ঝুঁকিপূর্ণ শ্রম নয়জীবন বিকশিত হোক


হীরেন পণ্ডিত: ‘শিশুশ্রম’ শব্দটার সঙ্গে আমরা সবাই কম-বেশি পরিচিত এবং চোখের সামনে অহরহ দেখছি। শিশুশ্রমের আক্ষরিক অর্থ হলো ‘শিশুদের দ্বারা শ্রম’ বা শিশুদের মাধ্যমে যে শ্রম তাই শিশুশ্রম। এর সর্বজন গ্রাহ্য অর্থ হলো আর্থিক লেনদেনসহ অথবা আর্থিক লেনদেন বা খাবার দেওয়া বা যেকোনো কিছুর বিনিময়ে শিশুদের কোনো কাজের জন্য নিয়োগ করা হলে তা শিশুশ্রমের আওতায় পড়ে। কিন্তু শোষণমূলক বিবেচনায় অনেক দেশই এই শিশুশ্রমকে অবৈধ ঘোষণা করেছে।

বাংলাদেশ সংশোধিত শ্রম আইন ২০১৮ অনুযায়ী, ১৪ বছরের নিচে কোনো শিশুকে শ্রমে নিযুক্ত করা যাবে না। তবে ১৪-১৮ বছর পর্যন্ত শিশুরা ঝুঁকিপূর্ণ নয়, এমন হালকা কাজ করতে পারবে।

সব ধরনের শিশুশ্রম নির্মূল করার অঙ্গীকার আমাদের আছে। টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট ৮ এর ৭ নং লক্ষ্যে সেটিই বলা হয়েছে। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) সংশ্লিষ্ট কনভেনশন ১৩৮ এবং জাতিসংঘের শিশু অধিকার-সংক্রান্ত কনভেনশনে অনুস্বাক্ষর করেছে সরকার। এসব কনভেনশনে শিশুকে সব ধরনের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড থেকে মুক্ত রাখার কথা বলা হয়। এসব প্রতিশ্রুতি ও বাধ্যবাধকতার আলোকে শ্রম মন্ত্রণালয় ২০২৫ সালের মধ্যে সব ধরনের শিশুশ্রম নিরসনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে।

২০২৩ সালের ১৯ জুলাই বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর খেটে খাওয়া শিশুদের নিয়ে তাদের এক অন্তর্র্বর্তীকালীন জরিপের ফলাফল আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করে শিশুশ্রম জরিপ ২০২২। এর আগে ২০১৩ সালে একই শিরোনামে আগের জরিপটি করা হয়েছিল। জরিপে দেখা যাচ্ছে, শিশু শ্রমিকের সংখ্যা গত ১০ বছরে না কমে বরং বেড়েছে। তবে কমেছে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত শিশুর সংখ্যা।

শ্রমে নিয়োজিত শিশুদের তথ্য জানতেই জরিপটি পরিচালনা করা হয়। সারা দেশের ৩০ হাজার ৮১৪ খানা থেকে জরিপের তথ্য সংগ্রহ করা হয়। ৫ থেকে শুরু করে ১৭ বছর বয়সিদের জরিপে শিশু হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। জরিপ অনুযায়ী, দেশে ৫-১৭ বছর বয়সি শিশুর সংখ্যা ৩ কোটি ৯৯ লাখ ৬৪ হাজার। এর মধ্যে শ্রমজীবী শিশুর সংখ্যা ৩৫ লাখ ৩৬ হাজার ৯২৭। শিশুশ্রমে নিয়োজিত ছিল ১৭ লাখ ৭৬ হাজার ৯৭ জন।

আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা এবং ইউনিসেফ পরিচালিত জরিপ অনুযায়ী, দেশের শহরাঞ্চলে প্রায় ৩০০ ধরনের অর্থনৈতিক কাজে শিশুরা শ্রম দিচ্ছে। বিভিন্ন ধরনের ৭০৯টি কারখানার মধ্যে জরিপ চালিয়ে দেখা যায়, সেখানে মোট ৯ হাজার ১৯৪ জন শ্রমিকের মধ্যে ৪১ দশমিক ৫ শতাংশ, অর্থাৎ ৩ হাজার ৮২০ শিশু। এই শিশু শ্রমিকদের অধিকাংশেরই বয়স ১০-১২ বছরের মধ্যে। শ্রম আইন সেখানে কেবলই কিছু কাগজ।

শিশুশ্রম নিরসনে বাংলাদেশ সরকার ৩৮টি ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রমকে নির্ধারণ করে ২০২৫ সালের মধ্যে সেগুলোকে বন্ধ করার অঙ্গীকার করেছে। এ বিষয়ে ২০১৩ সালে গেজেট প্রকাশ করা হয়। গত বছর আরও পাঁচটি কাজকে ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করা হয়েছে। ৪৩টি ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করলে শিশুদের নিউমোনিয়া, কাশি, আঙুলে দাদ, দুর্ঘটনাজনিত দৈহিক ক্ষত, ফুসফুসে দীর্ঘস্থায়ী প্রদাহ, হাঁপানি, যকৃতের দুরারোগ্য ব্যাধি, মূত্রাশয় ক্যানসারের মতো রোগ হতে পারে বলে সতর্ক করা হয়েছে। বাংলাদেশের ঝালাই বা ওয়েল্ডিং, সড়ক ও পরিবহন, যন্ত্রাংশ নির্মাণ কারখানা, তামাক কারখানা, ব্যাটারি ইত্যাদি ঝুঁকিপূর্ণ খাতে শিশুদের নিয়োজিত থাকার ব্যাপারে জাতিসংঘের শিশু অধিকারবিষয়ক কমিটি উদ্বেগ প্রকাশ করে আসছে অনেক দিন ধরে।

জাতিসংঘ বলছে, রুজি-রুটির সন্ধানে শিশুরা স্কুল ছেড়ে দিয়ে যে ক্রমবর্ধমান হারে কাজে যোগ দিচ্ছে তাতে কয়েক লাখ শিশুর ভবিষ্যৎ ঝুঁকিতে পড়তে যাচ্ছে। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) মহাপরিচালক জানান, বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক সমস্যার কারণে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে অর্জিত সামাজিক অগ্রগতি হারিয়ে যাচ্ছে বা রিগ্রেশন হচ্ছে। এখনই জরুরি পদক্ষেপ প্রয়োজন। মুদ্রাস্ফীতি বৃদ্ধি এবং জীবনযাত্রার ব্যয়ের সঙ্গে করোনার প্রভাব যুক্ত হয়ে পরিস্থিতি আরও খারাপ করেছে। সমস্যাটি আরও খারাপ হতে থাকবে, যদি না আমরা এখন কাজ শুরু করি।

বর্তমান বিশ্বে ১৫ বছরের নিচে প্রায় এক-দশমাংশ শিশু বিভিন্নভাবে বিভিন্ন পেশায় বা কাজে নিযুক্ত রয়েছে। এদের বেড়ে ওঠা আর বেঁচে থাকা দুই-ই হয় চরম দারিদ্র্য আর বঞ্চনার মধ্য দিয়ে, জীবনের শুরুই হয় নানা বঞ্চনার আর অবহেলা দিয়ে। উন্নত জীবনের জন্য শিক্ষাগ্রহণ ও দক্ষতা উন্নয়নের কোনো সুযোগ থেকে তারা থাকে নির্বাসিত এবং এগুলো তাদের জীবনে হয়তো এগুলো স্বপ্ন হয়ে চোখের সামনে ভাসে। আইএলওর পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বর্তমান বিশ্বের প্রায় ১৬ কোটি ৮০ লাখ শিশু নানাভাবে শ্রম বিক্রি করছে। এদের মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ পেশায় নিয়োজিত প্রায় সাড়ে ৮ কোটি শিশু। বিভিন্ন ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত প্রায় ১২ লাখ ৮০ হাজার শিশু। শ্রম মন্ত্রণালয়ের হিসেব মতে, ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করে দেশের ১৩ লাখ শিশু। বর্তমানে এই সংখ্যাটা আরও অনেক বেশি। ২০০৬ সালের শিশু সনদে ১৪ বছরের কম বয়সি শিশুদের সার্বিক শ্রম এবং ১৮ বছরের কম বয়সি শিশুদের ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োগ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এতে কারখানায় ১৮ বছরের কম বয়সের শ্রমিক নিয়োগ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। দেশে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম বন্ধের সময়সীমা বারবার পিছিয়ে যাচ্ছে। সবশেষ ২০২১ সালের মধ্যে দেশ ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম মুক্ত করার লক্ষ্য নির্ধারণ হলেও তা
সম্ভব হয়নি।

আমরা এখনও শিশুশ্রম কিংবা ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম বন্ধ করতে পারছি না। এটি আমাদের জন্য দুঃখজনক। দরিদ্রতা, অশিক্ষা, অসচেতনতা, আইন প্রয়োগের দুর্বলতা শিশুদের শ্রমের ঠেলে দিচ্ছে। আবার শিশুদের সস্তা শ্রমের জন্য কতিপয় অসাধু ব্যক্তি নানা রকম প্রলোভনে শিশুদের ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমে টেনে আনে। সরকারি হিসাব মতে, দেশে ৩৪ লাখ শিশুশ্রমে এবং ১৩ লাখ শিশু ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমে নিযুক্ত।

টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ২০৩০ সালের মধ্যে সব রকম শিশুশ্রম বন্ধ করার তাগিদ আছে। অথচ চারপাশে তাকালেই দেখা যায়, কত শিশু ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করছে। ২০১৮ সালের মাল্টিপল ইন্ডিকেটর ক্লাস্টার সার্ভে (এমআইসিএস) অনুযায়ী ৫-১৭ বছর বয়সি শিশুদের মধ্যে ৬ দশমিক ৮ শতাংশ শিশুশ্রমে নিয়োজিত।

শিশুদের শারীরিক এবং মানসিক বিকাশের জন্য আইনের যথোপযুক্ত ব্যবহার করে শিশুশ্রম বন্ধ করতে হবে। অতিদরিদ্র গরিব পরিবারের সন্তানরা সর্বজনীন শিক্ষা বা বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এই শিশুদের অভিভাবকরা অন্ন সংস্থানের তাগিদে তাদের সন্তানদের পাঠায় কাজ করতে। শিশুশ্রম সামাজিক শোষণের দীর্ঘস্থায়ী এক হাতিয়ার। সরকার ও ইউনিসেফসহ দেশ-বিদেশের বিভিন্ন সংগঠন আপসহীনভাবে কাজ করছে শিশুশ্রম রোধ করার জন্য। তবুও রোধ করা যাচ্ছে না শিশুশ্রম, শিশু নির্যাতন, শোষণ ইত্যাদি। ভবিষ্যৎ প্রবক্তাদের চোখে-মুখে যদি আমরা আলোর পরশ এনে দিতে চাই তা হলে সবার আগে তাদের উপযোগী পৃথিবী আমাদের গড়ে দিতে হবে এবং নিশ্চিত করতে হবে। তাদের বেড়ে উঠতে দিতে হবে অনুকূল এবং উপযুক্ত পরিবেশ।
বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অথবা সরকারের পক্ষে এককভাবে শিশুশ্রম সমস্যা সমাধান করা সম্ভব নয়। পেশাজীবী, নাগরিক সমাজ, নীতিনির্ধারক ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানসহ সবার সম্মিলিত প্রয়াসই পারে অবহেলিত শিশুদের অনুকূল এবং উপযুক্ত পরিবেশে ফিরিয়ে আনতে।

সংকটের সময় অনেক পরিবারই টিকে থাকার কৌশল হিসেবে শিশুশ্রমকে বেছে নেয়। দারিদ্র্য বৃদ্ধি, স্কুল বন্ধ ও সামাজিক সেবা প্রাপ্তি কমতে থাকায় অধিক সংখ্যায় শিশুদের কর্মক্ষেত্রে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। কোভিড পরবর্তী বিশ্বকে আমরা নতুনভাবে দেখতে চাই বলে আমাদের নিশ্চিত করা দরকার যে, শিশু ও তাদের পরিবারগুলো ভবিষ্যতে একই ধরনের ধাক্কা সামলে নিতে বিকল্প পথ খুঁজে নিতে পারে। মানসম্পন্ন শিক্ষা, সামাজিক সুরক্ষা সেবাসহ আরও ভালো অর্থনৈতিক সুযোগ ইতিবাচক এই পরিবর্তনের নিয়ামক হয়ে উঠতে পারে। অর্থনৈতিক মন্দায় অপ্রাতিষ্ঠানিক অর্থনৈতিক খাতে কর্মরত ও অভিবাসী শ্রমিকদের মতো ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠী সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাতে অপ্রাতিষ্ঠানিক কর্মী ও বেকারত্ব বৃদ্ধি, জীবনমানের নিম্নমুখী অবস্থা, স্বাস্থ্যগত সমস্যা এবং সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থার ঘাটতিসহ অন্যান্য চাপ সৃষ্টি হতে পারে। কোভিড মহামারির এই সময়ে স্কুল বন্ধ থাকায় শিশুশ্রম বৃদ্ধি পাওয়ার প্রমাণ ধারাবাহিকভাবে পাওয়া যায়। বিশ্বের ১৩০টির বেশি দেশে স্কুল বন্ধ ছিল দীর্ঘদিন যার কারণে বর্তমানে ১০০ কোটিরও বেশি শিক্ষার্থী ক্ষতিগ্রস্ত হয় যার রেশ এখনও রয়েছে।

শিশুশ্রম বৃদ্ধির ঝুঁকি মোকাবিলায় বেশ কয়েকটি পদক্ষেপের সুপারিশ করা হয়েছে। সেগুলোর মধ্যে অধিকতর সমন্বিত সামাজিক সুরক্ষা, দরিদ্র পরিবারের জন্য সহজে ঋণ পাওয়ার সুযোগ, বড়দের মানসম্মত কাজের সুযোগ বৃদ্ধি, স্কুলের বেতন বাতিলসহ শিশুদের স্কুলে ফেরা নিশ্চিত করতে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ, শ্রম পরিদর্শন ও আইন প্রয়োগে সক্ষমতা বৃদ্ধির বিষয়গুলোও রয়েছে। শিশুশ্রমের কারণে শিক্ষার অগ্রগতির সূচকে আমাদের দেশ পিছিয়ে পড়তে পারে, টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট অর্জন বিলম্বিত হতে পারে এবং শিশু অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা নানাভাবে ব্যাহত হতে পারে। এখনই এদিকে দৃষ্টি দেওয়া দরকার। ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত শিশুকে শিশুশ্রম থেকে প্রত্যাহার করতে ১ হাজার টাকার মাসিক উপবৃত্তি প্রদানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।

সম্প্রতি শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম নিরসন প্রকল্পের আওতায় ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত শিশুকে শিশুশ্রম থেকে প্রত্যাহারে ছয় মাসের উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা এবং চার মাসের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। এ শিশুরা প্রতি মাসে ১ হাজার টাকা করে উপবৃত্তি পাচ্ছে। ১ লাখ শিশুকে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম থেকে প্রত্যাহার করা হবে। ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম থেকে শুধু এই ১ লাখ শিশুকে প্রত্যাহারই নয় এসডিজির লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ২০৩০ সালের মধ্যে সব ধরনের শিশুশ্রম থেকে শিশুদের প্রত্যাহার করা হবে। ২০৪১ সালের মধ্যে শিশুশ্রমমুক্ত উন্নত-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ আমাদের লক্ষ্যে এই পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *