হীরেন পণ্ডিত: শান্তিনিকেতনে একবার নয়, দুবার নয়-বারবার যেতে ইচ্ছে করে। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলায় অবস্থিত শান্তিনিকেতনের জন্য ইউনেসকোর বিশ্বঐতিহ্যের স্বীকৃতি পেতে বহু দিন চেষ্টা চালাতে হয়েছে ভারত সরকারকে। অবশেষে সেই স্বীকৃতি দিয়েছে ইউনেসকো। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতিবিজড়িত শান্তিনিকেতন বিশ্বঐতিহ্যের স্বীকৃতি পেয়েছে ২০২৩ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর। জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা ইউনেসকো এ ঘোষণা দেয়। ইউনেসকোর বিশ্বঐতিহ্য তালিকায় নতুনভাবে যুক্ত হয় ভারতের শান্তিনিকেতন। বিশ্বঐতিহ্যের স্বীকৃতিপ্রাপ্ত শান্তিনিকেতন কলকাতা থেকে ১০০ মাইল উত্তরে অবস্থিত, এটি মূলত একটি আশ্রম। প্রতিষ্ঠা করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাবা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর।
জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে যেকোনো মানুষ সেখানে গিয়ে সৃষ্টিকর্তার আরাধনা করতে পারতেন। শান্তিনিকেতনকে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজে নথিভুক্ত করতে সুপারিশ করেছিল ইউনেসকোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সেন্টারের উপদেষ্টা সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল কাউন্সিল অন মনুমেন্টস অ্যান্ড সাইটস।
১৮৮৮ সালে শান্তিনিকেতন ট্রাস্ট একটি অতিথি ভবন, প্রার্থনা, ধর্মীয় এবং সাহিত্যের জন্য নিবেদিত গ্রন্থাগারের সংস্থান করেছিল। পরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯০১ সালে মাত্র পাঁচজন ছাত্র নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিলেন। ১৯১৮ সালে বিশ্বভারতীর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ১৯২১ সালে শুরু হয় বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম। জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত শান্তিনিকেতনেই বেশিরভাগ সময় কাটিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। কবির নামের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা প্রতিষ্ঠানটিতে বর্তমানে ছয় হাজারের বেশি শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছে। শান্তিনিকেতন বা বিশ্বভারতী বাংলা সাহিত্যের তীর্থ স্থান। প্রকৃতির ছায়া সুনিবিড় প্রান্তরে ভারতের শান্তিনিকেতন পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার বোলপুর শহরের কাছে অবস্থিত একটি আশ্রমভিত্তিক শিক্ষাকেন্দ্র।
১৮৬৩ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাবা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর নিভৃতে ঈশ্বরচিন্তা ও ধর্মালোচনার উদ্দেশ্যে বোলপুর শহরের উত্তরাংশে এই আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন। এখানে শিশুদের জন্য রয়েছে উন্মুক্ত ক্লাসরুম। পাঠদানের আসর বসে খোলা জায়গায় গাছের নিচে। বটের ছায়ায় শান্ত সুনিবিড় পরিবেশে পাঠদানের এই আসর। শান্তিনিকেতন বা বিশ্বভারতীর কথা আলোচনা করতে গেলে খুব প্রাসঙ্গিকভাবেই কবিগুরুর রচিত অনেক গানের কথা মনে এসে যায়। বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে কবি শান্তিনিকেতনকে বিশে^র দরবারে পৌঁছে দিতে চেয়েছিলেন, সীমাহীন জ্ঞানের পরিপূর্ণ বিকাশ চেয়েছিলেন, কবি বিশ্ব মানবতাবাদের চিন্তাধারায় উদ্বুদ্ধ হয়ে বিশ্বে তুলে ধরতে চেয়েছিলেন।
এই শান্তিনিকেতনের প্রকৃতি অনেককেই বড় কাছে টানে। ছায়া সুনিবিড় গাছের নিচে নিচে কচিকাঁচাদের ক্লাস, মাঝেমধ্যেই লাল সরু পথ, আম্রকুঞ্জের আমগাছের সঙ্গে আলাপ, গৌড় প্রাঙ্গণ, ঘণ্টাঘর, শ্যামলী, উদয়ন সর্বোপরি সেই বিখ্যাত ছাতিম গাছ যার তলায় বসে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ সাধনায় মগ্ন হয়ে যেতেন। এ যেন এক অন্যরকম পরিবেশ, প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের ভালোবাসার বন্ধন, মহামানবের মিলনমেলা। মুগ্ধ হয়েছি কলাভবনের ভাস্কর্য দেখে, সংগীত ভবনের ভেতর থেকে ভেসে আসা সুরের মূর্ছনায় কিছুক্ষণের জন্য হারিয়ে যাওয়া। তখনই শান্তিনিকেতনকে ভালো লেগে যাওয়া বা প্রেমে পড়া।
১৮৬২ সালে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ বোলপুরে বন্ধুর বাড়ি আসেন। তখন শান্তিনিকেতন ছিল ধু-ধু মাঠ আর ডাঙা। তার ওপর ভুবন ডাকাতের অত্যাচার। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের এই ছাতিমতলা ও তার আশপাশের নিরিবিলি পরিবেশ খুবই পছন্দ হয়ে যায়। তিনি অনুভব করেন এখানে তিনি মনের শান্তিতে সাধনা করতে পারবেন।
মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ বন্ধু রায়পুরের জমিদারদের কাছ থেকে এই জায়গাটি মাত্র এক টাকার বিনিময়ে শুভেচ্ছাস্বরূপ কিনে নেন। আসলে জমিদার ভুবন মোহন সিংহ বন্ধুকে এই ডাঙা জমি বিনামূল্যেই দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ কিছুতেই বিনামূল্যে নিতে রাজি হননি। তখন এক টাকা নিয়ে প্রায় কুড়ি একর জমি বন্ধুর কাছে বিক্রি করেন জমিদার ভুবন মোহন সিংহ। এখানেই মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ শান্তির নীড় শান্তিনিকেতনে গৃহ স্থাপন করেন। এই ছাতিমতলাতেই তিনি অনুভব করেছিলেন প্রাণের আরাম, মনের আনন্দ ও আত্মার শান্তি। এই ছাতিমতলার কাছেই রয়েছে উপাসনাগৃহ কাচঘর।
১৯০১ সালে এখানে স্থাপিত হয় ব্রহ্মচর্য আশ্রম। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতন আশ্রমের যে বীজ বপন করেছিলেন তার পূর্ণ বিকাশ ঘটাতে রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে আসেন। জীবনস্মৃতিতে আমরা পড়েছি রবীন্দ্রনাথ কোনোদিনই স্কুলের চারদেয়ালের গণ্ডির মধ্যে শিক্ষাব্যবস্থা পছন্দ করেননি। তিনি চেয়েছিলেন ছাত্রছাত্রীরা প্রকৃতির কোলে বসে মনের আনন্দে শিক্ষা নেবে। ১৯০১ সালে মাত্র ৫ জন ছাত্র নিয়ে আশ্রম বিদ্যালয় তপোবনের আদর্শে স্থাপন করেছিলেন। পরবর্তীকালে ১৯২১ সালের ৮ পৌষ আম্রকুঞ্জে মহাসমারোহে রবীন্দ্রনাথ তার বিশ্ববিদ্যালয়কে সর্বসাধারণের উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করেন। দার্শনিক ব্রজেন্দ্রনাথ শীল ওই সভায় সভাপতিত্ব করেন। রবীন্দ্রনাথ এ সভায় বিশ্বভারতীকে সব মানবজাতির তপস্যা ক্ষেত্র হিসেবে উল্লেখ করেন।
১৯০১ সালে স্থাপিত শান্তিনিকেতন ব্রহ্মচর্যাশ্রমে বিশ্বভারতী স্থাপনের যে চারাগাছ রোপিত হয়েছিল তা ১৯২১ সালের ৮ পৌষ মহীরুহে পরিণত হয়। আর বর্তমানে এখানে ষাটের বেশি ডিপার্টমেন্ট, অগণিত ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষক-কর্মী আছেন। বিশ্বভারতীকে রবীন্দ্রনাথ বিশ্বের দরবারে তুলে ধরতে চেয়েছিলেন। সবার জন্য বিশ্বভারতীর অবারিত দ্বার, প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের মিলন ঘটাতে দিয়েছিলেন, চেয়েছিলেন সীমাহীন জ্ঞানের প্রসারতা। ‘দিবে আর নিবে মিলাবে মিলিবে যাবে না ফিরে’ কালোত্তীর্ণ পুরুষ কবিগুরুর সব সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উদার চিন্তাধারার ছাপ এই দুই লাইনে উপলব্ধি করা যায়। রবীন্দ্রনাথ উপলব্ধি করেছিলেন শুধু শিক্ষাদান নয়, বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে বিশ্বভারতীকে পৌঁছাতে গেলে কলা ও সংস্কৃতির প্রাণকেন্দ্র করে তুলতে হবে। তাই একে একে তিনি বিশ্বভারতীতে সংগীতচর্চা, নৃত্য, নৃত্যনাট্য স্থাপত্য কলাসংস্কৃতির ধারক ও বাহক করে তোলেন।
এ ছাড়া বিভিন্ন ভাষায় শিক্ষাদান শুরু হয়। গান্ধীজি, নেতাজী, বেনারস থেকে ক্ষিতিমোহন শাস্ত্রী, বিধুশেখর শাস্ত্রী, নন্দলাল বসু, হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় ইত্যাদি অনেক প্রখ্যাত ব্যক্তিত্ব এসে রবীন্দ্রনাথের চিন্তাধারাকে বাস্তবে রূপ দিতে সহায়তা করলেন। বিশ্বমানবতাবাদকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হলো শান্তিনিকেতনে। তারা কবিতা, নাটক, গান লেখার মধ্য দিয়ে শান্তিনিকেতনে বিশ্বমানবের মিলনের আহ্বান জানান। ১৯১৩ সালে লন্ডন মিশনারি কলেজের উদ্ভিদবিজ্ঞানের অধ্যাপক ও পাদরি পিয়ারসন শান্তিনিকেতনে আসেন এবং এখানকার প্রকৃতি ও পরিবেশ দেখে মুগ্ধ হয়ে তিনি এখানেই তার জীবন সমর্পণ করেন। এখানে একটি সাঁওতাল গ্রামের নাম পিয়ারসন পল্লী। বিশ্বভারতী হসপিটালের নাম পিয়ারসন মেমোরিয়াল হাসপাতাল।
১৯২৬ সালে শিক্ষাসত্র শ্রীনিকেতনে স্থানান্তরিত হয়। শিক্ষাসত্রে শুধু গ্রামের দুস্থ গরিব ছাত্রছাত্রীরা পড়াশোনা করতে পারত। এছাড়া শিক্ষার্থীদের নানারকম বৃত্তিমূলক শিক্ষা, যেমন- কৃষি, পশুপালন, কুটিরশিল্পে উৎসাহ দেওয়া হতো। এখানে শিক্ষার্থীদের বিনা বেতনে শিক্ষা দেওয়া হতো।
শিশু ও কিশোর-কিশোরীদের শিক্ষার লক্ষ্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আনন্দ পাঠশালা, পাঠভবন ও উত্তর শিক্ষা বিদ্যালয় স্থাপন করেন। আনন্দ পাঠশালা স্থাপনের ক্ষেত্রে মৃণালিনী দেবীর অনেক অবদান ছিল। এই ব্রহ্মচর্যাশ্রম ও বিদ্যালয়গুলোর লক্ষ ছিল সর্বাঙ্গীণ ব্যক্তিত্বের বিকাশ তথা শিল্প, সাহিত্য, কলা, সংস্কৃতির বিভিন্ন ক্ষেত্রে যাতে শিক্ষার্থীর বিচরণ ঘটে তা দেখা। গাছের তলায় প্রকৃতির উন্মুক্ত গ্রাঙ্গণে ছোট ছোট শিশু শিক্ষার্থীদের শিক্ষাদান দেখে মনে হয় সত্যিই যেন তপোভূমিতে চলে এসেছি ঠিক যেমনভাবে বহু যুগ আগে মুনি-ঋষিরা তাদের শিষ্যদের প্রকৃতির কোলে শিক্ষাদান করতেন।
১৯৫১ সালে দিল্লির পার্লামেন্টে একটি বিল পাসের মাধ্যমে বিশ্বভারতীকে কেন্দ্রীয় সরকারের অনুমোদিত বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। কবির জীবনে এসেছে অনেক মৃত্যু, অনেক শোক। ১৯০১ সালে শান্তিনিকেতন আশ্রম প্রতিষ্ঠিত হয়, ১৯০২ সালে মৃণালিনী দেবী চলে যান, ১৯০৩ সালে রেণুকা, ১৯০৫ সালে পিতৃদেব, ১৯০৭ সালে প্রাণপ্রিয় সন্তান শমীন্দ্রনাথ, ১৯১৮ সালে মাধবীলতা চলে গেলেন। কবির হৃদয়ে উঠেছে ঝড়, প্রিয়জনদের মৃত্যুর আঘাতে বারবার ক্ষতবিক্ষত হয়েছেন তিনি, কবির মনে চলেছে অনেক ভাঙা-গড়া তবু তিনি তার আদর্শ, তার চিন্তাধারা, তার কর্মধারা থেকে বিচ্যুত হননি।
ব্রহ্মচর্যাশ্রম স্থাপনের কিছুদিন পর থেকেই কিছু কিছু উন্নয়ন ও রূপান্তর ঘটছে শান্তিনিকেতনে। ১৯১৮ সালে বিদ্যুৎ আসে, ঘরে ঘরে আলো জ্বলে। ওই বছরই মোটরবাস চালু হয় যাতায়াতের সুবিধার জন্য।
শান্তিনিকেতনে প্রাকৃতিক পরিবেশে শিক্ষাদানের সাথে সাথে নৃত্যগীত, নাটক, চিত্রকলা, ভাস্কর্য ইত্যাদি শিল্প-সংস্কৃতির উত্তরোত্তর বিকাশ ঘটান রবীন্দ্রনাথ এবং বিশ্বমানবের কাছে শান্তিনিকেতনকে পৌঁছে দেন। শান্তিনিকেতনের পৌষমেলা ও বসন্ত উৎসব বিশ্বমানবের মিলনমেলা। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে নানান ধরনের মানুষের সমাগম হয় পৌষমেলায়, শান্তিনিকেতনের আকাশে বাতাসে রবীন্দ্রসংগীতের সঙ্গে সঙ্গে কবিগান, বাউলগান ধ্বনিত হয়, বিভিন্ন রাজ্যের আঞ্চলিক নৃত্যগীত পরিবেশিত হয়। ভারত তথা বিশ্বের নানান স্থান থেকে কবি সাহিত্যিক শিল্পীরা আসেন এই মেলায়। শিল্প-সংস্কৃতির চিন্তাধারা বিনিময় হয়।
হয়তো কবিগুরুর সময় থেকে এখনকার শান্তিনিকেতনে পরিবেশ পরিস্থিতি অনেকটা পরিবর্তন হয়েছে কিন্তু কবিগুরুর আদর্শ ও ভাবধারা বজায় রেখে আজও বিশ্বভারতী শিক্ষা সংস্কৃতি কলার প্রাণকেন্দ্র হয়ে বিশ্বের দরবারে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।
শান্তিনিকেতনে বিশাল এলাকা নিয়ে গড়ে তোলা হয়েছে বাংলাদেশ ভবন। অত্যাধুনিক দোতলা এ ভবনটিতে আছে একটি মিলনায়তন, জাদুঘর এবং গ্রন্থাগার। গ্রন্থাগারের জন্য বাংলাদেশ থেকে নেওয়া হয়েছে সাড়ে তিন হাজার বই।
বাংলাদেশের টাকায় নির্মিত অত্যাধুনিক এ ভবনটি উদ্বোধন করেন বাংলাদেশ ও ভারতের দুই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও নরেন্দ্র মোদি। চার জোনে বিভক্ত জাদুঘরে উয়ারী বটেশ্বরের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন দিয়ে শুরু করে শেষ হয়েছে মুক্তিযুদ্ধ পর্বে।