বৈশ্বিক উন্নয়ন কর্মসূচির নেতৃত্বে তরুণরা


হীরেন পণ্ডিত: বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শিশুকাল থেকেই ছিলেন জনদরদি। শিশু মুজিব দরিদ্র ও অসহায় ছাত্রদের শিক্ষা দেওয়ার জন্য নিজ পরিবারসহ পাড়াপ্রতিবেশীদের কাছ থেকে চাল সংগ্রহ করতেন। তিনি অনেক ছাত্রের লেখাপড়ার খরচ জুগিয়েছেন। ছাত্রজীবন থেকে দেশ স্বাধীন হওয়া পর্যন্ত অসংখ্যবার কারাবরণ করেছেন। তিনি নিজ আদর্শ এবং দেশের মানুষের কল্যাণের ব্রত থেকে সরে যাননি কখনো। মানুষের অধিকার আদায়ের জন্য পাকিস্তানিদের শত বাধা-বিপত্তি উপেক্ষা করে তিনি মানুষের জন্য লড়াই করেছেন, অধিকাংশ সময় অসহায় জীবনযাপন করেছেন।

বঙ্গবন্ধু শিক্ষা, শিক্ষকদের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ, সহপাঠী ও ছাত্রদের কল্যাণে ছাত্রাবস্থায় নিজেকে সঁপে দেওয়ার ঘটনা, দেশ ও জাতি গঠনে নিজেকে তৈরি করেছিলেন হিতাকাক্সক্ষী শিক্ষানুরাগী, পরোপকারী মানুষের রোল মডেল। তিনি মনে করতেন সোনার বাংলাদেশ গড়ে তুলতে হলে আগে সোনার মানুষ তৈরি করতে হবে। কারণ একটি দেশের প্রধান সম্পদই হচ্ছে মানবসম্পদ। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নই ছিল দেশের মানুষকে সম্পদে পরিণত করা।

বঙ্গবন্ধু আমাদের ছাত্রসমাজকে নিয়ে ভাবতেন। তিনি বলতেন, ছাত্র ও যুবসমাজের প্রতিটি সদস্যকে আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। তারাই হয়ে উঠবে এক আদর্শবান শক্তি। এই আদর্শ মানুষ বলতে তিনি এমন ব্যক্তিকে বুঝিয়েছেন, যে উন্নত মানবিক গুণাবলি ধারণ করবে এবং অন্যের জন্য অনুসরণযোগ্য হবে। অর্থাৎ সামাজিকভাবে যা কিছু ভালো-শ্রেষ্ঠ মহৎ ও কল্যাণকর সবকিছুই থাকবে ছাত্রসমাজের প্রতিটি সদস্যের মধ্যে। আদর্শ মানুষ হতে হলে সবার ভেতর যেসব গুণ থাকা দরকার সেগুলো হলো- সততা, নিষ্ঠা, পরিশ্রমী ও পরোপকারী মনোভাব, মানবদরদি-সহমর্মিতা, নির্লোভ-নিরহংকার এবং সাহস। বঙ্গবন্ধু নিজে ছিলেন একজন আদর্শবাদী মানুষ। বাংলার শোষিত-নির্যাতিত ও নিপীড়িত মানুষের মুক্তিই ছিল তার জীবনের মূল লক্ষ্য ও আদর্শ।

১৯৭৩-এর ১৯ আগস্ট ছাত্রদের উদ্দেশে তিনি বলেছিলেন, ‘বাবারা একটু লেখাপড়া শেখো। যতই জিন্দাবাদ আর মুর্দাবাদ করো, ঠিকমতো লেখাপড়া না শিখলে কোনো লাভ নেই। আর লেখাপড়া শিখে যে সময়টুকু পাবে বাবা-মাকে সাহায্য করবে। প্যান্ট পরা শিখেছ বলে বাবার সঙ্গে হাল ধরতে লজ্জা করো না। দুনিয়ার দিকে চেয়ে দেখো। গ্রামে গ্রামে বাড়ির পাশে বেগুনগাছ লাগাও, কয়টা মরিচগাছ লাগাও, কয়টা লাউগাছ লাগাও, কয়টা নারিকেলের চারা লাগাও। বাপ-মাকে একটু সাহায্য করো। শুধু বিএ-এমএ পাস করে লাভ নেই। দেশের মানুষের কল্যাণে কাজ করতে হবে।’

১৯৭৩-এ ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর বক্তৃতায় তিনি বলেছেন, ‘বাংলার মানুষ, বিশেষ করে তরুণ সম্প্রদায়কে আমাদের ইতিহাস জানতে হবে। বাংলার যে ছেলে তার অতীত বংশধরদের ঐতিহ্য সম্পর্কে জানতে পারে না, সে ছেলে সত্যিকারের বাঙালি হতে পারে না।’ চাওয়া-পাওয়ার ঊর্ধ্বে উঠে ত্যাগ স্বীকার করে এগোতে পারলে সঠিক মানুষ হিসেবে, নেতা হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলা যায়, অর্থ-সম্পদের পেছনে ছুটলে, ওই অর্থ-সম্পদে ভেসে যেতে হয়; নেতৃত্ব দেওয়ার যোগ্যতা থাকে না, দেশকেও কিছু দেওয়া যায় না, মানুষকেও দেয়া যায় না।’ পাশাপাশি ছাত্রদের যেটা সব থেকে বেশি দরকার, লেখাপড়া শিখতে হবে। উপযুক্ত নাগরিক হিসেবে প্রজন্ম বা প্রজন্মের পর প্রজন্মকে প্রস্তুত করতে হবে। সবার মাঝে থাকবে সততা, নিষ্ঠা, পরিশ্রম ও পরোপকারী মনোভাব, মানবদরদি-সহমর্মিতা, নির্লোভ-নিরহংকার এবং সাহস।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর মতে, যুবকদের বয়স ১৫ থেকে ২৯ বছর। সরকারের যুবনীতিতে এই সীমা ১৮ থেকে ৩৫ বছর। বয়সসীমা যদি ২৯ বছর ধরে যুবক হিসেবে ধরা হয়, তাহলে দেশের প্রায় ৪০ শতাংশ মানুষ এর নিচে। দেশের জনসংখ্যার একটি বড় অংশ যুবক। বিভিন্ন আর্থ-সামাজিক বৈচিত্র্যসহ বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবতে হলে তরুণদের কথা ভাবতে হবে। তরুণরা বৈশ্বিক উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়নে নেতৃত্ব দেবে।

তারুণ্য মানবজীবনের সাহসী, সংগ্রামী ও সৃজনশীলতার অধ্যায়। পুরোনোকে ভেঙে, সংস্কার করে নতুন কিছু করাই যেন তারুণ্যের ধর্ম। তরুণদের চিন্তা-চেতনা, মন-মগজে পুরোনোকে সংস্কার করে নতুন কিছু করার ভাবনা তৈরি করতে হবে। সাহস ও সততার সঙ্গে তরুণসমাজকে এই সংস্কার কাজে এগিয়ে আসতে হবে। তরুণরা এগিয়ে এলেই সমাজের সব স্তরে পরিবর্তন শুরু হবে। এক্ষেত্রে তরুণসমাজের সম্মিলিত প্রয়াস সবচেয়ে কার্যকর।

তারুণ্য হলো মানুষের জীবনে সাহস, সংগ্রাম ও সৃজনশীলতার সময়। পুরোনোটা ভেঙে সংস্কার করে নতুন কিছু করা যেন তারুণ্যের ধর্ম। সমাজের এই সংস্কার কাজে তরুণসমাজকে সাহস ও সততার সঙ্গে এগিয়ে আসতে হবে। তরুণরা সমাজের সর্বস্তরে পরিবর্তনের বিপ্লব শুরু করবে এবং এক্ষেত্রে তরুণসমাজের সম্মিলিত প্রচেষ্টাই সবচেয়ে কার্যকর। সমাজে কোনো অনিয়ম বা দুর্নীতি দেখলে তাদেরকে ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিবাদ করতে হবে এবং প্রতিবাদ যদি তরুণসমাজের কাছ থেকে আসে তাহলে তা কেউ ঠেকাতে পারবে না।

প্রান্তিক ও সুবিধাবঞ্চিত যুবকদের জন্য এর মাত্রা আরও বেশি। শিক্ষা, কর্মসংস্থান এবং মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর বিরূপ প্রভাব এবং প্রযুক্তিগত বৈষম্য তরুণদের বিচ্ছিন্নতার দিকে পরিচালিত করছে কি না তা নিয়ে ভাবার সময় এসেছে। তরুণ অনেকেই সমাজের মূল স্রোতধারা থেকে দূরে চলে যাচ্ছে কি না তা দেখতে হবে। তরুণদের এ অবস্থা নানা অসঙ্গতির সৃষ্টি করছে। এ কারণে বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় তরুণদের বিচ্ছিন্নতাকে আরও গভীরভাবে বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন।

আমাদের দেশের তরুণদের অর্জন অনেক। খেলাধুলা, শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে তরুণরা এগিয়ে যাচ্ছে। বিভিন্ন উদ্দীপনা এবং সম্ভাবনাগুলোকে ব্যবহার করে বিভিন্ন উপায়ে এগিয়ে যাচ্ছে তরুণসমাজ। তবে তরুণদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশের শক্তি দেশ ও জাতির জন্য সঠিকভাবে ব্যবহার হচ্ছে কি না তা যেমন স্পষ্ট নয় তেমনি তা নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে। তাদের স্বেচ্ছায় মূলধারায় নেতৃত্ব দিতে হবে।

আজকের তরুণসমাজই ভবিষ্যতের নীতিনির্ধারক। তারা অনিয়ম-দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করলে সমাজ ধীরে ধীরে পরিবর্তন হতে শুরু করবে। তাই রাষ্ট্র ও সমাজের সব কল্যাণমূলক কাজে যুবসমাজের অংশগ্রহণ আবশ্যক। তরুণসমাজ ঘুমিয়ে থাকলে অনিয়ম-দুর্নীতিতে নিমজ্জিত সমাজের আকাশ থেকে কখনো কালো মেঘের ছায়া সরবে না। সমাজ পরিবর্তন করতে হলে তরুণসমাজকে আত্মকেন্দ্রিক চিন্তাধারা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। ক্যারিয়ার গড়ার পাশাপাশি দেশ ও সমাজের কথাও ভাবতে হয়। সকল সমাজকল্যাণমূলক কাজে এগিয়ে আসতে হবে। যৌবন অসীম প্রাণশক্তির উৎস। সেজন্য তারুণ্যকে কাজে লাগিয়ে জীবনকে গতিশীল ও প্রতিশ্রুতিশীল করতে হবে। জরাজীর্ণ সমাজব্যবস্থা সংস্কার করে নতুন কিছু সৃষ্টির জন্য প্রথমে তরুণ সমাজকে জেগে উঠতে হবে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। তবেই সমাজের সর্বস্তর থেকে দুর্নীতি নির্মূল করা সম্ভব। তারুণ্যের শক্তিই পারে সমাজকে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নিতে।

চাকরি সৃষ্টি একটি বড় চ্যালেঞ্জ; দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে ত্রুটিমুক্ত ও দুর্নীতিমুক্ত রেখে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। বাইপাস করে চাকরি পাওয়া সম্ভব নয়। বড় ডিগ্রি নিয়েও কোনো কাজ হচ্ছে না। শিক্ষা ব্যবস্থা বাজারের চাহিদার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ না হওয়ায় দেশে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বাড়ছে।

তরুণদের বেকারত্বকে অর্থনীতির জন্য একটি অন্যতম প্রধান সমস্যা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া আমাদের নীতিমালায় অনুপস্থিত। জাতীয় যুব নীতি ২০১৭ যুবকদের জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে পর্যাপ্ত মনোযোগ দেয়া হয়নি বলে মনে করেন অনেকে। নীতিমালায় তরুণদের কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য কোনো সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা নেই। অবশ্য অর্থনীতিতে বেসরকারি খাতের অবদান বেশি হওয়ায় কর্মসংস্থানের প্রধান উৎস হতে হবে বেসরকারি খাতকে। সেখানে আরও কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে সরকারকে নীতিগত সহায়তা দিতে হবে। আজকের তরুণসমাজ ভবিষ্যতের নীতিনির্ধারক। তারা যদি অনিয়ম আর দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হয়, তাহলে সমাজে ধীরে ধীরে পরিবর্তন আসতে শুরু করবে।

তাই রাষ্ট্র ও সমাজের সকল কল্যাণমূলক কাজে তরুণদের অংশগ্রহণ একান্ত প্রয়োজন। তরুণ সমাজ ঘুমিয়ে থাকলে অনিয়ম আর দুর্নীতিতে নিমজ্জিত সমাজের আকাশ থেকে কালো মেঘের ছায়া কখনো দূর হবে না। সমাজ পরিবর্তন করতে চাইলে তরুণ সমাজকে আত্মকেন্দ্রিক চিন্তাভাবনা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। নিজের ক্যারিয়ার গঠনের পাশাপাশি দেশ ও সমাজ নিয়ে ভাবতে হবে। এগিয়ে আসতে হবে সমাজকল্যাণমূলক সকল কাজে। তারুণ্য হচ্ছে অফুরন্ত প্রাণশক্তির আধার। তাই তারুণ্যকে কাজে লাগিয়ে জীবন করতে হবে গতিশীল ও প্রত্যাশাময়। জরাজীর্ণ সমাজব্যবস্থাকে সংস্কার করে নতুন কিছু রচনার জন্য সবার আগে তরুণসমাজকেই জাগতে হবে।

তরুণরা সুবিধা ও অধিকারবঞ্চিত মানুষের সার্বিক জীবনমান উন্নয়নের লক্ষ্যে বাল্যবিবাহ ও যৌতুক প্রতিরোধে উদ্যোগী ভূমিকা নিচ্ছে। মাদকের সর্বনাশা ছোবল থেকে সমাজকে মুক্ত রাখার লক্ষ্যে তরুণ সমাজকে সচেতন ও সংগঠিত করে গণপ্রতিরোধ গড়ে তুলছে। একটি সুস্থ্য, সুন্দর, উদার ও বহুমাত্রিক সমাজ গড়ে তোলার লক্ষ্যে সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠায় নিয়মিত কর্মশালা, উঠান বৈঠক করছে। অসচ্ছল পরিবারের শিশু-কিশোরদের পড়াশোনায় সহায়তা দিচ্ছে এবং বয়স্ক শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করছে। তরুণ প্রজন্ম যাতে কুসংস্কার ও পশ্চাৎপদতা থেকে বেরিয়ে আসতে পারে; সহিংসতা প্রতিরোধ করতে পারে; বিজ্ঞানমনস্ক এবং যুক্তিবাদী হিসেবে গড়ে উঠতে পারে, সে লক্ষ্যে দেশে বেশি করে বিজ্ঞান ক্লাব গড়ে তোলা প্রয়োজন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *