করার লক্ষ্যে একটি প্রস্তাবনা ইন্দিরা গান্ধীর কাছে পেশ করলেন। বঙ্গবন্ধু হত্যা, জেলহত্যা, আওয়ামী রাজনীতি নির্মূলকরণের বিরুদ্ধে সমগ্র বিশ্ব জুড়ে যেখানে যত আওয়ামী লীগ অনুরাগী, রাজনৈতিক কর্মী, বুদ্ধিজীবী সাহিত্যিক আছেন তারা তাদের মতো করে রাজনৈতিকভাবে সবকিছু প্রতিহত করার চেষ্টা করেন।
১৯৮০ বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিবেশ ধীরে ধীরে আওয়ামী রাজনৈতিক আন্দোলনের কারণে অসাম্প্রদায়িকতার দিকে ধাবিত হয়। আওয়ামীপন্থি নেতারাও তাদের ভীতিমূলক অবস্থান থেকে বেরিয়ে এসে মূলধারার রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার চর্চায় নিবেদিত হন। কিন্তু আওয়ামী লীগের হাল ধরবে কে? এ নিয়ে ছিল প্রত্যেকের দ্বিধা। হালধরার কাণ্ডারিও ছিল অনেকজন। তাদের অনেকেই সর্বজন শ্রদ্ধেয় ছিলেন। তবে শেষ পর্যন্ত শেখ হাসিনার নাম প্রস্তাব করা হয়। এক পারিবারিক পরিবেশে শেখ হাসিনার নাম প্রথম প্রস্তাব আকারে ভারতের রাজনীতির এক দূরদর্শী ব্যক্তিত্ব পি এন হাকসারের কাছে তুলে ধরেন মোনায়েম সরকার। শেখ হাসিনার নাম প্রস্তাব হওয়ায় তা সর্বমহলে গৃহীত হয় সর্বসম্মতিতে।
১৯৯৬ জাতীয় নির্বাচন। নির্বাচনী কমিটি তৈরি করা হয়। যুগ্ম আহ্বায়ক শাহ এ এম এস কিবরিয়া ও গাজীউল হকসহ আরো অনেকে। কিন্তু নির্বাচনী পরিচালনার প্রথম সারির কারিগরের মধ্যে ছিলেন শাহ এ এম এস কিবরিয়া এবং মোনায়েম সরকার। এই কমিটির নির্বাচনী পরিচালনার দক্ষতায় ২১ বছর পর আওয়ামী লীগ দেশ শাসন প্রক্রিয়ায় অধিষ্ঠিত হয়। শাহ এ এম এস কিবরিয়া এবং মোনায়েম সরকার বাংলাদেশের রাজনীতি, সমাজ ও সংস্কৃতির মূলধারার গবেষণাগার বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন ফর ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ প্রতিষ্ঠা করেন। গবেষণাগারের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব আমৃত্যু পালন করেন শাহ এ এম এস কিবরিয়া এবং প্রতিষ্ঠাতা মহাপরিচালকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন মোনায়েম সরকার।
মোনায়েম সরকারের কোনো অহংকারবোধ কেউ কখনো দেখেননি, এমন বন্ধুবৎসল ও অতিথিপরায়ণ মানুষ আমাদের সমাজে বিরল। মোনায়েম সরকারের মতো গুণী ও নির্লোভ মানুষের আমাদের সমাজে বড় বেশি প্রয়োজন, তাহলেই বাংলাদেশ আরো দ্রুত এগিয়ে যাবে।
লেখক : প্রাবন্ধিক, গবেষক ও কলাম লেখক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *