সবাইকে মানুষ হতে হবে


হীরেন পণ্ডিত: ১৯৪৭ সালে ধর্ম দিয়ে ভাগ করে সাধারণ মানুষকে শোষণ করার এই ব্রিটিশ কৌশল বহু পুরোনো, এই কৌশলে তারা সফল হয়েছিল। এই কৌশলে ব্রিটিশরা মানুষ হওয়ার আগে ভারত উপমহাদেশের মানুষকে হিন্দু অথবা মুসলমান হিসেবে দেখিয়েছিল। তাদের কলোনিতে ফেলে আমাদের মাঝে একে অন্যকে অপছন্দ করার এমন বিষবাষ্প ছড়িয়ে-ছিটিয়ে খানিকটা মাথায় ঢুকিয়ে দিয়েছিল যা প্রায় শতাব্দীর পথ পরিক্রমায় আমরা এর থেকে বের হতে পারিনি। হয়তোবা এখন মাথার মধ্যে আরও বেশি কাজ করে।

বিজ্ঞানের চরম উৎকর্ষতার যুগে, ডিজিটাল বাংলাদেশ, স্মার্ট বাংলাদেশ হতে যাচ্ছি আমরা। কিন্তু মানসিকতায় পড়ে আছি কোন যুগে তা বের করার জন্য গবেষণা প্রয়োজন। বর্বর বা মধ্যযুগে না তথাকথিত আধুনিক যুগে সেটি বের করতে হবে। আমরা এখনও পড়ে আছি এমন কিছু বিষয় নিয়ে যা খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ নয় আমাদের জীবনে, এমনকি পৃথিবীর জন্যও তো নয়ই। আমাদের মাথা থেকে প্রগতির কথা, আধুনিকতার কথা, মানবতাবাদ এগুলো প্রায় বাদ দিয়েছি বা দিতে যাচ্ছি। এত উন্নয়ন ঘটছে কিন্তু মানসিকতার দিক থেকে আমরা আরও পিছিয়ে পড়ছি কি না তা ভাবার সময় এসেছে। তাই আমাদের সাংস্কৃতিক আন্দোলন কর্মকাণ্ডে আরও একটু বেশি মনোনিবেশ করা প্রয়োজন।

প্রযুক্তির কল্যাণে এখন মুহূর্তেই মানুষের চিন্তা-চেতনা দৃষ্টি চলে যায় বিশ্বের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। কিন্তু আমাদের মনের কালো আর ধর্মান্ধতা আর গেল না, আর যাবেও না হয়তোবা কোনো দিন। কি বাংলাদেশ, কি ভারত, কি আমেরিকা, কি সুইডেন বা মিয়ানমার কেউ পিছিয়ে নেই। এখনও আমরা কেউ মানুষ নই, কেউ বা হিন্দু, কেউ বা মুসলমান, কেউ বা খ্রিস্টান, কেউ বা বৌদ্ধ, কেউ বা ইহুদি। তবে মৌলবাদী ও ধর্মান্ধ তা হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, ইহুদি রয়েছে তাদের মধ্যে মূলত কোনো পার্থক্য নেই মনে হয়।

মানবতাবাদ এদের কাছে কিছু নয়, নিজেদের স্বার্থই আসল। সাধু বা ভালো মানুষ সাজা বা ভান করার চেয়ে সাধু বা ভালো মানুষ হওয়াই উত্তম এটি যদি সবাই মনে রাখত তা হলে আমাদের সমাজ, পৃথিবী মানবজাতি আরও এগিয়ে যেত।

মানুষের প্রতি মানুষের সহমর্মিতা বিলীন হয়ে যাচ্ছে। প্রেম-ভালোবাসা ও দয়া-মায়া, শ্রদ্ধাবোধ ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের মধ্যে থেকে। আমরা কিন্তু মানবীয় গুণাবলি হারিয়ে ক্রমেই মানুষ হিসেবে নয়, ক্রমেই অমানুষ হয়ে হিংস্র প্রাণীর মতো নিষ্ঠুর আচরণ করছি। এমন কেন হচ্ছে? আমরা যত শিক্ষিত হচ্ছি আমাদের মধ্যে মানবতাবোধ যেখানে বৃদ্ধি পাওয়ার কথা সেখানে মানবতাবোধ প্রতিনিয়ত কমে যাচ্ছে। কিন্তু কেন? শিক্ষিত মানুষের মধ্যে মানবীয় গুণাবলি আরও বেশি থাকার কথা, তা কিন্তু এখন আর দেখা তেমন দেখা যাচ্ছে না।

নিজেদের প্রাপ্তির জন্য আমরা সবাই আত্মকেন্দ্রিক হয়ে কাজ করছি। সবাই নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত আছি। দেশ, সমাজ, পরিবার, সন্তানকে নিয়ে ভাবছি আমরা? আর কত সামাজিক ও নৈতিক অবক্ষয় প্রয়োজন আমাদের ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য? আর কতদিন অপেক্ষা প্রয়োজন হবে নিজেদের একজন আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য? সন্তানদের আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য? এ প্রশ্ন কার কাছে রাখব? সমাজের কাছে রাখব? রাষ্ট্রের কাছে চাইব? সমাজের অধিবাসীদের কাছে চাইব? সরকারের কাছে চাইব? সবাই নিজেকে নিয়েই শুধু ব্যস্ত রয়েছি, শুধু ভাবছি নিজেকে নিয়ে। সুন্দর একটি দেশ, সমাজ বিনির্মাণের কথা কখনো ভাবি না আমরা।

আমরা আমাদের অর্জনকে ধরে রাখতে পারি না। শিক্ষক ক্লাসে পড়ানোর চেয়ে ব্যস্ত থাকেন তার কোচিং সেন্টার নিয়ে, এই ছাত্ররা যে আমাদের ভবিষ্যতের হাল ধরবে তাদের সেভাবে তৈরি করতে হবে, তা নিয়ে ভাবার সময় কি আছে? আর সন্তানের মা-বাবা ব্যস্ত রয়েছেন জীবনযাত্রার মান বাড়ানোর জন্য, দিনরাত পরিশ্রম করে আনা অর্থ কোনো কাজে লাগছে কি না সে বিষয়ে কারও চিন্তা করার সময় নেই। সন্তান কি শিখছে, কি করছে, কোথায় যাচ্ছে, কার সঙ্গে মিশছে, সে খেয়াল রাখার মতো অবস্থায় আমরা নেই। কিন্তু কেন এমন তো হওয়ার কথা ছিল না! কেন এমন হলো তা নিয়ে সরকার ও নাগরিক সমাজকে ভাবতে হবে। সমন্বিত প্রচেষ্টা ছাড়া এগুলো থেকে বের হয়ে আসা কোনোভাবেই সম্ভব নয়।

ভালো-মন্দের বিচার ক্ষমতা দ্বারা যে বিবেক নির্ধারিত হয় সে ব্যাপারে সবাই একই বিন্দুতে থাকবেন নিঃসন্দেহে তা বলা সম্ভব। ভিন্ন বিন্দুতে থাকবেন ভালো-মন্দ আলাদা করা নিয়ে অর্থাৎ কোনোটা ভালো ও কোনোটা মন্দ সেটি নির্ধারণে ভিন্ন ভিন্ন মত থাকবে। এ ভিন্নতা হতে পারে ব্যক্তি, সমাজ, এলাকা, সময়, ঘটনা ইত্যাদির ওপর নির্ভর করে। বিবেকের কাজ হলো কোনো কিছুর ভালো-মন্দ, সুবিধা-অসুবিধা, সক্ষমতা-অক্ষমতা, নীতির কাছে সঁপে দিয়ে বর্তমানকে ভিত্তি ধরে ভবিষ্যৎ ভাবনাকে বিচার করে উপযুক্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণে মানবসত্তাকে সহযোগিতা করা, কিন্তু আসল সিদ্ধান্তে আসতে হবে সত্তা নিজেকেই।

আমরা প্রত্যেকেই দেশের শান্তির কথা বলি, সবার মিলনের কথা বলি, উজ্জ্বলতার কথা বলি, নীতির কথা বলি, সত্যের কথা বলি, সাফল্যের কথা বলি এমনকি এসব কথা শুনতেও পছন্দ করি, কাজের বেলায়ও এসবের তরে নিজেকে সঁপে দিতে ভালো লাগে, কিন্তু যখন দেখা যায়, অন্যের তুলনায় নিজের থলেটা তেমনভাবে পূর্ণ হচ্ছে না তখনই বিবেক হয়ে ওঠে হিংস্র। আর যে শান্তি কিংবা অন্য ইতিবাচক কিছুর জন্য নিজেকে তুলে ধরা হয়েছিল সেসব কিছু একটি অসুস্থ বিবেক এসে ঢেকে ফেলে যেমন করে মেঘ এসে আকাশের নীলকে অদৃশ্য করে দেয়, যা নিতান্তই কষ্টের জন্ম দেয় সবার।

কিন্তু আমরা কি বিবেক নিয়ে ভাবি? এখন আমরা ব্যস্ত আছি কে কতটা নিচে নামতে পারি সেই প্রতিযোগিতায়। কি পরিমাণ নৈতিক স্খলন হচ্ছে প্রতিদিন তা আমরা ভেবে দেখি না, জীবনযাত্রার দৌড়ে সবাই শামিল কে কাকে কীভাবে পেছনে ফেলে নিজে এগিয়ে যাবে তা নিয়েই ব্যতিব্যস্ত, বিবেকের স্খলন হচ্ছে তা আমাদের কাছে ব্যাপার না। যেকোনো মূল্যে সম্পদশালী হতে হবে। আমাদের কাছে থাকা মানবীয় গুণাবলি বিসর্জন দিচ্ছি প্রতিনিয়ত, সম্পদ আহরণের জন্য, ভোগ বিলাসের জন্য। আমাদের মাঝ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে নীতি-নৈতিকতা, লোপ পাচ্ছে আমাদের ভালো-মন্দ বিচার করার ক্ষমতা। মানুষের প্রতি সহমর্মিতা বিলীন হয়ে যাচ্ছে কালের গর্ভে, প্রেম-ভালোবাসা ও দয়ামায়া ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের মাঝ থেকে।

এখন সহনশীলতা ও ধৈর্য আমরা হারিয়ে ফেলেছি। শিক্ষার হার এত যে বাড়ছে তাতে কী লাভ হচ্ছে? শিক্ষিত হয়ে আমরা আরও বর্বরতার দিকে ধাবিত হচ্ছি কি না তা ভেবে দেখার সময় এসেছে। কোনো ধরনের শিক্ষাই আমাদের মূল্যবোধ ও মনুষ্যত্ববোধ তৈরিতে সহায়ক হচ্ছে না। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, আমরা ক্রমেই আদিম যুগে ফিরে যাচ্ছি। ব্যাপারটি নিয়ে গভীরভাবে ভাবা জরুরি। একবার খাদের কিনার থেকে ছিটকে নিচে পড়ে গেলে কোমর সোজা করে উঠে দাঁড়ানো জাতির জন্য কঠিন হয়ে যাবে।

টাকার জন্য মান-সম্মান, আত্মসম্মানবোধ বিসর্জন দিতে প্রস্তুত আছি! অন্যদিকে সমাজ বিনির্মাণে, রাষ্ট্রের একজন আদর্শ নাগরিক হিসেবে রাষ্ট্র, সমাজ ও পরিবারে আমাদের যে কিছু দায়িত্ব রয়েছে, সেগুলো আমরা সঠিকভাবে পালন করছি কি না কিংবা বেমালুম ভুলে যাচ্ছি কি না সেটি ভেবে দেখার সময় এসেছে।

একজন শিক্ষকের কাছে থাকা প্রশ্ন যদি পরীক্ষার আগেই ফাঁস হয়ে যায়, তিনিই বা কেমন শিক্ষক? তিনিই বা কী নৈতিকতা শিক্ষা দেবেন তার ছাত্রকে! আর জাতি বা তার কাছ থেকে কী আশা করতে পারে?

আমি আমার পবিত্র নৈতিকতাকে বিসর্জন দিয়ে দিই, তা হলে তো আর কিছু বলার থাকবে না। আমি আমার দেশকে ভালোবাসি এই স্লোগানে আমাদের সবাইকে এক কাতারে এসে দাঁড়াতে হবে, এ জন্য নাগরিক সমাজকে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। কারণ আগে জাতি হিসেবে আমাদের সব সামাজিক ও নৈতিক অবক্ষয় দূর করতে হবে।

নৈতিক অবক্ষয়ের দিক থেকে আমাদের দেয়ালে পিঠ ঠেকেছে, চলুন, আমরা আবার সামনের দিকে ঘুরে দাঁড়াই, নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে, আমাদের সুকুমার বৃত্তিগুলোকে সঠিকভাবে কাজে লাগিয়ে, বাংলাদেশকে আরও সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাই। ৩০ লাখ শহিদের আত্মত্যাগ ও অসংখ্য মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশকে এক সুন্দর বাংলাদেশে পরিণত করি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *