হীরেন পণ্ডিত: স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে দেশে সাশ্রয়ী মূল্যে নিরবচ্ছিন্ন ইন্টারনেট ব্যান্ডউইডথ সরবরাহ নিশ্চিত করতে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ সাবমেরিন ক্যাবল কোম্পানিকে সর্বাত্মক উদ্যোগ নেওয়ার নির্দেশনা হয়েছে অনেক আগে থেকেই। সাবমেরিন ক্যাবল স্মার্ট বাংলাদেশ বাস্তবায়নের জন্য দেশের অত্যন্ত অপরিহার্য টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি অবকাঠামো। স্মার্ট প্রযুক্তির চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সাবমেরিন ক্যাবল কোম্পানিকে একটি সময়োপযোগী দক্ষ প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলার বিকল্প নেই। ২০০৭ সালে প্রতি এমবিপিএস ইন্টারনেট ব্যান্ডউইডথের দাম ছিল ৮৫ হাজার টাকা। সরকার জনগণের কাছে ইন্টারনেটের দাম সাশ্রয়ী করতে তা বর্তমানে সর্বনিম্ন মাত্র ৬০ টাকায় নামিয়ে এনেছে, এটি ভালো উদ্যোগ।
বিনা মাশুলে ১৯৯২ সালে বাংলাদেশে সাবমেরিন ক্যাবল সংযোগের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করায় বাংলাদেশ তথ্যপ্রযুক্তি দুনিয়া থেকে পিছিয়ে পড়ে। ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল এবং পরবর্তী সময়ে ২০০৮ সালে ডিজিটাল বাংলাদেশ কর্মসূচির হাত ধরে বাংলাদেশ কেবল সেই পশ্চাদপদতা অতিক্রমই করে হাওর, দ্বীপ, চরাঞ্চল ও দুর্গম পার্বত্য অঞ্চলসহ দেশের প্রতিটি ইউনিয়নে ব্রডব্যান্ড সংযোগ পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। দেশে ২০০৮ সালে মাত্র সাড়ে সাত জিবিপিএস ইন্টারনেট ব্যবহার করা হতো এবং ব্যবহারকারী ছিল মাত্র ৭ লাখ।
ইন্টারনেট এখন কোনো বিলাসিতা নয়, বিশ্বের উন্মুক্ত জ্ঞানভান্ডারে প্রবেশপথের চাবিকাঠি। এর গুরুত্ব সুদূরপ্রসারী ও অপরিসীম। আর ইন্টারনেটের গতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ডিজিটাল প্রযুক্তিনির্ভর সব কর্মকাণ্ড। বর্তমানে ব্যবসা-বাণিজ্য, প্রশাসন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, চিকিৎসা, কৃষি, শিল্প, ব্যাংকিং ব্যবস্থা অনেক বেশি ডিজিটাল প্রযুক্তিনির্ভর। অনলাইনে পাঠদান, এমনকি টেলিমেডিসিন সেবা গ্রহণেও অনলাইন নির্ভরতা বেড়েছে। বিশ্ব যেখানে অপারেশন পরিচালনা করছে ইন্টারনেটের মাধ্যমে সেখানে বাংলাদেশ চিকিৎসা পরামর্শও ঠিকভাবে দিতে পারছে না। প্রশ্ন হলো, এত কম গতির ইন্টারনেট নিয়ে বাংলাদেশ এগোবে কীভাবে? দ্রুতগতির ইন্টারনেটের কোনো বিকল্প নেই। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে প্রকৃত মানবসম্পদ তৈরিতে উচ্চগতির ইন্টারনেট এখন একটি মৌলিক অনুষঙ্গ।
ইন্টারনেটের গতি দ্রুত করার পাশাপাশি দেশের সব মানুষের কাছে সেবা পৌঁছে দিতে হবে। বাংলাদেশে ইন্টারনেটের দাম তুলনামূলক কম। কিন্তু সেবার মান নিয়ে নানা প্রশ্ন রয়েছে। নিরবচ্ছিন্ন মোবাইল ইন্টারনেট সেবা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মেলে না। এজন্য মোবাইল অপারেটরদের পাশাপাশি বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনেরও (বিটিআরসি) দায়িত্ব রয়েছে। উন্নত ও নিরবচ্ছিন্ন ইন্টারনেটসেবা প্রদানে আইএসপির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। বিশেষ করে কোভিড-১৯ মহামারির সময় দেশব্যাপী ইন্টারনেট সংযোগ সচল রেখে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা কার্যক্রম চালু রেখে, বিভিন্ন অফিস, আদালত ও বাসাবাড়িতে ইন্টারনেটসেবা সচল রাখার মাধ্যমে দেশের ভেতরে ও বহির্বিশ্বে যোগাযোগব্যবস্থা সচল রেখেছে, যা সব মহলে প্রশংসিত হয়েছে।
বৈশ্বিক ইন্টারনেট প্রযুক্তির উন্নতি ও অগ্রগতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বাংলাদেশে নেটওয়ার্ক যন্ত্রপাতির আধুনিকায়ন, উন্নতকরণ, সাইবার নিরাপত্তা, দ্রুতগতির দীর্ঘস্থায়ী ও সাশ্রয়ী ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছাতে সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন অত্যন্ত জরুরি ও গুরুত্বপূর্ণ।
তথ্যপ্রযুক্তির অগ্রগতিতে মানুষের জীবন দিন দিন হয়ে উঠছে সহজ ও গতিশীল। আর এ গতিশীল পথ সহজ করার অন্যতম উপায় হলো দ্রুতগতির নেটওয়ার্কিং সিস্টেম। স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে নিরবচ্ছিন্ন ইন্টারনেটসেবা অত্যন্ত জরুরি। কিন্তু দেশে সাবমেরিন ক্যাবলের সংখ্যা পর্যাপ্ত নয়। যে কারণে কোনো একটি ক্যাবল কোনো কারণে কাটা গেলে কিংবা কোনো কারণে সাময়িক বন্ধ থাকলে ইন্টারনেটসেবা ব্যাহত হয়। সম্প্রতি ‘সি-মি-উই ৫’ সাবমেরিন ক্যাবল ইন্দোনেশিয়া অংশে কাটা পড়ে। এতে বাংলাদেশসহ ১৬টি দেশ এ ক্যাবলে যুক্ত থাকলেও সেবা ব্যাহত হয় শুধু বাংলাদেশে। এই খাতসংশ্লিষ্টদের মতে, এর পেছনে দায়ী অপর্যাপ্ত সাবমেরিন ক্যাবলের ওপর নির্ভরশীলতা।
একাধিক বিকল্প না থাকায় যেকোনো দুর্ঘটনায় দেশে ইন্টারনেটসেবা ব্যাহত হয়। বাকি দেশগুলোয় পর্যাপ্ত বিকল্প সাবমেরিন ক্যাবল থাকায় এ সেবা ব্যাহত হচ্ছে না। দেশে সাবমেরিন ক্যাবল মোটে দুটি। প্রথম সাবমেরিন ক্যাবল দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া-মধ্যপ্রাচ্য-পশ্চিম ইউরোপ-৪ ‘সি-মি-উই ৪’। বর্তমানে সমুদ্রের তলদেশের এই ক্যাবলের মাধ্যমে প্রায় ৮০০ জিবিপিএস ব্যান্ডউইডথ সরবরাহ করা হয়, যা ২০০৬ সালে বাংলাদেশে সংযুক্ত হয়েছিল।
আর দ্বিতীয় সাবমেরিন ক্যাবল ‘সি-মি-উই ৫’। এর সক্ষমতা ১ হাজার ৬০০ জিবিপিএস, যা দেশের প্রথম সাবমেরিন ক্যাবলের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ। ‘সি-মি-উই ৫’ ক্যাবলটি সিঙ্গাপুর থেকে ৪৪০ কিলোমিটার পশ্চিমে ইন্দোনেশিয়া অংশে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে বন্ধ হয়ে যায় সিঙ্গাপুর অভিমুখী সব ধরনের ট্রাফিক। এ অবস্থায় দেশের ৯০ শতাংশ ডাটা ট্রাফিক সিঙ্গাপুরভিত্তিক হওয়ায় এবং অধিকাংশ কোম্পানি সিঙ্গাপুরের সার্ভার ব্যবহার করায় ইন্টারনেট সরবরাহ স্বাভাবিক রাখা কঠিন হয়ে পড়ে, বিঘ্ন সৃষ্টি হয় দেশে ইন্টারনেট সেবাপ্রাপ্তিতে।
এ ধরনের পরিস্থিতি এড়াতে ক্যাবলের সংখ্যা বাড়ানো উচিত। ক্যাবলের সংখ্যা বেশি হলে সেগুলো দিয়ে পরিস্থিতি অনেকটা স্বাভাবিক রাখা সম্ভব। পাশাপাশি সার্ভার বেছে নেওয়ার বিষয়টিকেও গুরুত্ব দিতে হবে। দেশে সার্ভার স্থাপন করা যায় কি না তা নিয়ে কাজ করা জরুরি। আমাদের প্রায় সব ডাটা সেন্টার সিঙ্গাপুরভিত্তিক। ফলে ৯০ শতাংশ ডাটা ট্রাফিক সিঙ্গাপুরকে ঘিরে হয়েছে।
ইন্দোনেশিয়ায় ক্যাবল কাটা পড়ায় সিঙ্গাপুরের সঙ্গে সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ায় অতিরিক্ত ডাটা ভারত হয়ে সিঙ্গাপুরের সঙ্গে সংযুক্ত হয়। টেলিযোগাযোগ খাতের বাজার গবেষণা প্রতিষ্ঠান টেলিজিওগ্রাফির তথ্য অনুযায়ী, ‘সি-মি-উই ৫’-এর সঙ্গে ১৬টি দেশ ১৮টি ল্যান্ডিং স্টেশনের মাধ্যমে যুক্ত। ১৬টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশই সবচেয়ে কম সাবমেরিন ক্যাবলে যুক্ত। টেলিজিওগ্রাফির হিসাব অনুযায়ী, প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমার চারটি সাবমেরিন ক্যাবলে যুক্ত। মালয়েশিয়া সাবমেরিন ক্যাবলের ল্যান্ডিং স্টেশন ২৯টি।
সিঙ্গাপুর যুক্ত ৩৮টিতে আর ইন্দোনেশিয়া নিজে ৬৫টি ক্যাবলের মাধ্যমে সংযুক্ত। এ ছাড়া শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তান যথাক্রমে ৯টি ও ১০টি সাবমেরিন ক্যাবলে যুক্ত। বাংলাদেশেও সাবমেরিন ক্যাবলের সংখ্যা বাড়াতে সরকারের পক্ষ থেকে উদ্যোগ নিতে হবে। কেননা ইন্টারনেটের সঙ্গে আমাদের বাণিজ্যিক সম্পর্কও জড়িত। এ সমস্যা সমাধান না হলে এবং এর বিকল্প তৈরি না হলে অর্থনৈতিকভাবে বড় ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
সাধারণ ব্যবহারকারীরা ইন্টারনেট ব্যবহারে খুব বেশি সমস্যার সম্মুখীন না হলেও ফ্রিল্যান্সার এবং দেশের বাইরের কোম্পানির সঙ্গে চুক্তিবদ্ধভাবে কাজ করা কোম্পানিগুলোর কাছে নিরবচ্ছিন্ন সেবা না পাওয়া বেশ ভোগান্তির। এতে আর্থিকভাবে তাদের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। দেশে ব্যান্ডউইডথের চাহিদা এবং জোগান সমপর্যায়ে রয়েছে। ফলে একদিকে আমাদের কোনো উদ্বৃত্ত নেই, অন্যদিকে আমাদের কোনো বিকল্প সোর্স নেই। যার কারণে দুটি ক্যাবলের একটি কাটা পড়ায় এ সংকট তৈরি হয় এবং এটি দীর্ঘায়িত হয়।
বাংলাদেশ সাবমেরিন ক্যাবলস কোম্পানি (বিএসসি) সূত্রে জানা যায়, বিচ্ছিন্ন হওয়া ক্যাবল মেরামত করতে ইন্দোনেশিয়া সরকারের অনুমতি লাগে। সবকিছু ঠিকঠাক করে ইন্টারনেটের গতি ফিরে পেতে প্রায় অনেক সময় লাগে। ইন্টারনেট একটি জরুরি সেবা। সবসময় এর বিকল্প ব্যবস্থা রাখা উচিত। দেশের অর্থনীতি এখন তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর হয়ে পড়েছে। ব্যান্ডউইডথের বিকল্প উৎস এখন সময়ের দাবি। সাবমেরিন ক্যাবলের সংখ্যা বাড়ানোর পাশাপাশি আন্তর্জাতিক টেরিস্টিয়াল কেবল (আইটিসি) সংযোগও বাড়ানো উচিত। তবে শুধু সংযোগ বাড়ালেই হবে না, ক্যাবলের রক্ষণাবেক্ষণ ও গুরুত্বপূর্ণ নির্বিঘ্ন ইন্টারনেট সেবা অব্যাহত রাখতে।
ব্যান্ডউইডথের সহজলভ্যতা ও রিডান্ডেন্সি নিশ্চিত করতে এবং সাবমেরিন ক্যাবলের রক্ষণাবেক্ষণ বা প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে ইন্টারনেট ব্ল্যাকআউটের ঝুঁকি কমাতে বাংলাদেশ ২০১১ সালে প্রথম আইটিসি লাইসেন্স চালু করে। যদিও সাবমেরিন ক্যাবলের মাধ্যমে ব্যান্ডউইডথ সরবরাহ বেশি উপযোগী। কেননা সাবমেরিন ক্যাবলে বিনিয়োগ এককালীন ব্যয়, কিন্তু আইটিসি কোম্পানিগুলোকে প্রতি মাসে ব্যান্ডউইডথের জন্য বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় করতে হয়। তবু সাবমেরিন ক্যাবলে বিপর্যয়ের দিনে আইটিসি সংযোগ বিকল্প হিসেবে কাজ করতে পারে। এ দুই সাবমেরিন ক্যাবলের বাইরে প্রায় ২ হাজার ৭০০ জিবিপিএস ব্যান্ডউইডথ আন্তর্জাতিক টেরিস্টিয়াল ক্যাবল (আইটিসি) মাধ্যমে স্থলসীমান্ত দিয়ে ভারত থেকে আমদানি করা হয়।
বিএসসিপিএলসি মারফত জানা যায়, এরই মধ্যে তৃতীয় সাবমেরিন ক্যাবল সিমিইউ-৬ সংযোগের কাজ চলছে। এটি ২০২৫ সালে চালু হওয়ার কথা। এ সংযোগ চালু হলে ১৩ হাজার ২০০ জিবিপিএস ব্যান্ডউইডথ যুক্ত হবে। আশা করা যায়, এটি চালু হলে আগামীতে এ ধরনের বিপর্যয় এতটা প্রকট হবে না। বর্তমানে প্রায় ১২ কোটি মানুষ মোবাইলে ইন্টারনেট ব্যবহার করছে। আমরা স্মার্ট বাংলাদেশের কথা বলছি। সেটা প্রযুক্তিগতভাবে একটি ভালো দিক। কিন্তু স্মার্ট মানুষ যখন নীতিহীন হয় তারা তখন ভয়ংকর রূপ ধারণ করে, সেটাও মনে রাখা দরকার। যেখানে বর্তমানে মানুষের বিভিন্ন কাজ এখন অফলাইনের পরিবর্তে অনলাইনে করা সম্ভব হচ্ছে। শিক্ষাব্যবস্থা থেকে শুরু করে অফিস-আদালত-অর্থনীতি সবকিছুই চলে অনলাইনে। কিন্তু দেখা যায়, এ অনলাইনের সুযোগ নিতে ভোগান্তির কবলে পড়তে হয় অনেক সময়।
অনেকে অভিযোগ করেন মোবাইল নেটওয়ার্কিং সিস্টেম খুবই বাজে। অনেক সময় তাদের প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্তও সংগ্রহ করতে পারছে না অনলাইন থেকে। বিষয়টি বিবেচনা করে অনলাইন সুবিধা সহজ করার জন্য দায়িত্বশীলদের এগিয়ে আসতে হবে এবং নিরবচ্ছিন্ন ইন্টারনেট নিশ্চিত করতে হবে।