চতুর্থ শিল্প বিপ্লব ও তরুণ প্রজন্ম


হীরেন পণ্ডিত: বিভিন্ন গবেষণা অনুযায়ী আগামী দুই দশকের মধ্যে মানবজাতির ৪৭ শতাংশ কাজ স্বয়ংক্রিয় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন যন্ত্রের মাধ্যমে হতে পারে। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের ফলে শ্রমনির্ভর এবং অপেক্ষাকৃত কম দক্ষতানির্ভর চাকরি বিলুপ্ত হলেও উচ্চ দক্ষতানির্ভর যে নতুন কর্মবাজার সৃষ্টি হবে সে বিষয়ে আমাদের তরুণ প্রজন্মকে তার জন্য প্রস্তুত করে তোলার এখনই সেরা সময়। দক্ষ জনশক্তি প্রস্তুত করা সম্ভব হলে জনমিতিক লভ্যাংশকে কাজে লাগিয়ে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সুফল ভোগ করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অন্য অনেক দেশ থেকে অনেক বেশি উপযুক্ত।

চাকরি থেকে ব্যবসার ক্ষেত্র সব জায়গায় রোবটিকসের মতো প্রযুক্তি জায়গা করে নিচ্ছে। তৈরি পোশাক শিল্পে এ উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার হচ্ছে দ্রুতগতিতে। তৈরি পোশাক শিল্প বৃহৎভাবে স্বয়ংক্রিয়করণের দিকে ধাবিত হলে এর ব্যাপক প্রভাব দেশের অর্থনীতি, উন্নয়ন, সামাজিক প্রেক্ষাপট এবং শিক্ষাসহ সব ক্ষেত্রেই দেখা যাবে। প্রথম সম্ভাব্য প্রভাব হলো-চাকরি হারানো। তৈরি পোশাক শিল্প বাংলাদেশের কর্মসংস্থানের একটি বড় উৎস এবং অটোমেশনের দিকে এর স্থানান্তর হলে বর্তমান শিল্পে নিযুক্ত বিশালসংখ্যক শ্রমিক উল্লেখযোগ্য চাকরি হারাতে পারেন। বিভিন্ন গবেষণায় বলছে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের প্রভাবে চাকরি হারাবেন লাখ লাখ তৈরি পোশাক কর্মী।

এটি দেশের অর্থনীতির পাশাপাশি স্বতন্ত্র শ্রমিকদের জীবিকার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। চাকরি হারানো কর্মীদের নিয়ে দুশ্চিন্তা বাড়ছে। এ কথা সত্য, অটোমেশন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং রোবটের ব্যবহারের দিকে পরিবর্তন তৈরি পোশাক খাতে দক্ষতা ও উৎপাদনশীলতা বাড়াতে পারে; যার মাধ্যমে শেষ পর্যন্ত দেশের অর্থনীতি উপকৃত হবে। জ্ঞানভিত্তিক এ শিল্প বিপ্লবে প্রাকৃতিক সম্পদের চেয়ে দক্ষ মানবসম্পদই হবে বেশি মূল্যবান। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের ফলে বিপুল পরিমাণ মানুষ চাকরি হারালেও এর বিপরীতে সৃষ্টি হবে নতুন ধারার নানা কর্মক্ষেত্র। এ ক্ষেত্রে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের উপযোগী দক্ষ জনশক্তি তৈরিতে বাংলাদেশের যথাযথ প্রস্তুতি নিতে হবে।

চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের ভিত হচ্ছে-‘জ্ঞান ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা’-ভিত্তিক কম্পিউটিং প্রযুক্তি। রোবটিকস, আইওটি, ন্যানো প্রযুক্তি, ডাটা সায়েন্স ইত্যাদি প্রযুক্তির প্রসার প্রতিনিয়ত চতুর্থ বিপ্লবকে নিয়ে যাচ্ছে অনন্য উচ্চতায়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়ছে কর্মবাজারে। অটোমেশন প্রযুক্তির ফলে ক্রমে শিল্প কারখানা হয়ে পড়ছে যন্ত্রনির্ভর। টেক জায়ান্ট কোম্পানি অ্যাপলের হার্ডওয়্যার নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ফক্সকন এরই মধ্যে হাজার হাজার কর্মী ছাঁটাই করে তার পরিবর্তে রোবটকে বেছে নিয়েছে। বিগত বছরগুলোয় চীনের কারখানাগুলোয় রোবট ব্যবহারের হার বেড়েছে বহুগুণে। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম তাদের একটি গবেষণা প্রতিবেদনে জানায়, রোবটের কারণে বিশ্বজুড়ে কোটি কোটি মানুষ চাকরি হারাবে।

বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি কর্মসংস্থান সৃষ্টিকারী খাত তৈরি পোশাক শিল্পের এসব আশঙ্কার ভেতরেই রয়েছে আগামী দিনের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনের বিশাল সম্ভাবনা। বর্তমানে তরুণের সংখ্যা প্রায় পাঁচ কোটি, যা মোট জনসংখ্যার ৩০ শতাংশের বেশি। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে আগামী ৩০ বছরজুড়ে তরুণ বা উৎপাদনশীল জনগোষ্ঠী সংখ্যাগরিষ্ঠ থাকবে। বাংলাদেশের জন্য চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সুফল ভোগ করার এটাই সবচেয়ে বড় হাতিয়ার। জ্ঞানভিত্তিক এ শিল্প বিপ্লবে প্রাকৃতিক সম্পদের চেয়ে দক্ষ মানবসম্পদই হবে বেশি মূল্যবান। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের ফলে বিপুল পরিমাণ মানুষ চাকরি হারালেও এর বিপরীতে সৃষ্টি হবে নতুন ধারার নানা কর্মক্ষেত্র। নতুন যুগের এসব চাকরির জন্য প্রয়োজন উঁচু স্তরের কারিগরি দক্ষতা। ডাটা সায়েন্টিস্ট, আইওটি এক্সপার্ট, রোবটিকস ইঞ্জিনিয়ারের মতো আগামী দিনের চাকরিগুলোর জন্য সবচেয়ে বেশি উপযোগী তরুণ জনগোষ্ঠী।

সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে শিক্ষাব্যবস্থায় পরিবর্তন আনাটাও জরুরি। আগামী দিনের সৃজনশীল, সুচিন্তার অধিকারী, সমস্যা সমাধানে দক্ষ জনগোষ্ঠী গড়ে তোলার উপায় হলো শিক্ষাব্যবস্থাকে এমনভাবে সাজানো, যাতে এ দক্ষতাগুলো শিক্ষার্থীর মধ্যে সঞ্চারিত হয় এবং কাজটি করতে হবে প্রাথমিক শিক্ষা থেকে। একই ধরনের পরিবর্তন হতে হবে উচ্চশিক্ষার স্তরে। প্রত্যেক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের জন্য টিচিং অ্যান্ড লার্নিং সেন্টার প্রতিষ্ঠা প্রয়োজন। যেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের গ্র্যাজুয়েট তৈরির জন্য স্কিল বিষয়ে নিজেরা প্রশিক্ষিত হবেন। উচ্চশিক্ষার সর্বস্তরে শিল্পের সঙ্গে শিক্ষার্থীর সংযোগ বাড়াতে হবে। প্রয়োজনে শিক্ষানবিশি কার্যক্রম বাধ্যতামূলক করতে হবে, যাতে শিক্ষার্থীরা তাদের ডিগ্রি অর্জনের পাশাপাশি বাস্তব জীবনের কার্যক্রম সম্পর্ক হাতে-কলমে শিখতে পারেন।

উচ্চশিক্ষা স্তরে গবেষণাভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে এবং যারা বুদ্ধিবৃত্তির চর্চা ও গবেষণায় নিয়োজিত, তাদের মূল্যায়ন করতে হবে। গবেষণা ক্ষেত্রে বাজেট বাড়াতে হবে। শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোকে গবেষণায় অর্থায়নে এগিয়ে আসতে হবে। প্রচুর বাংলাদেশি গবেষক বিদেশে বেশ ভালো ভালো গবেষণায় নিয়োজিত। প্রয়োজনে তাদের সুযোগ-সুবিধা দিয়ে এ দেশে এসে কাজ করার ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। শিল্প প্রতিষ্ঠান ও একাডেমিয়া একত্রে কোলাবরেশনের মাধ্যমে হাতে-কলমে শিক্ষা ও গবেষণার ক্ষেত্রে এগিয়ে আসতে হবে।

এ ক্ষেত্রে আমাদের জন্য সবচেয়ে ভালো উদাহরণ হতে পারে জাপান। দ্বিতীয় বিশযুদ্ধের পর ভঙ্গুর অর্থনীতি থেকে আজকের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ জাপান পৃথিবীকে দেখিয়ে দিয়েছে শুধু মানবসম্পদকে কাজে লাগিয়ে অর্থনৈতিক এবং সার্বিক জীবনমানের উত্তরণ ঘটানো যায়। জাপানের প্রাকৃতিক সম্পদ অত্যন্ত নগণ্য এবং আবাদযোগ্য কৃষিজমির পরিমাণ মাত্র ১৫ শতাংশ।

জাপান সব প্রাকৃতিক প্রতিকূলতাকে অতিক্রম করেছে তার জনসংখ্যাকে সুদক্ষ জনশক্তিকে রূপান্তর করার মাধ্যমে। জাপানের এই উদাহরণ আমাদের জন্য সবচেয়ে বেশি উপযোগী। বাংলাদেশের সুবিশাল তরুণ জনগোষ্ঠীকে জনসম্পদে রূপান্তর করতে পারলে আমাদের পক্ষেও উন্নত অর্থনীতির একটি দেশে পরিণত হওয়া অসম্ভব নয়।

শিল্প কারখানায় কী ধরনের জ্ঞান ও দক্ষতা লাগবে সে বিষয়ে আমাদের শিক্ষাক্রমের তেমন সমন্বয় নেই। চতুর্থ শিল্প বিপ্লব মোকাবিলায় শিক্ষাব্যবস্থাকেও ঢেলে সাজাতে হবে। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স, আইওটি, ব্লকচেইন এসব প্রযুক্তিতে বাংলাদেশ এখনও অনেক পিছিয়ে। এসব প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা, পণ্য সরবরাহ, চিকিৎসা, শিল্প কারখানা, ব্যাংকিং, কৃষি, শিক্ষাসহ নানা ক্ষেত্রে কাজ করার পরিধি এখনও তাই ব্যাপকভাবে উন্মুক্ত।

কর্মক্ষেত্রে আমাদের শ্রমিকদের অদক্ষতাই তাদের আয়ের ক্ষেত্রে এই বিরাট ব্যবধানের কারণ। সংগত কারণেই আমাদের উচিত কারিগরি দক্ষতার ওপর আরও জোর দেওয়া। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় পরিবর্তন আনাটাও একান্ত জরুরি। শিল্প প্রতিষ্ঠান ও একাডেমিয়া একত্রে কোলাবরেশনের মাধ্যমে হাতে-কলমে শিক্ষা ও গবেষণার ক্ষেত্রে এগিয়ে আসতে হবে।

আমাদের উচিত হবে সব বিভাগ ও সেক্টর তাদের নিজস্ব কাজকে আরও বেগবান করার লক্ষ্যে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের প্রযুক্তি ভাবনাকে সামনে রেখে কর্মপরিকল্পনা তৈরি করা। অতঃপর সব সেক্টরের কর্মপরিকল্পনাকে সুসমন্বিত করে একটি জাতীয় কর্মপরিকল্পনা তৈরি করে সবাইকে মিলে কাজ করতে হবে। আশার কথা, শিল্প বিপ্লবের ভিত্তি হিসেবে তিনটি বিষয়ে সরকার গুরুত্ব দিচ্ছে। এগুলো হলো-অত্যাধুনিক প্রযুক্তি উদ্ভাবনের মাধ্যমে শিল্পের বিকাশ, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কর্মিবাহিনী তৈরি করা এবং পরিবেশ সংরক্ষণ। তাই সবাই মিলে আমাদের এখন থেকেই একটি সুপরিকল্পনার মাধ্যমে এগিয়ে যেতে হবে। তবেই আমরা আমাদের কাংখিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারব।

কেবল পরিকল্পনার মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে অবকাঠামোগত উন্নয়নের পাশাপাশি আমাদের মানবসম্পদকেও যথাযথভাবে প্রস্তুত করতে হবে এ পরিবর্তনের জন্য। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স, আইওটি, ব্লকচেইন-এসব প্রযুক্তিতে বাংলাদেশ এখনও তুলনামূলকভাবে পিছিয়ে। এসব প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা, পণ্য সরবরাহ, চিকিৎসা, শিল্প কারখানা, ব্যাংকিং, কৃষি, শিক্ষাসহ নানা ক্ষেত্রে কাজ করার পরিধি এখনও তাই ব্যাপকভাবে উন্মুক্ত। সত্যিকার অর্থে যেহেতু তৃতীয় শিল্প বিপ্লবের সুফলই আমরা সবার কাছে পৌঁছাতে পারিনি, চতুর্থ বিপ্লব মোকাবিলার জন্য আমাদের প্রস্তুতি কতটুকু তা আরও গভীরভাবে ভাবতে হবে। ব্যাপক সমন্বিত কর্মপরিকল্পনা ও প্রয়োজনীয় অবকাঠামো স্থাপনের মাধ্যমে তা করা সম্ভব। কারিগরি শিক্ষার হারে বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে আছে। আমাদের মাত্র ১৪ শতাংশ শিক্ষার্থী কারিগরি শিক্ষা গ্রহণ করছে যেখানে বর্তমানে কারিগরি শিক্ষার হার জার্মানিতে ৭৩ শতাংশ, জাপান ৬৬ শতাংশ, সিঙ্গাপুর ৬৫ শতাংশ, অস্ট্রেলিয়া ৬০ শতাংশ, চীন ৫৫ শতাংশ, দক্ষিণ কোরিয়া ৫০ শতাংশ, মালয়েশিয়া ৪৬ শতাংশ। আমাদের কারিগরি শিক্ষা ও বিশ্ব প্রস্তুতিতে দেখা যায়, জার্মানিতে ১৯৬৯ সালে, সিঙ্গাপুরে ১৯৬০ সালে ও বাংলাদেশে ১৯৬৭ সালে শুরু হয়েছে। অন্য দেশগুলো দ্রুত উন্নতি করলেও আমরা বিভিন্ন পরিসংখ্যানে কারিগরি শিক্ষার হার ও গুণগত মানের দিক দিয়ে অন্যদের থেকে অনেক পিছিয়ে আছি। কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের সূত্র অনুযায়ী আমাদের দেশে বর্তমানে কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে ৮ হাজার ৬৭৫টি। বর্তমানে প্রায় ১২ লাখ শিক্ষার্থী কারিগরি শিক্ষায় পড়াশোনা করছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *