যোগাযোগমাধ্যমের অপব্যবহার ও বিপথগামী প্রজন্ম


হীরেন পণ্ডিত: বাংলাদেশে সামাজিক, ধর্মীয়, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংঘাতের জন্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম প্ল্যাটফর্মের অপব্যবহার অনুঘটক হয়ে উঠেছে। এই অপব্যবহারের ফলে উল্লেখযোগ্য ক্ষতিসাধন হচ্ছে-ভুল তথ্য এবং ক্ষতিকারক বিষয়গুলো সমাজের শান্তিকে বিনষ্ট করে উত্তেজনা বাড়িয়ে দেওয়ার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।

আমাদের সমাজে রাজনৈতিক অস্থিরতা তৈরি, সোশ্যাল মিডিয়াতে প্রতারণামূলক উপাদানের দ্বারা ভরপুর। এটি একটি চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে আমাদের একটি শান্তিপূর্ণ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ তৈরির জন্য। দেশে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য সরকার এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর সতর্ক ব্যবস্থাপনা প্রয়োজন। সোশ্যাল মিডিয়া, বিশেষ করে ফেসবুক, টুইটার এবং ইউটিউব বাংলাদেশের ভুল তথ্য থেকে বেআইনি মুনাফার জন্য একটি প্রজনন ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে।

ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের ৮৪ শতাংশের একটি ফেসবুক অ্যাকাউন্ট রয়েছে, প্রতিদিন হাজার হাজার বিভ্রান্তিকর বিষয়বস্তুর প্রচার হচ্ছে। এটি এমন একটি পরিস্থিতি তৈরি করে যেখানে জনসংখ্যার একটি উল্লেখযোগ্য অংশের কাছে তারা যে তথ্যের মুখোমুখি হয় তার নির্ভুলতা স্বাধীনভাবে যাচাই করার উপায় নেই। ভুল তথ্যের ব্যাপক বিস্তার একটি বড় সামাজিক চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠেছে। ভুল তথ্যের প্রভাবে বাংলাদেশে রাজনৈতিক ও সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঐতিহাসিক উদাহরণ খুঁজে পাওয়া যায়। সোশ্যাল মিডিয়ার জনপ্রিয়তা এবং প্রবেশযোগ্যতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ভুল তথ্যের বিরুদ্ধে লড়াই আরও জটিল হয়ে ওঠে, যা জাতির স্থিতিশীলতার জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়ায়।

২০১০ সালে বুকার পুরস্কার বিজয়ী খ্যাতিমান ব্রিটিশ লেখক হাওয়ার্ড জ্যাকবসন আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেছিলেন, ‘২০ বছরের মধ্যে শিশুদের মূর্খ বানাবে ফেসবুক-টুইটার। ফেসবুক, টুইটারসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের আধিপত্যের কারণে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের শিশুরা অশিক্ষিত হবে। স্মার্টফোনের ব্যবহার এবং প্রচুর পরিমাণে ফেসবুক, টুইটারসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারে নাটকীয়ভাবে তরুণ প্রজন্মের যোগাযোগের পদ্ধতি বদলে যাচ্ছে। আর এসবের কারণে তারা হারাচ্ছে বই পড়ার অভ্যাসও।’ অপরাধবিজ্ঞানী বিশেষজ্ঞদের মতে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ইদানীং আমাদের নিত্যদিনের সঙ্গী হয়ে উঠেছে।

এ মাধ্যম আমাদের মানবিক গুণাবলিকে প্রভাবিত করছে। মানি লন্ডারিং, আক্রমণাত্মক গেম, ধর্ষণের মতো অপরাধে জড়িয়ে যাচ্ছে অনেকে। মানসিকভাবে অনেকেই আছে অস্থির অবস্থায়। এর মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহারের কারণে ক্রমেই রাগ-ক্রোধ-অবসাদ-বিষণ্নতা-একাকিত্ব-হতাশা-হৃদরোগসহ বিভিন্ন রোগের ঝুঁকি বেড়ে যাচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অপব্যবহার নিয়ে শঙ্কিত স্বয়ং ফেসবুকের সহপ্রতিষ্ঠাতা ও সিইও মার্ক জাকারবার্গের ভাষ্যমতে, ‘সোশ্যাল মিডিয়া সময় নষ্টের জন্য নয়। এটি সত্যিকারে উপকারে আসতে পারে, যদি এর সঠিক ব্যবহার করা হয়। কিন্তু আপনি যদি শুধু এখানে বসে থাকেন আর যা দেখানো হবে, তাই গলাধঃকরণ করেন, তা হলে তো হবে না।’

ইতিবাচক অবদান রাখার পাশাপাশি প্রবাসী ও অভিবাসী বাংলাদেশিদের মধ্যে অনেকেই দেশের বিরুদ্ধে অপপ্রচারে লিপ্ত রয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ বিভিন্ন মাধ্যমে এদের সরব উপস্থিতি ও দেশবিরোধী আপত্তিকর মন্তব্য-বক্তব্য প্রচারের কারণে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে।

গণমাধ্যমে প্রকাশিত সূত্রমতে, বিশ্বে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের ৭০ শতাংশ মানুষ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সংযুক্ত, যার প্রায় ৯০ শতাংশই তরুণ। বর্তমানে বাংলাদেশে প্রচলিত ফেসবুক, ইউটিউব, টুইটার, ইনস্টাগ্রাম, লিঙ্কডিন, স্কাইপে প্রভৃতি জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে সর্বাধিক জনপ্রিয় ফেসবুক। বাংলাদেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের মধ্যে ৮০ শতাংশের রয়েছে ফেসবুক অ্যাকাউন্ট এবং এর একটি বিশাল অংশ কিশোর-কিশোরী।

বিভিন্ন দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থার জরিপের ফলাফল অনুসারে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অপব্যবহারের কারণে উল্লেখযোগ্য তরুণ ও তরুণী বিপথগামী-মানসিক সমস্যায় জর্জরিত হচ্ছে, পড়াশোনায় মনোযোগ হারাচ্ছে, খেলাধুলা ছেড়ে দিয়ে রাতদিন ইলেকট্রনিক ডিভাইস নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করছে। চরম স্খলন হচ্ছে শিক্ষানীতি নৈতিকতার। ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে দিচ্ছে সংঘাত-সহিংসতা। ভুয়া তথ্য সরবরাহ-ঘৃণা-বিদ্বেষ, যৌনতা ও অশ্লীলতা, চরিত্রহনন, মুদ্রা ও মানব পাচার, জুয়া-সাইবার সহিংসতাসহ নানা মাত্রিক অপরাধের মাধ্যম হিসেবে পরিগণিত হয়েছে এ সামাজিক যোগাযোগ।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অপরাধের ক্রমবর্ধনশীলতায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের আইন চাপ প্রয়োগের ফলে ইউটিউব ও ফেসবুকের মতো অনেক সাইট তাদের নিজস্ব নিয়মে অগ্রহণযোগ্য ও ক্ষতিকর বিষয়বস্তু দ্রুত মুছে ফেলাসহ প্রথম প্রকাশ হওয়া প্রতিরোধের পদক্ষেপ নিয়েছে। ইউটিউব ও ফেসবুক কর্তৃপক্ষক্ষনিয়মিত অনুপযুক্ত বিষয়বস্তু অপসারণের তথ্য প্রকাশ করছে।

গুগলের মালিকানাধীন ভিডিও শেয়ারিং সাইটের তথ্যমতে, তারা ২০২০ সালের জুলাই থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে ৮৮ লাখ ভিডিও, ৩৩ লাখ ক্ষতিকারক চ্যানেল ও ৫১ কোটি ৭০ লাখ অগ্রহণযোগ্য মন্তব্য অপসারণ করেছে। ফেসবুক কর্তৃপক্ষের দাবি, তারা উল্লেখ্য সময়ে ৩ কোটি ৩০ লাখ ক্ষতিকারক বিষয় সরিয়ে নিলেও অগ্রহণযোগ্য ও ক্ষতিকর বিষয়বস্তুর আধিক্যের কারণে শুধু কোম্পানির একার পক্ষে এটি ঠেকানো সম্ভব হচ্ছে না। নিয়ন্ত্রক কোম্পানিগুলোর শত প্রচেষ্টা সত্ত্বেও এটি দিন দিন ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে।

বাংলাদেশে পরিচালিত প্রতিটি ওয়েবসাইট, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও অনলাইন বিনোদনমূলক প্ল্যাটফরমগুলোর জন্য বিটিআরসি থেকে কিছু শর্তসাপেক্ষেক্ষ নিবন্ধন নেওয়ার প্রস্তাবও রাখা হয়েছে।

শর্তগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো, দেশে পরিচালিত যেকোনো ওয়েবসাইট ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অফিস বাংলাদেশে থাকতে হবে। সংবাদ-কিউরেটেড কনটেন্ট-ফিল্ম-ওয়েব সিরিজ রয়েছে এমন ওয়েবসাইটের জন্য তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের এনওসি বাধ্যতামূলক।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশও আইনি কাঠামোর ভিত্তিতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। গণমাধ্যমের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণে দেখা যায়, জার্মান সরকার ২০১৮ সালে নেটজডিজি এ আইন প্রণয়নের মাধ্যমে সোশ্যাল মিডিয়া কোম্পানিকে তাদের সাইটে প্রকাশিত আপত্তিকর বিষয়বস্তু সম্পর্কে অভিযোগ পর্যালোচনা করার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা-বিষয়বস্তু প্রকাশের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তা অপসারণ-কোম্পানিগুলোর কাজের বিবরণ সম্পর্কে প্রতি ৬ মাস অন্তর আপডেট প্রতিবেদন প্রকাশ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।

ভারতে ২০২১ সালে প্রণীত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ নীতিমালা মতে, ফেসবুক-টুইটার-হোয়াটসঅ্যাপ ও অন্যান্য যোগাযোগমাধ্যমের কর্তৃপক্ষকে ভারতীয় সরকার কোনো ব্যবহারকারীর পোস্ট মুছে দেওয়া এবং ব্যবহারকারীর নাম-পরিচয় প্রকাশের অনুরোধ করতে পারবে। ঘৃণ্য ও হিংসাত্মক বিষয়বস্তু প্রকাশের কারণে সংস্থাগুলোর বৈশ্বিক টার্নওভারের ১০ শতাংশ পর্যন্ত আর্থিক দণ্ড ও প্রযুক্তি নির্বাহীদের জন্য তিন বছরের কারাদণ্ডের বিধান রেখে অস্ট্রেলিয়ায় ২০১৯ সালে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ আইন করা হয়।

চীন সাইবারস্পেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন নিয়মিতভাবে বিভিন্ন ওয়েবসাইট বন্ধ ও জুয়া খেলাসহ ক্ষতিকারক নানা মোবাইল অ্যাপ অপসারণ করে থাকে। দেশটিতে থাকা কয়েক হাজার সাইবার পুলিশের কাজ হচ্ছে সামাজিক মিডিয়া প্ল্যাটফরম এবং সংবেদনশীল স্ক্রিন বার্তাগুলোকে নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করা।

জগতের প্রতিটি বিষয়েরই ইতিবাচক এবং নেতিবাচক উভয় দিকই থাকে। কিন্তু যেকোনো বিষয়ের ইতিবাচক দিকগুলোকে সাদরে গ্রহণ করে সেগুলোকে আমরা কীভাবে কাজে লাগাচ্ছি সেটিই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।

আজকাল এ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বদৌলতে ব্যবসা-বাণিজ্যের এক বিরাট মাধ্যমের সূচনা হয়েছে। এই যান্ত্রিক কর্মব্যস্ত জীবনে অনেকে নিজের নিত্যপ্রয়োজনীয় নানাবিধ পণ্য কিনতে দোকান, মার্কেটে যেতে পারেন না। তাদের এই ব্যস্ত জীবনে আশার আলো হয়ে এসেছে ই-কমার্স। বিভিন্ন নামিদামি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান কিংবা ছোটখাটো ব্যবসায়ীর বেঁচে থাকার অবলম্বন এই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম যার ফলে তারা নিজেদের বিক্রয়যোগ্য পণ্যের প্রচার ক্রেতাদের কাছে পৌঁছে দিতে পারেন। এই ই-কমার্সের সুফল ভোগ করতে বর্তমানে বহু বেকার তরুণ উদ্যোক্তা হওয়ার দিকে ঝুঁকছে। ফলে অনেকেই এখন অনলাইন ব্যবসামুখী হচ্ছে ও সফলতার মুখ দেখছে।

আমাদের এই সত্যটি স্বীকার করে নেওয়া জরুরি যে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের যথেচ্ছ ব্যবহার আমাদের বাস্তব জীবনের সম্পর্কে নেতিবাচক পরিবর্তন বয়ে আনছে ও আমাদের পরিবারের সদস্য, আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে যোগাযোগ তৈরির ক্ষেত্রে বিরাট অন্তরায় তৈরি করছে। যে কারও সঙ্গে মনের ভাব বিনিময়ের জন্য সামনে বসে বলা সর্বোত্তম। কিন্তু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের মাত্রাতিরিক্ত আসক্তির ফলে আমরা ভার্চুয়ালি মনের ভাব আদান-প্রদানেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছি। কিন্তু বাস্তবতা হলো, প্রযুক্তির ওপর এই নির্ভরশীলতা আমাদের প্রতিনিয়ত বাস্তব জীবন থেকে দূরে ঠেলে দিয়ে ক্রমেই আমাদের যান্ত্রিক করে তুলছে।

মূলত প্রতিটি ধর্মের ধর্মগ্রন্থ অনুসারে এতদিনকার প্রচলিত রীতিনীতি-সমাজদর্শন-সত্য-সুন্দর-কল্যাণ আনন্দের অনুষঙ্গভিত্তিক সংস্কৃতি-কৃষ্টি-ঐতিহ্যের মূলে কুঠারাঘাত করে বিকৃত চিন্তাচেতনা-ধ্যানধারণার অনুপ্রবেশ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে নিগূঢ় চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি করছে। মিথ্যাচার, প্রতারণা, জালিয়াতি ও অসংলগ্ন কর্মযজ্ঞের সমীকরণে প্রজন্ম কী পেতে যাচ্ছে, তা ভেবে দেখার এখনই উপযুক্ত সময়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *