স্বাস্থ্যসেবা ও চতুর্থ শিল্প বিপ্লব


হীরেন পণ্ডিত: আপনি ব্যবহার করছেন স্মার্ট রিস্ট ব্যান্ড, যা বলে দিচ্ছে আপনার পালস রেট, হার্টবিট, স্ট্রেস লেভেল, কত সময় হাঁটলেন, মাপছে আপনার ওজন। এসবই কিন্তু আইওটি ডিভাইসের অবদান। আইওটি ডিভাইস দূরবর্তী অবস্থান থেকে স্বাস্থ্য পর্যবেক্ষণ এবং জরুরি নোটিস সিস্টেম সক্রিয় করতেও ব্যবহার করা যেতে পারে।

বাংলাদেশ ইতিমধ্যে স্বাস্থ্য খাতে অনেক অগ্রগতি অর্জন করেছে, যেমন ৫ বছরের কম বয়সি শিশুদের মৃত্যুহার কমানো, এইচআইভি ভাইরাসের বিরুদ্ধে কার্যকর ওষুধের প্রাপ্যতা, ৫ বছরের কম বয়সি শিশুদের যক্ষ্মা শনাক্তকরণ ও সরাসরি তত্ত্বাবধানের মাধ্যমে ওষুধ প্রয়োগের মাধ্যমে যক্ষ্মা নিরাময়ের হার বৃদ্ধি। এ ছাড়া দারিদ্র্য হার হ্রাস, কম ওজনের শিশুদের সংখ্যা কমানো, প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা বৃদ্ধি, নবজাতক ও মাতৃ মৃত্যুহার কমানো, টিকাদান কর্মসূচির উন্নয়ন এবং সংক্রামক ব্যাধির প্রকোপ কমানোর ক্ষেত্রে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য উন্নতি করেছে।

ই-স্বাস্থ্যসেবার মূল লক্ষ্য হচ্ছে টেলিফোন বা মোবাইলের মাধ্যমে দূরবর্তী রোগীকে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের কাছ থেকে অতিদ্রুত চিকিৎসাসেবার ব্যবস্থা করা। ঘরে বসেই টেলি-কনফারেন্স বা ভিডিও-কনফারেন্স বা অনলাইনের মাধ্যমে দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করা যায়। সব ধরনের স্বাস্থ্যসেবা সাধারণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়া, চিকিৎসা বিষয়ক সুপরামর্শ প্রদান করা, বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের অ্যাপয়েন্টমেন্টের ব্যবস্থা করে দেওয়া, ডায়াগনস্টিক সেন্টারে পরীক্ষার ব্যবস্থা করা, দুর্লভ ওষুধসমূহের সহজ প্রাপ্যতা নিশ্চিত করা, সাধারণ মানুষকে স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতন করা।

ঝামেলা ছাড়াই স্বাস্থ্যসেবা অ্যাপে মিলছে অনলাইনে ডাক্তারের ভিডিও পরামর্শ, ই-প্রেসক্রিপশন ও জরুরি স্বাস্থ্যসেবা। আপনার স্মার্টফোনে স্বাস্থ্যসেবা অ্যাপটি ইনস্টল করে নিতে পারেন খুব সহজে। আর সরাসরি ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলুন ভিডিও কলে। স্বাস্থ্যসেবা অ্যাপ থেকে সহজে ডাক্তারের সিরিয়াল নিতে অ্যাপ চালু করে হোমপেজের ডাক্তার অপশনে ক্লিক করে নেওয়া যায় স্বাস্থ্যসেবা। যে সমস্যার জন্য বিশেষজ্ঞ ডাক্তার দেখাবেন সেই ক্যাটাগরি ক্লিক করুন। এবার পছন্দের ডাক্তারের ওপর ক্লিক করুন। আপনার অ্যাপয়েন্টমেন্ট বুক করুন, বাটনে ক্লিক করুন, এবার চেম্বার নির্বাচন করুন, প্যাশেন্ট টাইপ নির্বাচন করুন, যে তারিখে দেখাবেন নির্বাচন করুন এবং কোন সময়ে ডাক্তার দেখাবেন সেটা নির্বাচন করুন, আপনার সমস্যা লিখে অ্যাপয়েন্টমেন্ট সাবমিট করুন। ডাক্তারের ফি নির্ধারিত থাকলে ফি প্রদান পেজে নিয়ে যাবে এবং কীভাবে ফি পরিশোধ করবেন সেটা নির্বাচন করে ফি পরিশোধ করলে অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিশ্চিত হয়ে যাবে। খুব সহজে হয়ে গেল ডাক্তারের অ্যাপয়েন্টমেন্ট।

বিশ্ব সভ্যতাকে নতুন মাত্রা দিচ্ছে চতুর্থ শিল্প বিপ্লব। এই বিপ্লবের প্রক্রিয়া ও সম্ভাব্যতা নিয়ে ইতিমধ্যে বিশ্বব্যাপী ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে। আলোচনা হচ্ছে আমাদের দেশেও। আমরা জানি, চতুর্থ শিল্প বিপ্লব হচ্ছে ফিউশন অব ফিজিক্যাল, ডিজিটাল এবং বায়োলজিক্যাল স্ফেয়ার। এখানে ফিজিক্যাল হচ্ছে হিউমেন, বায়োলজিক্যাল হচ্ছে প্রকৃতি এবং ডিজিটাল হচ্ছে টেকনোলজি। এই তিনটিকে আলাদা করা কঠিন হয়ে যাচ্ছে। এর ফলে কী হচ্ছে? সমাজে কী ধরনের পরিবর্তন হচ্ছে? এর ফলে ইন্টেলেকচুয়ালাইজেশন হচ্ছে, হিউমেন মেশিন ইন্টারফেস হচ্ছে এবং রিয়েলটি ও ভার্চুয়ালিটি এক হয়ে যাচ্ছে।

এখন যদি আমরা আমাদের চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের জন্য প্রস্তুত করতে হলে ইমোশনাল ইন্টেলিজেন্স, ফিজিক্যাল ইন্টেলিজেন্স, সোশ্যাল ইন্টেলিজেন্স, কনটেস্ট ইন্টেলিজেন্সের মতো বিষয়গুলো তাদের মাথায় প্রবেশ করিয়ে দিতে হবে। তাহলে ভবিষ্যতে আমরা সবাইকে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের জন্য প্রস্তুত করতে পারব। তবে ভবিষ্যতে কী কী কাজ তৈরি হবে সেটা অজানা। এই অজানা ভবিষ্যতের জন্য প্রজন্মকে তৈরি করতে আমরা আমাদের কয়েকটি বিষয়ে কাজ পারি। সভ্যতা পরিবর্তনের শক্তিশালী উপাদান হলো তথ্য। সভ্যতার শুরু থেকেই মানুষ তার অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান ছড়িয়ে দিতে উদগ্রীব ছিল। কাগজ ও কালির আবিষ্কার এবং পরে ছাপাখানার উদ্ভব মানুষের তথ্য বিস্তারের আকাক্সক্ষাকে বাস্তবে রূপায়িত। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের প্রযুক্তিগত আলোড়ন সর্বত্র বিরাজমান।

এ বিপ্লব চিন্তার জগতে, পণ্য উৎপাদনে ও সেবা প্রদানে বিশাল পরিবর্তন ঘটাচ্ছে। মানুষের জীবনধারা ও পৃথিবীর গতি-প্রকৃতি ব্যাপকভাবে বদলে দিচ্ছে। জৈবিক, পার্থিব ও ডিজিটাল জগতের মধ্যকার পার্থক্যের দেয়ালে চির ধরিয়েছে। আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স, রোবটিকস, ইন্টারনেট অব থিংকস, ভার্চুয়াল রিয়েলিটি, থ্রিডি প্রিন্টিং, জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং, কোয়ান্টাম কম্পিউটিং ও অন্যান্য প্রযুক্তি মিলেই এ বিপ্লব। এ বিপ্লবের ব্যাপকতা, প্রযুক্তিনির্ভর আধুনিকতা এবং এ সংশ্লিষ্ট জটিল ব্যবস্থা বিশ্বের সরকারগুলোর সক্ষমতাকে বড় ধরনের পরীক্ষার সম্মুখীনও করেছে। বৈষম্য হ্রাস, নিরাপদ কর্ম এবং দায়িত্বশীল ভোগ ও উৎপাদন অর্জনের মূল চ্যালেঞ্জ।

আমাদের দেশে এখন মোবাইল ফোনের মাধ্যমে নাগরিকরা সরকারি স্বাস্থ্য কেন্দ্রে কর্মরত চিকিৎসকের কাছ থেকে বিনামূল্যে স্বাস্থ্য পরামর্শ নিতে পারছেন। সেজন্য বাংলাদেশের প্রতিটি জেলা ও উপজেলা হাসপাতালে একটি করে মোবাইল ফোন দেওয়া হয়েছে। আপনিও এই সেবা গ্রহণ করতে পারেন। এসব মোবাইল ফোনের নম্বর স্থানীয় পর্যায়ে প্রচারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। ২৪ ঘণ্টাব্যাপী কোনো না কোনো চিকিৎসক এই মোবাইল ফোনের কল রিসিভ করেন। স্থানীয় জনগণ এসব মোবাইল ফোনে ফোন করে হাসপাতালে না এসেই বিনামূল্যে চিকিৎসা পরামর্শ নিতে পারেন। এই সেবা চালুর ফলে গ্রাম বা প্রত্যন্ত এলাকায় বসবাসরত ধনী-গরিব সবার জন্যই বিনামূল্যে সরকারি চিকিৎসকদের কাছ থেকে চিকিৎসা পরামর্শ গ্রহণের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। নিঝুম রাতে, জরুরি প্রয়োজনে বা পথের দূরত্বের কারণে চিকিৎসা পরামর্শ পেতে আর দেরি করার প্রয়োজন নেই। হাতুড়ে চিকিৎসকের দ্বারস্থ হয়ে ভুল বা অপচিকিৎসার ঝুঁকি নেওয়ারও প্রয়োজন নেই। যে চিকিৎসা বাড়িতে বসেই সম্ভব, তার জন্য হাসপাতালে আসার প্রয়োজন নেই।

যে চিকিৎসা গ্রামের কমিউনিটি ক্লিনিকেই সম্ভব, তার জন্য উপজেলা বা জেলা হাসপাতালে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। আবার যে রোগটি জটিল এবং আশু চিকিৎসা প্রয়োজন, তার জন্য অযথা এখানে সেখানে ঘোরাঘুরিতে সময় নষ্ট না করে বড় হাসপাতালে যাওয়ার পরামর্শটিও পাওয়া সম্ভব একটি মাত্র ফোনকল করেই। ব্যস্ত মানুষেরাও রোগের শুরুতেই পরামর্শ নিতে পারেন চিকিৎসকের। এর ফলে রোগ জটিল হওয়ার সম্ভাবনাও অনেক কমে যায়।

দেশের সরকারি হাসপাতালগুলোর বহির্বিভাগে বহু রোগী আসে। সীমিত জনবল এবং ওষুধপত্র দিয়ে সব সময় মানসম্পন্ন সেবা প্রদানের কাজটি তাই কঠিনই বটে। মোবাইল ফোন স্বাস্থ্যসেবার ব্যাপক প্রচার হলে অনেক রোগী ঘরে বসেই চিকিৎসকের পরামর্শ নেবেন। ফলে হাসপাতালগুলোর ওপর চাপ কমবে। তখন সীমিত জনবল ও সম্পদ দিয়েই আগত রোগীদের ভালো চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব হবে। রোগীদের সন্তুষ্টিও বৃদ্ধি পাবে।

দেশের বিভিন্ন পর্যায়ের হাসপাতালে উন্নত মানের টেলিমেডিসিন সেবা চালু আছে। শিগগিরই যুক্ত হচ্ছে আরও কিছু হাসপাতাল। এই সেবা চালুর ফলে উপজেলা ও জেলা পর্যায়ে হাসপাতালে ভর্তি রোগীরা আধুনিক মানের টেলিমেডিসিন পদ্ধতিতে বিশেষায়িত হাসপাতালের চিকিৎসকদের পরামর্শ নিতে পারছেন।

এতে একটি ইউনিক আইডেন্টিটি নাম্বার দেওয়া হয়, যার মাধ্যমে সবাইকে দেওয়া হবে স্বাস্থ্যসেবা, পেনশন সেবা ও অন্যান্য অনেক সামাজিক সুবিধা। এই আইডেন্টিটিকে তুলনা করা যায় বাংলাদেশের ইউনিক জাতীয় পরিচয়পত্র সুবিধার সঙ্গে।

পরিচয়পত্র যাচাইযোগ্য করা সম্ভব হলে তা ই- স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের মূল উপাদান হয়ে উঠতে পারে। এই ইউনিক আইডেন্টিটির প্রযুক্তিগত দিক ও চ্যালেঞ্জসমূহ নিয়ে আমরা আমাদের প্রযুক্তিগত সিস্টেম কাজে লাগাতে পারি। এনআইডি ও অন্যান্য ডাটাবেজের ক্ষেত্রে অন্যতম উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে তথ্যের গোপনীয়তা। তবে এস্তোনিয়া, বোতসোয়ানা, থাইল্যান্ড ও কোরিয়ার ই-হেলথ সেবার সফলতার উদাহরণ আমাদের প্রেরণা হিসেবে কাজ করতে পারে।

ইউনিক আইডির অভাবে বিশ্বের প্রায় ২ বিলিয়ন মানুষ অনেক প্রয়োজনীয় সামাজিক সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। বিশ্বব্যাপী ইউনিক আইডেন্টিটির অত্যন্ত প্রয়োজন সামাজিক ও অর্থনৈতিক সুবিধা গ্রহণ ও লিঙ্গসমতা আনার জন্য। কারণ আইডেন্টিটি কার্ড নেই এমন মানুষের মধ্যে অধিকাংশ হচ্ছেন নারী। এতে তারা উন্নতি ও সেবাপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়ছে। ইউনিক আইডেন্টিটি ব্যাবহারের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সমস্যা কীভাবে দূর করা যায় তা ভাবতে হবে।

বাংলাদেশের বর্তমান স্বাস্থ্যসেবায় ইলেকট্রনিক ব্যবস্থাসমূহ ও তার অপ্রতুলতার কারণে ৬২ শতাংশ স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারীদের মধ্যে ই-স্বাস্থ্যসেবার বিষয়ে জ্ঞান রয়েছে, তাদের মধ্যে এর প্রতি ইতিবাচক মনোভাব আছে ৫৯ শতাংশের। স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রে সাইবার-ক্রাইম প্রতিরোধে পর্যাপ্ত আইন নেই।

আমাদের দেশেও প্রত্যেক রোগীর জন্য ইউনিক আইডেন্টিফায়ার নিয়ে কাজ করতে হবে। ডাটাবেজে তথ্য সংরক্ষণ করতে হবে যাতে রোগীদের যেকোনো সময় যেকোনো কাজে প্রবেশাধিকারের সুযোগ থাকে। আবার ডাটাবেজ ও ইউনিক আইডেন্টিটি সিস্টেম থাকলেই হবে না, ডাটাবেজ যাতে হ্যাকড না হয়, সেটা নিশ্চিত করতে হবে।

বাংলাদেশের জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরি হয় নির্দিষ্টভাবে ভোটাধিকার নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে। একে অন্যান্য ক্ষেত্রে ব্যবহারযোগ্য করার দায় স্বাভাবিকভাবেই নিতে চান না নির্বাচন কমিশন। তাই এর বহু ব্যবহার নিশ্চিত করতে সরকারি নীতিমালা বা আইনের বিকল্প নেই।

প্রযুক্তি গ্রহণে সেবা প্রদান ও গ্রহণকারীদের অনীহা রয়েছে। প্রযুক্তি ব্যবহার করে ডাটা সংরক্ষণের ব্যবস্থা আমলাতান্ত্রিক ও সময়সাপেক্ষ হওয়ায় সেবাপ্রদানকারীরা অনীহা প্রকাশ করেন। বর্তমানে ডাটাবেজে কোনো গোপনীয়তা লঙ্ঘনজনিত ইস্যু নেই। তবে এই আইডেন্টিটির নানা ইস্যু সমাধানের জন্য সরকারের অনেক সংস্থাকে একসঙ্গে এগিয়ে আসতে হবে আর এর নির্দেশ আসতে হবে সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে। ই-স্বাস্থ্যসেবায় যাচাইযোগ্য ইউনিক পরিচয়পত্র নিয়ে কাজ করতে সরকারি-বেসরকারি উভয় পর্যায়ের সম্মিলিত কার্যক্রম প্রয়োজন, তাহলে ই-স্বাস্থ্যসেবা দ্রুত জনপ্রিয় হবে সবার মাঝে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *