দুর্যোগঝুঁকি হ্রাস এবং সাড়াদান ব্যবস্থাপনা


হীরেন পণ্ডিত: বাংলাদেশ গাঙ্গেয় বদ্বীপ রাষ্ট্র এবং বঙ্গোপসাগরের সর্ব-উজানে ও তীরবর্তী খুবই ঝুঁকিপূর্ণ ঝড়-জলোচ্ছ্বাসকবলিত অঞ্চল। এশিয়ার অন্যতম সাইক্লোন ঝুঁকিপূর্ণ বাংলাদেশের ৭১০ কিলোমিটার উপকূল দিয়ে প্রায় প্রতি বছরই মাঝারি থেকে বড় ধরনের সাইক্লোনের আবির্ভাব ঘটে এবং কয়েক বছর পরপর প্রলয়ংকরী ঝড়-জলোচ্ছ্বাসে জানমালের প্রভূত ক্ষতিসাধিত হয়। বাংলাদেশ বিশ্বে দুর্যোগপূর্ণ দেশের সূচকে অবস্থান।

জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব প্রেক্ষাপটে দুর্যোগ ঝুঁকিহ্রাসে জনগোষ্ঠীর ক্ষমতায়নের কোনো বিকল্প নেই। সে কারণে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার প্রাতিষ্ঠানিক ও সামাজিক দায়-দায়িত্বের পাশাপাশি সুনির্দিষ্ট পারিবারিক দায়-দায়িত্ব নির্ধারণের বিষয়টিও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাস্তব এই প্রেক্ষাপটে, বিভিন্ন দুর্যোগ ঝুঁকিতে থাকা জনগোষ্ঠীর দুর্যোগ মোকাবিলায় পারিবারিক পর্যায়ে করণীয় সম্পর্কে অভিন্ন সচেতনতার বার্তা প্রচারের লক্ষ্যে অংশগ্রহণমূলক প্রক্রিয়া অনুসরণ করে পারিবারিক পর্যায়ে দুর্যোগ প্রস্তুতি, প্রশমন, প্রতিরোধ, ঝুঁকি হ্রাস ও জলবায়ু পরিবর্তনজনিত অভিযোজন সম্পর্কিত সচেতনতার লক্ষ্যে কাজ করছে সরকারের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়।

প্রতি বছর আগুন লাগা আমাদের নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। ঢাকার মধ্যে হলে একটু বেশি তৎপরতা দেখি এবং তারপর ভুলে যাই। কিন্তু স্বাধীনতার ৫৩ বছর পরও আমাদের যেকোনো দুর্যোগ বা দুর্ঘটনা থেকে স্বাভাবিকভাবে উদ্ধার পাওয়ার ব্যবস্থা তৈরি করতে পারিনি।

যেকোনো দুর্যোগ-দুর্ঘটনাতে আমাদের সবার আগে নাম আসে ফায়ার সার্ভিসের। কিন্তু এই সংস্থা কতটা প্রস্তুত? স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা বিভাগের অন্তর্ভুক্ত। সারা দেশে ফায়ার সার্ভিসের ৫০০-এর কাছাকাছি সেন্টার রয়েছে। বনানীর অগ্নিকাণ্ডে আমাদের মই একটা সীমার পর আর উঠতে পারেনি। আমাদের ফায়ার সার্ভিস কি সেই আধুনিক সমস্যার জন্য প্রস্তুত করতে হবে। দেশের যেকোনো ইমার্জেন্সি সার্ভিসে আমাদের সেনাবাহিনীকে স্মরণ করতে হয়, লঞ্চডুবি হলে নৌবাহিনীকে। এরপর আসি ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস নিয়ে।

সিত্রাং নিয়ে পূর্বাভাস দিতে গিয়ে সমালোচিত হয়েছে আবহাওয়া বিভাগ। যেখানে আবহাওয়া পূর্বাভাসের বৈশ্বিক মডেলগুলো ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ওয়েবসাইটে দেখা যায়, সিত্রাং বাংলাদেশে প্রবেশ করছে, আমাদের আবহাওয়া বিভাগ তখনও অন্ধকারে। বেশ কয়েকজন মানুষ নিহত হওয়ার খবর পত্রিকা মারফত জানা যায়।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের ২০১২ সালের একটি আইন আর ২০১৫ সালের একটি নীতিমালা রয়েছে। কিন্তু তাদের সীমাবদ্ধতা বন্যা মোকাবিলা আর ঘূর্ণিঝড়ে আশ্রয় দেওয়া পর্যন্ত। এর বাইরে নানা চ্যালেঞ্জে পড়তে হয়। আধুনিক নতুন নতুন সমস্যা নির্ণয় করে সেই অনুযায়ী আগে থেকে ব্যবস্থা নিয়ে রাখার ব্যাপার এই নীতিমালাতে নেই। পূর্বপরিকল্পনা অনেকক্ষক্ষতি থেকে বাঁচিয়ে রাখে।

বাংলাদেশে ১৯৮৮ সালের বন্যা আর ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ের পর নিজেদের প্রস্তুত করে এবং তার ফলে এখন দুটিতে ততটা ক্ষতি দেখা যায় না। জরুরি ব্যবস্থাপনা বা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা হলো একটি বিজ্ঞান এবং একটি সিস্টেম যা মানুষের বিপদের ঝুঁকি হ্রাস করে এবং দুর্যোগ মোকাবিলায় সহায়তা করে। জরুরি দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অনেক সময় আসলে জরুরি পরিস্থিতি মোকাবিলার ওপর ফোকাস করার অবস্থায় পাওয়া যায় না। আসলে মানুষের কল্যাণে এবং একটি সমাজের দৈনন্দিন কার্যাবলির মাধ্যমেই দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কাজ করে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার জন্য ব্যক্তি এবং পরিবার, সংস্থা, স্থানীয় জাতীয় সব পর্যায়ের কার্যকলাপের সমন্বয় প্রয়োজন। যদিও দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাস এবং প্রতিরোধ করা সবার দায়িত্ব সবার। জরুরি ব্যবস্থাপনার ফলাফল হলো দুর্যোগ প্রতিরোধ করা এবং যেখানে এটি সম্ভব নয় সেখানে ক্ষতির সম্ভাবনা অনেক বেশি।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা এবং পদ্ধতির মধ্যে একটি জরুরি অবস্থা ঘটলে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য এবং দ্রুত ব্যবস্থাপনার জন্য যথাযথভাবে প্রশিক্ষিত কর্মী সদস্যদের শনাক্তকরণ অন্তর্ভুক্ত করা জরুরি। প্রশিক্ষণ পরিকল্পনায় অভ্যন্তরীণ ব্যক্তি, ঠিকাদার এবং নাগরিক সুরক্ষা অংশীদারদের অন্তর্ভুক্ত করা উচিত এবং প্রশিক্ষণ ও পরীক্ষার প্রকৃতি এবং ফ্রিকোয়েন্সি উল্লেখ করা উচিত। একটি পরিকল্পনার কার্যকারিতা পরীক্ষা নিয়মিতভাবে করা উচিত এবং সেভাবে কাজ করা উচিত।

বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদফতর একটি বৈজ্ঞানিক ও কারিগরি প্রতিষ্ঠান। এটি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন একটি প্রতিষ্ঠান। বর্তমানে বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদফতর দেশের একমাত্র সংস্থা হিসেবে সার্বক্ষণিক বাংলাদেশের আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ, কেন্দ্রীয়ভাবে আবহাওয়ার তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ, আদান-প্রদান ও সংরক্ষণ করে থাকে। এ ছাড়া এ অধিদফতরের কর্মপরিধি শুধু আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ, তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ, আদান-প্রদান ও সংরক্ষণই নয়, এর পাশাপাশি এ অধিদফতর বিমানবন্দর আবহাওয়া পূর্বাভাস সামুদ্রিক ঘূর্ণিঝড় পূর্বাভাস, ঝড় সতর্কীকরণ কেন্দ্র, জলোচ্ছ্বাসের পূর্বাভাস, কৃষি আবহাওয়া পূর্বাভাস, ভূমিকম্প ও সুনামি সতর্কীকরণ কেন্দ্র, জলবায়ু ও জ্যোতির্বিজ্ঞানীয় মহাশাখা, দৈনন্দিন আবহাওয়া পূর্বাভাস, অভ্যন্তরীণ নৌ-চলাচল আবহাওয়া পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র, ভিভিআইপিদের চলাচলের জন্য পূর্বাভাস, কালবৈশাখী, শৈত্যপ্রবাহ, তাপ প্রবাহ, আবহাওয়া খরা ও ভারী বর্ষণজনিত ভূমিধস পূর্বাভাস ও সতর্কবার্তা প্রদানের কাজগুলো পালন করে আসছে।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সঠিকভাবে বাস্তবায়ন ও কার্যকর সমন্বয়ের জন্য ফায়ার সার্ভিস এবং আবহাওয়া অধিদফতরকে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ে অন্তর্ভুক্ত করার সুপারিশ করেছে সংসদীয় কমিটি। এটি একটি ভালো প্রস্তাব ও উদ্যোগ। জাতীয় সংসদের ‘দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির বৈঠকে এ সুপারিশ করা হয়েছে সম্প্রতি। কমিটির সভাপতি আ স ম ফিরোজের সভাপতিত্বে পটুয়াখালী জেলার কুয়াকাটায় এই বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। কমিটির সদস্য দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী মহিববুর রহমান, শাহীন আক্তার, মোশতাক আহমেদ রুহী, মজিবুর রহমান চৌধুরী, মো. আবদুর রশীদ এবং আশ্রাফুন নেছা বৈঠকে অংশগ্রহণ করেন। তবে বাংলাদেশের সরকার ও জনগণের সম্পৃক্ততায় দেশি-বিদেশি সংস্থা ও এনজিওর সহযোগিতায় উপকূলীয় অঞ্চলের জনগণ এখন অনেক সচেতন হয়েছে। খাদ্য ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে সারা বছরই দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার নানা কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়ে আসছে। পরিকল্পিতভাবে বেড়িবাঁধ নির্মাণ ও উপকূলীয় বনায়নের মাধ্যমে প্রতিরক্ষা বেষ্টনী তৈরি করা হচ্ছে।

প্রাকৃতিক সুন্দরবন ও পরিকল্পিত বনায়ন সৃজনের মাধ্যমে ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের হাত থেকে বাঁচার জন্য সুরক্ষাবলয় তৈরি হয়েছে। প্রতি বছর বেষ্টনীবাঁধ ও বনায়ন নষ্ট হয়, আবার পুনর্নির্মাণ করা হয়। ঝড়-জলোচ্ছ্বাস ছাড়াও নানা ধরনের প্রাকৃতিক ও মনুষ্যসৃষ্ট দুর্যোগ রয়েছে।

খাতের মাধ্যমে প্রয়োজনীয়সংখ্যক শক্তিচালিত পাম্প আমদানি করার বিষয়ে প্রশাসনিক সহায়তা করবেন। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদফতর, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ, বৈজ্ঞানিক, কারিগরি, গবেষণা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, উন্নয়ন সহযোগী, জাতিসংঘের এজেন্সি, সরকারি ও বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা যারা দুর্যোগঝুঁকি হ্রাস এবং সাড়াদান ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট তাদের মধ্যে নেটওয়ার্কিং এবং সহযোগী রূপে কাজ করার ওপর জোর দিয়ে থাকে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্মসূচিতে ঝুঁকি হ্রাস সম্পৃক্ত করা, দুর্যোগের নেতিবাচক প্রভাব থেকে দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিত মানুষের বিপদাপন্নতা হ্রাস করা, জ্ঞান, গবেষণা ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা চক্রের প্রতিটি অংশের সক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে কাজ করছে।

জনগণের জান-মাল রক্ষায় আত্মোৎসর্গ করার বড় দৃষ্টান্ত ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স। বিভিন্ন দুর্যোগ-দুর্ঘটনায় শুধু দেশের অভ্যন্তরে নয়, বিদেশের মাটিতেও সফল উদ্ধার অভিযানের অভিযাত্রী হিসেবে দুর্দান্ত কাজ করে দেশের সুনাম অক্ষুণ্ন রেখেছেন আমাদের সুযোগ্য ফায়ার সার্ভিস সদস্যরা।

আবহাওয়ার পূর্বাভাস দেওয়ার প্রক্রিয়াটি বেশ জটিল। ভৌগোলিক অবস্থান, পূর্ব আবহাওয়ার ইতিহাস, তাপমাত্রা, বায়ুচাপ, বায়ুর আর্দ্রতা, জলবায়ু, প্রাকৃতিক পরিবেশ, বনাঞ্চলের পরিমাণ ইত্যাদি পর্যবেক্ষণ ও প্রাপ্ত উপাত্ত বিশ্লেষণ করে বিদ্যমান আবহাওয়া ও অদূর ভবিষ্যতের আবহাওয়ার পূর্বাভাস দেওয়া হয়ে থাকে।

বর্তমানে উন্নত বিশ্বে স্যাটেলাইটসহ বিভিন্ন উৎস থেকে তাপমাত্রা, চাপ, আর্দ্রতা এবং বাতাসের গতির মতো পর্যবেক্ষণগুলো সারা বিশ্ব থেকে সংগ্রহ করা হয়। এরপর সেই বিপুল পরিমাণ ডাটা শক্তিশালী সুপার কম্পিউটারে প্রক্রিয়া করা হয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, যুক্তরাজ্যের আবহাওয়া অফিস ১২০ কোটি পাউন্ড মূল্যের সুপার কম্পিউটার ব্যবহার করে। এই ক্ষেত্রে প্রধান ফ্যাক্টর হলো, এই কম্পিউটারগুলো একটি পূর্বাভাস তৈরি করতে এসব উপাত্ত কত দ্রুত প্রক্রিয়া করতে পারছে।

বাংলাদেশের আবহাওয়াবিদরা অ্যানালগ ও ডিজিটাল দুই পদ্ধতিতেই কাজ করেন। এখন ইন্টিগ্রেটেড হাই পারফরম্যান্স কম্পিউটিং সিস্টেমে আগামী অন্তত ১০ দিনের আবহাওয়ার পূর্বাভাস দিতে পারে বাংলাদেশের আবহাওয়া অধিদফতর। সারা দেশে ৪৭টি আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র রয়েছে। সেখান থেকে প্রতি তিন ঘণ্টা পরপর বাতাসের বেগ, তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়, মেঘের গতি ও তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় রাতদিন। সেই তথ্যগুলো বিশ্লেষণ করে পূর্বাভাস প্রস্তুত করা হয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *