আয়-ব্যয়ের হিসাব ও দ্রব্যমূল্য


হীরেন পণ্ডিত: নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্যের দামের ঊর্ধ্বমুখী পরিস্থিতি নিয়ে সরকার ও জনগণের মাঝে সমান অস্বস্তি। সরকারের নীতিনির্ধারক থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ, সবার মাঝে দুশ্চিন্তা। নিয়ন্ত্রণহীন বাজারের প্রভাবে সাধারণ মানুষের মধ্যে সরকার সম্পর্কে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করছে এবং তা আরও বাড়তে পারে-এমন আশঙ্কাও উড়িয়ে দিচ্ছেন না কেউ কেউ।

নিত্যপণ্যের বাজার সামলাতে সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপের কথা তুলে ধরছেন। তারপরও অল্প সময়ের মধ্যে বাজার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে, এমনটা মনে করছেন না অনেকে। তারা অনেকে মনে করেন কিছুটা সময় প্রয়োজন হবে। তবে নানা পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বলা হলেও সরকার ব্যবসায়ীদের ব্যাপারে কঠোর হতে পারছে না বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদদের কেউ কেউ।

দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতি সামলাতে সরকারের দিক থেকে চেষ্টা রয়েছে। একটি সমন্বয়ের চেষ্টা চলছে। ডলারের দাম বাজারভিত্তিক করার মতো কিছু উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে। সরকার আশা করছে, অল্প সময়ের মধ্যে বাজার নিয়ন্ত্রণে আসবে। কিন্তু তেমন কোনো নিশ্চয়তা নেই। কারণ রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, মধ্যপ্রাচ্য পরিস্থিতি এবং এর ফলে সৃষ্ট অর্থনৈতিক চাপ শিগগিরই কেটে যাবে-এমন কোনো লক্ষণও দেখা যাচ্ছে না। ফলে সাধারণ মানুষের কাছে জবাব কী হবে অথবা তাদের কীভাবে আশ্বস্ত করা যাবে, এসব প্রশ্নও রয়েছে।

আওয়ামী লীগের টানা চতুর্থ দফার এই সরকারের দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতির উন্নতি করার বিষয় অগ্রাধিকারের তালিকায় ১ নম্বরে রয়েছে। গত ৭ জানুয়ারির জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলটির নির্বাচনি ইশতেহারে তা বলা হয়। কিন্তু ১ নম্বর অগ্রাধিকার বাস্তবায়নেই সরকার চ্যালেঞ্জে রয়েছে। পরিস্থিতি ও দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করা চ্যালেঞ্জ অবশ্যই। কিন্তু সরকার সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার চেষ্টা করছে। বিভিন্ন খাদ্যপণ্যের আমদানি বাড়ানো, মুদ্রানীতিতে পরিবর্তন আনাসহ নানা পদক্ষেপ নিয়েছে। এর ইতিবাচক প্রভাব পড়তে কিছুটা সময় লাগবে। সরকারের পদক্ষেপ নেওয়ার ক্ষেত্রে কোনো মহলের স্বার্থ বিবেচনা করা হচ্ছে না।

তবে চালসহ যেসব পণ্য দেশে উৎপাদিত হয়, সেগুলো চাতাল ব্যবসায়ী ও চালকল মালিক বা সিন্ডিকেটের খপ্পরে পড়ে যায়। এর সঙ্গে পরিবহনে চাঁদাবাজিসহ নানা অব্যবস্থাপনার কারণে পণ্য এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যাওয়ার সময় দাম বেড়ে যায়। এটি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতা রয়েছে। আরেকটি বড় কারণ, কিছু পণ্যের বাজার একশ্রেণির আমদানিকারকের নিয়ন্ত্রণে। যেমন আমদানিনির্ভর তেল ও চিনির বাজার গুটিকয় ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রণ করে। এ ছাড়া ডলার সংকট এবং দফায় দফায় বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর প্রভাবও রয়েছে এটাও কেউ কেউ মনে করেন।

লাগামহীন মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে দল ও সরকারে অস্বস্তি রয়েছে। কারণ, জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েই চলেছে, যা সাধারণ মানুষের মধ্যে ক্ষোভ তৈরি করছে। নিত্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে হিমশিম খাচ্ছে সরকারও। ঊর্ধ্বমুখী নিত্যপণ্যের বাজার। নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বগতি ও লাগামহীন মূল্যবৃদ্ধি তাদের কষ্ট আরও একটু বাড়িয়েছে। ফলে প্রতিদিনের ব্যয় নির্বাহ করাই কঠিন হয়ে পড়েছে নিম্ন ও মধ্যবিত্তদের জন্য।

কঠিন এই বাস্তবতায় মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত কী করে টিকবে এই কঠিন প্রশ্নের উত্তর আবার খুঁজতে হবে। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যাওয়া কোনোভাবেই কাম্য নয়। অভাব আর দারিদ্র্যের কশাঘাতে মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্তের জনজীবন দুঃখ ও হাহাকারে পূর্ণ। মানুষের ওপর চেপে বসেছে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির ঘোড়া। জীবন ধারণের উপযোগী প্রতিটি জিনিসের অগ্নিমূল্য। চাল, ডাল, মাছ, মাংস, তেল, তরিতরকারি, ফলমূল, চিনি, লবণ, গম, আটা, রুটি, বিস্কুট ইত্যাদি পণ্যের দাম আগের তুলনায় কয়েকগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে সাধারণ মানুষ বিশেষ করে খেটে খাওয়া মানুষ দিশাহারা। অতি মুনাফালোভী ব্যবসায়ীদের জন্যই সাধারণ মানুষকে অনেক দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে বলে অভিযোগ আছে।

নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের মূল্যতালিকা টানানো এবং নির্ধারিত মূল্যে পণ্য বিক্রি করা হচ্ছে কি না, সেটি পর্যবেক্ষণের জন্য সব বাজারে দ্রব্যমূল্য মনিটরিং কমিটি গঠনের ব্যবস্থা করতে হবে এবং এটি করা খুবই জরুরি। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দামের ঊর্ধ্বগতি রোধ করে দেশের সাধারণ মানুষকে একটু সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার নিশ্চয়তা প্রদানে যথেষ্ট ভূমিকা রাখতে হবে সরকারকে। আয়-ব্যয়ের হিসাব মেলাতে সাধারণ মানুষের যখন নাভিশ্বাস, তখন নিত্যপণ্যের বাজারেও যেন আগুন লেগেছে। সবকিছুর দামই বাড়তি। সরকারের উচিত আগে বাজার নিয়ন্ত্রণে আনা। সাধারণ মানুষের কথা চিন্তা করা। ভোক্তাদের অধিকার সংরক্ষণের জন্য কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)-কে আরও জোরালো ভূমিকা নিতে হবে। তা না হলে ক্যাব, ভোক্তা অধিকার কতটুকু সংরক্ষণ করতে পারছে, তা একটা বড় প্রশ্ন হিসেবে সামনে আসতে পারে। তাই এ বিষয়ে সবার একসঙ্গে কাজ করা উচিত। জীবনযাত্রার ব্যয় কয়েকগুণ বেড়ে যাওয়ায় সংকটে আছে মধ্যবিত্ত ও নিম্নআয়ের মানুষ। অন্যদিকে আয় না বাড়ায় জীবনযাপনের খরচ মেটাতে হিমশিম খাচ্ছে মানুষ। চাল, ডাল, তেল, চিনি, মাছ, মাংস, সবজি থেকে শুরু করে নিত্যব্যবহার্য পণ্যের দাম দফায় দফায় বেড়েছে। বাড়তি ব্যয়ের চাপ সামাল দিতে নিত্যদিনের খাদ্যতালিকা থেকে কাটছাঁট হচ্ছে অনেক কিছু।

ঢাকা মেগাসিটির ব্যক্তিপর্যায়ের ভোক্তারা খাদ্যবহির্ভূত ঝুড়িতে আপেক্ষিকভাবে খানিকটা বেশি ব্যয় করেন, যার মধ্যে খাদ্যবহির্ভূত পণ্য এবং বিভিন্ন পরিষেবা অন্তর্ভুক্ত। বছরের দ্বিতীয়ার্ধে উচ্চ খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি সৃষ্টিকারী এই জিনিসগুলোর একধরনের টেকসই মূল্যবৃদ্ধি ঘটেছে। দ্বিতীয়ত যেহেতু নিম্নআয়ের জনগোষ্ঠী খুব মৌলিক, কম দামের এবং সীমিত খাদ্যসামগ্রী গ্রহণ করে, যার মধ্যে কিছু দামের ক্ষেত্রে মৌসুমি প্রভাব এবং তুলনামূলক স্থিতিশীল দামের দ্বারা চিহ্নিত করা হয়। কারণ এগুলোর সরবরাহ শক্তিশালী যেমন মোটা চাল ও সস্তা মাছ। বাজারে স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে পর্যবেক্ষণ বাড়ানো উচিত। সিন্ডিকেট ও দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।

বাজারে সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর, বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশন, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, ক্যাব ও গণমাধ্যমকে যৌথভাবে কাজ করতে হবে। উচ্চ মূল্যস্ফীতির চ্যালেঞ্জ আগামী বছরজুড়েও থাকবে। পণ্য সরবরাহ যতদূর সম্ভব স্থিতিশীল রাখার চেষ্টা করতে হবে। আমাদের অভ্যন্তরীণ উৎপাদন ও রাজস্ব আহরণ বাড়াতে হবে। অভ্যন্তরীণ সম্পদ দিয়ে যত দূর সম্ভব আমদানি নির্ভরতা কমানো যায়। চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতা বাড়াতে হবে।

মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতি অব্যাহত থাকা ও টাকার মান কমে গিয়ে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পাচ্ছে ক্রমাগত। অন্যদিকে জীবনযাত্রার খরচ বেড়ে যাওয়ায় মান কমে যাচ্ছে। ব্যয়ভারে সংকুচিত হয়ে পড়ছে মানুষের জীবন। একই সঙ্গে সার্বিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় বড় ধরনের চাপের সৃষ্টি হয়েছে। যদিও নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস-বিদ্যুৎ পাওয়া নিয়ে এখনও অনিশ্চয়তা রয়ে গেছে। সব মিলিয়ে পণ্য ও মানুষের চলাচলের খরচ বেড়ে যাবে। বিদ্যুৎ ও সারের দাম বাড়ানোর কারণে কৃষি খাতে উৎপাদন খরচ বেড়ে চলেছে।

জ্বালানি তেল, গ্যাস, বিদ্যুৎকে বলা হয় অর্থনীতির লাইফ লাইন, যা অর্থনীতির রক্ত সঞ্চালনের মতো। সব ধরনের পণ্য ও সেবা এবং মানুষের জীবনযাত্রায় এগুলোর প্রভাব রয়েছে। অর্থাৎ এসব পণ্য ও সেবা ছাড়া বৈশ্বিক বা মানুষের জীবনযাত্রা কল্পনাই করা যায় না। যে কারণে এসব পণ্যের দাম দেশে বা বিদেশে বাড়লে এর নেতিবাচক প্রভাব আন্তর্জাতিক অঙ্গন থেকে দেশীয় আর্থিক ব্যবস্থাপনায়ও পড়ে। আকস্মিকভাবে গ্যাসের দাম বাড়ানোর কারণে সব ধরনের পণ্য ও সেবার মূল্য বেড়ে যাবে। এর নেতিবাচক প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়বে রফতানি ও শিল্প খাতে। চড়া দামে গ্যাস কিনে বিদ্যুৎ উৎপাদন করলে তার খরচও বাড়বে।

গ্যাসনির্ভর শিল্পের বয়লার পরিচালন খরচও বাড়বে। বিশেষ করে বস্ত্র, সিরামিক, প্লাস্টিক, লৌহ, প্রকৌশল, জাহাজ ভাঙা, ইস্পাত শিল্পে খরচ বেশি বাড়বে। এগুলোর দাম বাড়লে নির্মাণ, আবাসন, উন্নয়ন খরচসহ অনেক খাতেই খরচ বাড়বে। ভোক্তা পর্যায়ে নতুন করে বিদ্যুতের দাম বাড়লে সে হারে বাড়ানোর ফলে সব খাতেই উৎপাদন খরচ বাড়বে। এবার গৃহস্থালি থেকে শুরু করে কৃষির সেচ, শিল্প এবং বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান, ক্ষুদ্রশিল্প, নির্মাণ শিল্প, ধর্মীয়, শিক্ষা এবং দাতব্য প্রতিষ্ঠান, পানির পাম্প, ইলেকট্রিক যানের ব্যাটারি চার্জ, মাঝারি, বড়, ভারী শিল্প খাতে গড়ে ৫ শতাংশ হারে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে। বিনোদন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ভ্রমণ-এসব খাতে ব্যয় কমাতে হবে। ফলে ওইসব খাতে আরও মন্দা ভর করবে। এ পরিস্থিতিতে অনেকে সঞ্চয়ে হাত দিয়েছেন। নতুন সঞ্চয়ও করতে পারছেন না।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে, ২০২২ সালের আগস্টে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৯ দশমিক ৮৬ শতাংশ। সেপ্টেম্বরে তা কিছুটা কমে ৯ দশমিক ১ শতাংশ হলেও খাদ্যপণ্যে মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের ওপরে ছিল। বিবিএসের পরিসংখ্যান অনুসারে, ২০২২ সালের আগস্টে গত ১১ বছর ৩ মাসের (১৩৫ মাস) মধ্যে সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতি হয়েছিল। এর আগে ২০১১ সালের মে মাসে সর্বোচ্চ ১০ দশমিক ২০ শতাংশ মূল্যস্ফীতি হয়েছিল। উচ্চ মূল্যস্ফীতির সময়ে নিম্নআয়ের পরিবারগুলোকে পর্যাপ্তভাবে কাভার করার জন্য যথাযথ পরিবীক্ষণের সঙ্গে ওএমএস কার্যক্রম শক্তিশালী করা উচিত। দেশে এক কোটি পরিবারকে খাদ্য সহায়তা বৃদ্ধি করা উচিত। দরিদ্রদের জন্য কর্মসংস্থান কর্মসূচির আওতাও বাড়াতে হবে।

এ ছাড়া অস্থায়ীভাবে আওতা বাড়ানোর মাধ্যমে খাদ্য, খাদ্যবহির্ভূত মৌলিক পণ্য এবং দুস্থ জনগোষ্ঠীর কাছে নগদ টাকা হস্তান্তর কর্মসূচি বাড়ানো উচিত। যেহেতু গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর তুলনায় শহুরে জনগোষ্ঠী মূল্যস্ফীতির কারণে বেশি চাপ এবং অসহায়ত্বের সম্মুখীন হয়, তাই সামাজিক সুরক্ষা জোরদার করার মাধ্যমে শহুরে নিম্নআয়ের মানুষের প্রতি আরো বেশি মনোযোগ দেওয়া উচিত। এ ছাড়া শহুরে নিম্ন মধ্যম ও মধ্যম আয়ের পরিবারের জন্য বিশেষ সামাজিক সুরক্ষা স্কিম তৈরি করা উচিত, যাতে তারা সফলভাবে মূল্যস্ফীতির চাপ মোকাবিলা করতে সক্ষম হয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *