এসডিজি বাস্তবায়ন গতিশীল করবে তরুণরাই


হীরেন পণ্ডিত: বঙ্গবন্ধু যে স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন তা প্রধানমন্ত্রী কঠোর পরিশ্রম ও মেধা-মনন দিয়ে বাস্তবায়িত করে যাচ্ছেন একনাগাড়ে। বিশ্ব নেত্রীর হাত ধরেই এই দেশ সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ার মতো ঝকঝকে উন্নত দেশে রূপান্তরিত হবে। একমাত্র শেখ হাসিনাই পারবেন উন্নত, সমৃদ্ধ ও শান্তিময় বাঙালি জাতি ও বাংলাদেশ গড়ে তুলতে। সন্তানের থেকে বেশি মমতায় ভালোবেসেছেন দেশকে। পিতার অসমাপ্ত কাজ যে সমাপ্ত করতে হবে। নির্মাণ করতে হবে একটি অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক আর ভবিষ্যতের আধুনিক বাংলাদেশ। যা বর্তমান নতুন প্রজন্মেরও প্রত্যাশা।

গত ১৫ বছরে দেশ আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের এক নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছে। আওয়ামী লীগ সরকার ধারাবাহিকভাবে সরকার পরিচালনায় আছে বলেই এসব অর্জন সম্ভব হয়েছে। ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে উন্নত-স্মার্ট বাংলাদেশ হিসেবে গড়ে তোলার প্রত্যয়ে কাজ করছে সরকার। এ জন্য প্রেক্ষিত পরিকল্পনা-২০৪১ প্রণয়ন করে বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে। এসডিজির এজেন্ডাগুলোকে অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা এবং ২০২১-৪১ সাল পর্যন্ত পরিপ্রেক্ষিত পরিকল্পনার লক্ষ্যগুলোকে অন্তর্ভুক্ত করে বাস্তবায়নের জন্য সরকার কাজ করছে। তবে লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের চ্যালেঞ্জটি বেশ কঠিন। ইতিমধ্যে এসডিজি অর্জনে বিশ্বির এগিয়ে থাকা তিনটি দেশের মধ্যে স্থান করে নিয়েছে বাংলাদেশ।

সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্য বাস্তবায়ন শেষে জাতিসংঘ টেকসই উন্নয়ন অভীষ্টগুলো ঘোষণা করে। এতে মোট ১৭টি অভীষ্ট, ১৬৯টি লক্ষ্য ও ২৩২টি সূচক নির্ধারণ করা হয়। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণের পেছনে বড় উদ্দেশ্য ছিল বিশ্বব্যাপী দারিদ্র্যকে জয় করা এবং একই সঙ্গে পৃথিবীর প্রাকৃতিক পরিবেশকে সুরক্ষা দেওয়া। এসডিজি বাস্তবায়নে বাংলাদেশের সামনে মোটা দাগে চারটি চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এগুলো হলো-অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত করা, সামাজিক অন্তর্ভুক্তির পরিসর বাড়ানো, স্থিতিশীল সুশাসন এবং জলবায়ু পরিবর্তনরোধ ও অভিযোজন। এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে দেশে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে চলছে নানা কার্যক্রম। তবে এর গতি আশানুরূপ না হওয়ায় নির্ধারিত সময়ে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন নিয়ে সংশয় রয়েছে। এ কার্যক্রম ত্বরান্বিত করতে হবে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সম্প্রতি বৈশ্বিক খাদ্য, জ্বালানি ও অর্থনৈতিক সংকটের কারণে উন্নয়নশীল দেশগুলো এসডিজি অর্জনের সব লক্ষ্যমাত্রা কার্যকরভাবে বাস্তবায়নে আরও চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছে।

স্বল্পোন্নত দেশগুলোর অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য পর্যাপ্ত তহবিল চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। বৈশ্বিক পর্যায়ে এসডিজি সফলভাবে বাস্তবায়নে অবকাঠামোর জন্য প্রয়োজনীয় অর্থায়নের ব্যবস্থা করাটা প্রকৃতপক্ষে বৃহত্তম চ্যালেঞ্জ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। অর্থনৈতিক সূচকের দিক থেকে আমরা অনেক দূর এগিয়েছি; কিন্তু উন্নয়নকে টেকসই মনে করতে পারছি না। কারণ ঋণখেলাপির পরিমাণ বেড়েই চলছে, ক্রমেই প্রকট হচ্ছে ধনী-গরিবের আয় ও ভোগ-ব্যবধান। বিশ্বির সর্ববৃহৎ ব-দ্বীপ রাষ্ট্র বাংলাদেশ, সে ক্ষেত্রে জলবায়ুর চরমভাবাপন্ন বৈরী আচরণ এবং পরিবেশের অবনমন দেশে টেকসই প্রবৃদ্ধি অর্জনে চ্যালেঞ্জ। ২০৫০ সাল নাগাদ বাংলাদেশে ভয়াবহ পরিবেশ বিপর্যয়ের আশঙ্কা রয়েছে। উত্তাপ বাড়ার কারণে হিমবাহের গলন আরও বাড়ার আশঙ্কা। হিমালয় অঞ্চলে তৈরি হবে অসংখ্য হিমবাহ লেক। এসব লেকে বিস্ফোরণ হলে মারাত্মক বিপর্যয়ের মুখে পড়বে বাংলাদেশ।

পৃথিবীর ১৮ বিলিয়ন মানুষ অপরিশোধিত পানি ব্যবহার করতে বাধ্য হচ্ছে। ৬৬৩ মিলিয়ন মানুষের নির্দিষ্ট কোনো পানির উৎস নেই। ঢাকায় যে পরিমাণ বর্জ্য পানি তৈরি হচ্ছে তার ৮০ শতাংশই ব্যবস্থাপনার বাইরে থেকে যাচ্ছে। যুগোপযোগী পানি ব্যবস্থাপনা নীতি প্রণয়নের পাশাপাশি পানি, জনস্বাস্থ্য ও পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সম্পৃক্ত সংস্থা বা সরকারি বিভাগগুলোর সমন্বয়ও বিশেষ প্রয়োজন।

তারুণ্য মানব জীবনের সাহসী, সংগ্রামী ও সৃজনশীলতার অধ্যায়। পুরোনোকে ভেঙে, সংস্কার করে নতুন কিছু করাই যেন তারুণ্যের ধর্ম। তরুণদের চিন্তা-চেতনা, মন-মগজে পুরোনোকে সংস্কার করে নতুন কিছু করার ভাবনা তৈরি করতে হবে। সাহসিকতা ও সততার সঙ্গে তরুণ সমাজকে এই সংস্কার কাজে এগিয়ে আসতে হবে। তরুণরা এগিয়ে এলেই সমাজের সব স্তরে পরিবর্তনের শুরু হবে। আর এ ক্ষেত্রে তরুণ সমাজের সম্মিলিত প্রয়াস সবচেয়ে কার্যকরী।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর মতে, যুবদের বয়স ১৫-২৯ বছর। সরকারের যুব নীতিতে এই সীমা ১৮-৩৫ বছর। বয়সসীমা যদি ২৯ বছর ধরে যুবক হিসেবে ধরা হয়, তা হলে দেশের প্রায় ৪০ শতাংশ মানুষ এর নিচে। দেশের জনসংখ্যার একটি বড় অংশ যুবক। বিভিন্ন আর্থ-সামাজিক বৈচিত্র্যসহ বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবতে হলে তরুণদের কথা ভাবতে হবে। তরুণরা বৈশ্বিক উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়নে নেতৃত্ব দেবে। শিক্ষা, কর্মসংস্থান এবং মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর বিরূপ প্রভাব এবং প্রযুক্তিগত বৈষম্য তরুণদের মধ্যে বিচ্ছিন্নতার দিকে পরিচালিত করছে কি না তা নিয়ে ভাবার সময় এসেছে। তরুণ অনেকেই সমাজের মূল স্রোতধারা থেকে দূরে চলে যাচ্ছে কি না তা দেখতে হবে। তরুণদের এ অবস্থা নানা অসঙ্গতির সৃষ্টি করছে। এ কারণে বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় তরুণদের বিচ্ছিন্নতাকে আরও গভীরভাবে বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন।

আমাদের দেশের তরুণদের অর্জন অনেক। খেলাধুলা, শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে তরুণরা এগিয়ে যাচ্ছে। বিভিন্ন উদ্দীপনা এবং সম্ভাবনাগুলোকে ব্যবহার করে বিভিন্ন উপায়ে এগিয়ে যাচ্ছে তরুণ সমাজ। তবে তরুণদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশের শক্তি দেশ ও জাতির জন্য সঠিকভাবে ব্যবহার হচ্ছে কি না তা যেমন স্পষ্ট নয় তেমনি তা নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে। তাদের স্বেচ্ছায় মূলধারায় নেতৃত্ব দিতে হবে। আজকের তরুণ সমাজই ভবিষ্যতের নীতিনির্ধারক। তারা অনিয়ম-দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করলে সমাজ ধীরে ধীরে পরিবর্তন হতে শুরু করবে। তাই রাষ্ট্র ও সমাজের সব কল্যাণমূলক কাজে যুব সমাজের অংশগ্রহণ আবশ্যক। তরুণ সমাজ ঘুমিয়ে থাকলে অনিয়ম-দুর্নীতিতে নিমজ্জিত সমাজের আকাশ থেকে কখনো কালো মেঘের ছায়া সরবে না।

দেশের সংকটময় মুহূর্তে বিভিন্ন সরকারি উদ্যোগকে সফল করতে তারা স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করছেন। এ ছাড়াও যুবকরা দুর্যোগ-পরবর্তী উদ্ধার কাজ এবং ক্ষতিগ্রস্ত ও বেঁচে যাওয়া ব্যক্তিদের আর্থিক সহায়তা প্রদানের জন্য তহবিল সংগ্রহসহ বিভিন্ন জনকল্যাণমূলক কার্যক্রম পরিচালনা করছে। তারুণ্যের সহায়তায় বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে সমৃদ্ধির পথে।

তারুণ্যের সহায়তায় বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে সমৃদ্ধির পথে। তরুণ প্রজন্মের স্বপ্নের বাংলাদেশ। বাংলাদেশ ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনে এবং ২০৪১ সালের মধ্যে একটি উন্নত দেশে পরিণত হওয়ার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। সে জন্য বর্তমান সরকার মজুরির মাধ্যমে বিভিন্ন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করে তরুণদের জন্য উপযুক্ত চাকরি নিশ্চিত করতে উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ নিচ্ছে-উপার্জন এবং আত্মকর্মসংস্থান। আমাদের কর্মসংস্থানের দিকে নজর দিতে হবে। দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে ধ্বংস না করে সঠিকভাবে শিক্ষিত করা আমাদের সবার দায়িত্ব। মানসম্পন্ন শিক্ষার জন্য শিক্ষকদের যেমন দায়িত্ব রয়েছে, তেমনি অভিভাবকদের এবং সুশীল সমাজেরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। সরকারি দল, বিরোধী দল, নাগরিক সমাজসহ সমাজের প্রত্যেকেরই কর্মসংস্থান সৃষ্টির দায়িত্ব রয়েছে। চাকরি সৃষ্টি একটি বড় চ্যালেঞ্জ; দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে ত্রুটিমুক্ত ও দুর্নীতিমুক্ত রেখে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। বাইপাস করে চাকরি পাওয়া সম্ভব নয়। বড় ডিগ্রি নিয়েও কোনো কাজ হচ্ছে না। শিক্ষাব্যবস্থা বাজারের চাহিদার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ না হওয়ায় দেশে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বাড়ছে। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা শ্রমবাজারে দক্ষ ও শিক্ষাগতভাবে যোগ্য শ্রমিকের চাহিদা মেটাতে পারছে না। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষায় বিশেষ দক্ষতার অভাবে চাকরির বাজারের চাহিদা মেটাতে পারছে না পড়াশোনা শেষ করা তরুণ-তরুণীরা।

কলেজের স্নাতকদের মধ্যে মাত্র ১৯ শতাংশ ফুলটাইম বা পার্টটাইম নিযুক্ত, যেখানে প্রায় অর্ধেক বেকার। অধিকন্তু, মহিলা স্নাতকদের স্নাতক হওয়ার দুই বছর পরেও বেকার এবং পড়াশোনার বাইরে থাকার সম্ভাবনা অনেক বেশি: ৩৭ শতাংশ পুরুষ স্নাতকদের বিপরীতে ৪৩ শতাংশ মহিলা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক বেকার থাকে।

যদিও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দক্ষতা উন্নয়ন প্রশিক্ষণ বৃদ্ধি পেয়েছে, তবুও চাকরির বাজারে দক্ষতার বিশাল ঘাটতি রয়েছে। বেসরকারি খাতের অনেক কর্মী ছাঁটাই করা হয়েছে। তথ্যপ্রযুক্তি সম্পর্কিত জ্ঞানের অভাব, বিশেষ করে সুবিধাবঞ্চিত পরিবারের যুবকদের মধ্যে, কর্মসংস্থানের জন্য প্রয়োজনীয় প্রযুক্তিগত জ্ঞানের অভাব দেখায়, যা তাদের আরও পেছনে ঠেলে দিচ্ছে। একটি প্রগতিশীল ও সমৃদ্ধ সমাজ গঠনের জন্য যুব সমাজকে মূলধারায় যুক্ত করার জন্য আমাদের উপরোক্ত বিষয়টিতে মনোনিবেশ করা উচিত।

এসডিজি বাস্তবায়নে তরুণরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। সবার জন্য অন্তর্ভুক্তিমূলক ও মানসম্মত এবং জীবনব্যাপী শিক্ষার সুযোগ নিশ্চিত করা এবং কন্যাশিশুদের ক্ষমতায়ন করাসহ স্থায়ী অন্তর্ভুক্তিমূলক ও টেকসই অর্থনৈতিক কার্যক্রম উৎসাহিত, পরিপূর্ণ ও উৎপাদনশীল কর্মসংস্থান এবং উপযুক্ত কর্মের নিশ্চয়তার ওপর গুরুত্বারোপ করে তরুণরা কাজ করছে।

তরুণরা সুবিধা ও অধিকারবঞ্চিত মানুষের সার্বিক জীবনমান উন্নয়নের লক্ষ্যে বাল্যবিবাহ ও যৌতুক প্রতিরোধে উদ্যোগী ভূমিকা নিচ্ছে। মাদকের সর্বনাশা ছোবল থেকে সমাজকে মুক্ত রাখার লক্ষ্যে তরুণ সমাজকে সচেতন ও সংগঠিত করে গণপ্রতিরোধ গড়ে তুলছে। একটি সুস্থ, সুন্দর, উদার ও বহুমাত্রিক সমাজ গড়ে তোলার লক্ষ্যে সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠায় নিয়মিত কর্মশালা, উঠান বৈঠক করছে। অসচ্ছল পরিবারের শিশু-কিশোরদের পড়াশোনায় সহায়তা দিচ্ছে এবং বয়স্ক শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করছে। তরুণ প্রজন্ম যাতে কুসংস্কার ও পশ্চাৎপদতা থেকে বেরিয়ে আসতে পারে; সহিংসতা প্রতিরোধ করতে পারে; বিজ্ঞানমনস্ক এবং যুক্তিবাদী হিসেবে গড়ে উঠতে পারে সে লক্ষ্যে দেশে বেশি করে বিজ্ঞান ক্লাব গড়ে তোলা প্রয়োজন। বিজ্ঞান ক্লাবগুলো হবে স্টাডি সার্কেলের মাধ্যমে নিজেদের আলোকিত মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার চর্চা কেন্দ্র। তরুণদের এসডিজি বাস্তবায়নে আরও সম্পৃক্ত করতে হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *