হারিয়ে যাচ্ছে সামাজিক ও মানবিক মূল্যবোধ


হীরেন পণ্ডিত: মানুষের পরিবার, সমাজ বা রাষ্ট্র আরোপিত সব নিয়ম-নীতি ও আচরণবিধি জীবনকে প্রভাবিত করে। এই নিয়মগুলো মেনে চলার প্রবণতা, মানসিকতা ইত্যাদি নীতির চর্চা করাকে বলা যায় নৈতিকতা। নৈতিকতাকে আরেক অর্থে আমরা বলতে পারি মূল্যবোধ। নৈতিকতার মধ্যে লুকিয়ে আছে সততা, মহত্ত্ব, ন্যায়পরায়ণতা ও আদর্শবাদিতা। অপরদিকে মূল্যবোধ বলতে বোঝায় মানুষের আচরণকে পরিচালনা করে যেসব নীতি ও মানদণ্ড তা। মানুষের আচরণের মানদণ্ড তার নিজ নিজ বিশ্বাস ও নীতির ওপর নির্ভর করে।

পৃথিবীর সব মানুষের বিশ্বাস ও নীতি এক হয় না। একজন সচেতন মানুষ সামাজিক চাপে পড়ে বা ব্যক্তিগত, সমষ্টিগত স্বার্থের কারণে নয়, অথবা কোন পার্থিব ভয় বা প্রলোভনের কারণে নয়, বরং নৈতিক মূল্যবোধ ও বিবেককে প্রাধান্য দিয়ে তার সব কাজ সম্পাদন করেন। তবে তিনিই প্রকৃতপক্ষে নৈতিক মূল্যবোধ সম্পন্ন মানুষ হিসেবে বিবেচিত বা স্বীকৃত হবেন সমাজ বা রাষ্ট্রের কাছে। মূল্যবোধ গড়ে ওঠে দীর্ঘদিন একই সমাজে একসঙ্গে বসবাস করার ফলে যেসব অভিজ্ঞতা অর্জিত হয় তা থেকে।

নীতি-নৈতিকতা বা মূল্যবোধ এসব একটি সমাজ বা রাষ্ট্রের মূল চালিকাশক্তি। এসবের অভাব রাষ্ট্রের সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক মানদণ্ডকে সমালোচিত করে। মানুষের আচরণের মানদণ্ড বিশ্বাস ও নীতির ওপর নির্ভর করে। সে বিশ্বাস ও নীতিই হলো মূল্যবোধ বা নৈতিকতা। নৈতিকতা সম্পর্কে সচেতনতা জাগরণের শিক্ষাকেই মূল্যবোধের শিক্ষা বলা যায়। নৈতিক শিক্ষা ও মূল্যবোধ মানুষকে তার মানবতাবোধ জাগ্রত করতে সহায়তা করে থাকে। নৈতিক আদর্শ সংবলিত সমাজ বলতে বোঝায়, যে সমাজে কোন অনাচার, দুর্নীতি, শোষণ, নিপীড়ন, স্বার্থপরতা এসব অনৈতিক চর্চা থাকবে না। সেই সমাজকেই নৈতিকতার আদর্শে আবর্তিত সমাজ বলা হয়। সব ধরনের দুর্নীতি, অন্যায়, অসততা থেকে মুক্ত জীবনই আদর্শ জীবন হিসেবে বিবেচিত হয়।

তবে আজকাল আমরা নিজেদের প্রাপ্তির জন্য আমরা সবাই আত্মকেন্দ্রিক হয়ে কাজ করছি। সবাই নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত আছি। দেশ আর সমাজ নিয়ে কী ভাবছি আমরা? আর কতদিন অপেক্ষা প্রয়োজন হবে নিজেকে একজন আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য? জাতি হিসেবে কি আমরা খুব একটা এগোতে পারছি? খুব একটা এগোচ্ছি বলে মনে হয় না, কিছু ভালো অর্জন আমাদের আছে! সেগুলোও নষ্ট হয়ে যায় কাদা ছোড়াছুড়িতে। এই নৈতিক অবক্ষয়ের কারণে আমাদের সব অর্জন ম্লান হয়ে যাচ্ছে। আমরা আমাদের অর্জনকে ধরে রাখতে পারছি না। প্রতিদিন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, টেলিভিশন ও জাতীয় দৈনিকে নানারকম ভয়াবহ নেতিবাচক খবর দেখে মন খারাপ হয়ে যায়। খুন, অপহরণ, ধর্ষণ, শারীরিক নির্যাতন ও আঘাতের খবরে এ মাধ্যমগুলো ভরা থাকে। অপরাধগুলো একটি শহরে কিংবা বিশেষ অঞ্চলে সীমাবদ্ধ নয়। দেশের প্রায় সব শহর, বন্দর, গ্রামগঞ্জ, অভিজাত এলাকা কিংবা প্রত্যন্ত জনপদে এসব ভয়াবহ অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে। অপরাধীদের মধ্যে কুখ্যাত সন্ত্রাসী বা মাস্তান যেমন রয়েছে, তেমনি সাধারণ জীবনযাপনকারী পারিবারিক সদস্যও রয়েছে।

বিশেষ করে পারিবারিক পর্যায়ে যে নৃশংস ও অবিশ্বাস্য ধরনের অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে, তাতে মনে হচ্ছে অপরাধীরা আসলে মানসিক রোগী। মনোরোগে আক্রান্ত ছাড়া এ ধরনের নৃশংস অপরাধ কেউ করতে পারে না। নৃশংস অপরাধকে এখনও আইনশৃঙ্খলার সমস্যা হিসেবে দেখা হয়। সভা-সেমিনার, ওয়ার্কশপ কিংবা গোলটেবিল আলোচনায় সমাজবিজ্ঞানী, মনোবিজ্ঞানী, মনোচিকিৎসক ও স্নায়ুরোগ বিশেষজ্ঞদের উপস্থিতি বড় একটা দেখা যায় না। আমরা প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট, রাজনীতিবিদ, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, সমাজবিজ্ঞানী ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তাদের নিয়ে এসব অনুষ্ঠান আয়োজন করে থাকি। সময় এসেছে, এখন আমাদের সমস্যার আরও গভীরে যেতে হবে। অপরাধীকে শাস্তি দেওয়ার পাশাপাশি মানসিক রোগী হিসেবে তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। দেখতে হবে, আমাদের দেহ-মনে এমন মারাত্মক কোনো জীবাণু বা রাসায়নিক দ্রব্য অবস্থান নিয়েছে কি না, যা আমাদের দলে দলে মানসিক রোগী করে তুলছে। সুস্থ ব্যক্তিরা যাতে এ রোগে আক্রান্ত না হয় সে জন্য আগেভাগে ব্যবস্থা নিতে হবে। কখনো ব্যক্তিপর্যায়ে, কখনো সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে।

এই যে আমাদের নতুন প্রজন্ম, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্ম, আমরা কি তাদের কথা ভাবী? তারা ভবিষ্যতের হাল ধরবে, তাদের সেভাবেই তৈরি করতে হবে আমাদের। প্রত্যেক বাবা-মা কি তাদের সন্তানের খোঁজখবর রাখেন? সন্তানকে কীভাবে আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা যায় তা নিয়ে কি ভাবেন? সন্তানের বাবা-মা ব্যস্ত রয়েছেন জীবনযাত্রার মান বাড়ানোর জন্য, দিনরাত পরিশ্রম করে আনা অর্থ কোনো কাজে লাগছে কি না সে বিষয়ে কারো চিন্তা করার সময় নেই। সন্তান কী শিখছে, কী করছে, কোথায় যাচ্ছে, কার সঙ্গে মিশছে, সে খেয়াল রাখার মতো অবস্থায় আমরা নেই। কিন্তু কেন, এমন তো হওয়ার কথা ছিল না! কেন এমন হলো তা নিয়ে সরকার ও নাগরিক সমাজকে ভাবতে হবে। সমন্বিত প্রচেষ্টা ছাড়া এগুলো থেকে বের হয়ে আসা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। এখন টাকাই সব, টাকার জন্য সবকিছুই করা সম্ভব। আমরা শুধু টাকার পেছনে দৌড়াচ্ছি। টাকার জন্য মান-সম্মান, আত্মসম্মানবোধ বিসর্জন দিতে প্রস্তুত আছি! অন্যদিকে সমাজ বিনির্মাণে, রাষ্ট্রের একজন আদর্শ নাগরিক হিসেবে রাষ্ট্র, সমাজ ও পরিবারে আমাদের যে কিছু দায়িত্ব রয়েছে, সেগুলো আমরা সঠিকভাবে পালন করছি কি না, কিংবা বেমালুম ভুলে যাচ্ছি কি না, সেটা ভেবে দেখার সময় এসেছে।

ব্যবসায় মুনাফা করতে হবে, এটাই নিয়ম। তবে নিজের মনুষ্যত্ব বিসর্জন দিয়ে নয়, দেশের মানুষের কল্যাণ হয় না, শুধু নিজের লাভের জন্যই তা আমরা অনেক সময় করে থাকি। শুধু নিজের মুনাফা অর্জনের জন্য আমরা যেন একটি জাতিকে ধ্বংস করে না দিই, সেদিকে আমাদের লক্ষ্য রাখতে হবে, একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে। একজন ওষুধ কোম্পানির মালিক, খাবার প্রস্তুতকারী কোম্পানির মালিকসহ সবাইকে এটা মনে রাখতে হবে, তার ভেজাল মেশানোর কারণে হাজার হাজার মানুষ অসুস্থ হয়ে যেতে পারে, এমনকি মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। ভেজাল খাবার ও ভেজাল ওষুধ একটি জাতিকে ধ্বংস করে দিতে পারে। এসব দিক মনে রেখেই কাজ করতে হবে। কিন্তু আমরা কি তা করছি? আমার ব্যক্তিগত স্বার্থ হাসিল করতে পারলেই হলো। অন্যের কী হলো, দেশের কী হলো তা নিয়ে আমাদের মাথা ঘামানোর সময় নেই।

নিজের কাছে যদি নৈতিকতা না থাকে তাহলে জাতি বা দেশ তার কাছ থেকে কী আশা করতে পারে? একজন মানুষ যদি তার পবিত্র নৈতিকতাকে বিসর্জন দিয়ে দেয়, তা হলে তো আর কিছু বলার থাকে না। একটা শিশু জন্মের পর থেকে তার পরিবার থেকে নৈতিক মূল্যবোধ অর্জন করে থাকে। যে পরিবারের সদস্যদের নৈতিকতা ও মূল্যবোধ সম্পর্কে কোনো শিক্ষা দেওয়া হয় না, সে পরিবারে দুঃখ-কষ্টের কোনো সীমা নেই। ফলে সে পরিবারের কেউ নৈতিকতা ও মানবিক মূল্যবোধ অর্জন করতে পারে না। যখন কারো মাঝে মনুষ্যত্ব থাকে না তখন তার মাঝে পশুত্ব এসে ভর করে। এভাবেই একটি পরিবারে অমানুষের জন্ম হয়। যার কারণে এভাবে শুধু যে একটি পরিবারেরই ক্ষতি হয় বিষয়টি তা নয়। সাপে কাটলে যেমন বিষ পুরো শরীরে ছড়িয়ে পড়ে তেমনি সমাজে একজন খারাপ মানুষ থাকলে তার দ্বারা পুরো সমাজ প্রভাবিত হয়।

আজকাল মানুষের মাঝে মনুষ্যত্ব নেই বললেও খুব একটা বাড়িয়ে বলা হয় না, নেই কোনো নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধ। মানবিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের ফলে সমাজে নিষ্ঠুর ও অশ্লীল কাজগুলোর পুনরাবৃত্তি ক্রমবর্ধমান হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। যার কারণে দেশ ও জাতিকে সংকটে পড়তে হয়। বিশ্বের দরবারে মুখ দেখানো আজ বড়ই কঠিন পরিস্থিতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। অপরদিকে একজন মানুষ যদি নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন হয় তাহলে তার জীবন হয় সহজ, সুন্দর ও আলোকিত। তাই সমাজের একজন মানুষও যেন অমানুষ না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। প্রত্যেকটি পরিবারের দায়িত্ব ছোটবেলা থেকেই আপনার সন্তানকে নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা। সন্তান অমানুষ হোক তা কখনো কোনো বাবা-মার কাম্য নয়, তবু যদি এমনটি হয়ে যায় তাহলে তাকে নিয়মিত কাউন্সেলিং করুন, তাকে ঘৃণা না করে বুঝিয়ে সুপথে ফিরিয়ে আনার আপ্রাণ চেষ্টা করুন। তার মাঝে মনুষ্যত্ববোধ জাগিয়ে তুলুন।

মানুষ মানুষের জন্য, জীবন জীবনের জন্য-সবার জানা মর্মকথাটি আমাদের সমাজে যেন হয়ে পড়েছে অর্থহীন। কোথায় মানুষ, মনুষ্যত্ব আর মানবতা। মানুষের প্রতি মানুষের বিশ্বাস, শ্রদ্ধা, ভালোবাসা, ভ্রাতৃত্ববোধ নেই বললেই চলে। মানবিক মূল্যবোধ এবং একে অন্যের প্রতি দায়িত্বশীল মনোভাব গড়ে তুলতে হবে। বর্তমানে বাংলাদেশে যৌথ পরিবারের সংস্কৃতি বিলীন হওয়ার পথে। মূল্যবোধের অবক্ষয়ের ফলে মানুষ হয়ে পড়ছে আত্মকেন্দ্রিক আর স্বার্থবাদী। সমাজ হয়ে পড়ছে বিকারগ্রস্ত। এজন্য আমাদের চাই সামাজিক বিপ্লব। যার মাধ্যমে গড়ে উঠবে একটি সামাজিক ও মানবিক মূল্যবোধের সমাজ।

মহান মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ মানুষ জীবন দিয়েছিলেন আর দুই লাখ মা-বোন তাদের সম্ভ্রম হারিয়েছিলেন শোষণ-নিপীড়নমুক্ত সমাজ গঠন করতে। তারা চেয়েছিলেন একটি স্বাধীন দেশ আর আত্মমর্যাদা নিয়ে বেঁচে থাকার অধিকার। যে সমাজে নারী-পুরুষ ভোগ করবে সমান অধিকার। নারী ও শিশুদের জন্য একটি নিরাপদ সমাজব্যবস্থা গড়তে পারিনি আমরা।

আমাদের মাঝে রয়েছে কি সত্যিকার দেশপ্রেম? আজকের শিশু আগামীর ভবিষ্যৎ। নানা বিষয়ে শিক্ষাদানের পাশাপাশি তাদের শেখাতে হবে সামাজিক ও পারিবারিক মূল্যবোধ। তাদের মেধা ও মননের বিকাশ ঘটিয়ে গড়ে তুলতে হবে দেশপ্রেমিক, সৎ ও ভালো মানুষ হিসেবে। পারিবারিক মূল্যবোধ একজন মানুষের সারা জীবনের পাথেয়। অস্থির সমাজ থেকে রক্ষা পেতে প্রয়োজন সামাজিক মূল্যবোধের পাশাপাশি সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের লালন।

আমাদের মেধা ও মননের সার্বক্ষণিক চর্চা অপ্রয়োজনীয় হয়ে দাঁড়ায়। গতানুগতিক আনুষ্ঠানিকতার পথ ছেড়ে কষ্টকর বিকল্প পথ ধরতে কার মন চায়? প্রয়োজনও-বা কী এটাই মনে করেন অনেকে আর আমাদের যেভাবে আগের অবস্থা চলে এসেছে, সে অবস্থা থেকে খুব একটা বের হওয়ার আগ্রহ আমরা প্রকাশ করি না। তাই প্রকৃত মেধাবীর সংখ্যা আমাদের সমাজে ক্রমেই কমে আসছে। সামাজিক অবক্ষয়ের পাল্লা ভারী হচ্ছে। নানা কারণে আমাদের সমাজে মেধাবী কম না হলেও আদর্শনিষ্ঠ এবং সৎ ও নীতিপরায়ণ মেধাবী প্রতিবাদী মানুষের সংখ্যা কমে আসছে। কমে যাচ্ছে ব্যতিক্রমী ধারার জনস্বার্থবাদী চিন্তাবিদের সংখ্যা।

স্বভাবতই হ্রাস পাচ্ছে বা শক্তিহীন হচ্ছে অনুরূপ গুণের বৈশিষ্ট্যযুক্ত সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান, যেগুলোকে জনস্বার্থবান্ধব হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। এগুলো সাংস্কৃতিক শূন্যতার অন্যতম কারণ। আর এই অবস্থা থেকে আমাদের উত্তরণের পথ দেখাতে পারে প্রকৃত সংস্কৃতিচর্চা এবং সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড যা আমাদের নৈতিক ও সামাজিক অবক্ষয়কে দূর করে জাতিকে নতুন যুগের পথ দেখাতে পারে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *