হীরেন পণ্ডিত: ১৯৪৮ সালের মার্চ মাসে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে ভাষণ দিয়ে বলেন, পাকিস্তানের প্রদেশগুলো তাদের দাপ্তরিক কাজে যে কোনো ভাষা ব্যবহার করতে পারে, কিন্তু রাষ্ট্রভাষা হবে একটিই, সেটি হবে উর্দু। সে সময় কার্জন হলে উপস্থিত কিছু ছাত্র ‘না’ ‘না’ বলে চিৎকার করে প্রতিবাদ করে এবং পরে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর কাছে স্মারকলিপি দেয়, যাদের অনেকেই সেই সময়ে জিন্নাহর মুসলিম লীগের সদস্য ছিলেন। স্মারকলিপিতে বাংলাকে অন্যতম জাতীয় ভাষা করার দাবি করে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের উদাহরণ দেয়া হয়েছে, যেখানে একাধিক জাতীয় ভাষা গ্রহণ করা হয়েছে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ মাতৃভাষার অধিকার রক্ষায় ভাষা আন্দোলন শুরু হয়। ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ গ্রন্থে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, “আমরা দেখলাম, বাংলাকে বাদ দিয়ে উর্দুকে জাতীয় ভাষা করার বড় ষড়যন্ত্র চলছে। পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ এবং তমদ্দুন মজলিশ প্রতিবাদ করে এবং বাংলা ও উর্দু উভয়কেই রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানায়। আমরা মিটিং করে প্রতিবাদ শুরু করি। এ সময় পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ ও তমদ্দুন মজলিশ যৌথভাবে সর্বদলীয় সভা আহ্বান করে এবং ‘রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ গঠন করে। সভায় ১৯৪৮ সালের ১১ই মার্চকে ‘বাংলা ভাষা দাবি’ দিবস ঘোষণা করা হলো। জেলায় জেলায় আমরা বের হয়ে পড়লাম।” (পৃষ্ঠা-৯১, ৯২)। ১৯৪৮-এর ১১ মার্চ অন্যতম রাষ্ট্রভাষার দাবিতে বাংলার ছাত্রসমাজ প্রথম প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করে। সেদিন যারা মাতৃভাষার দাবিতে রাজপথে সংগ্রাম করে কারাবরণ করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব এবং জনাব শামসুল হক ছিলেন তাদের অন্যতম। ১১ থেকে ১৫ মাচ- -এই পাঁচ দিন কারারুদ্ধ ছিলেন নেতৃবৃন্দ। পাঁচ দিনের কারাজীবনের স্মৃতিচারণ করে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, “দেওয়ালের বাইরেই মুসলিম গার্লস স্কুল। যে পাঁচ দিন আমরা জেলে ছিলাম সকাল দশটায় মেয়েরা স্কুলের ছাদে উঠে সেøাগান দিতে শুরু করত, আর চারটায় শেষ করত। ছোট্ট ছোট্ট মেয়েরা একটু ক্লান্তও হতো না। ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’, ‘বন্দি ভাইদের মুক্তি চাই’, ‘পুলিশি জুলুম চলবে না’ নানা ধরনের সেøাগান। এই সময় শামসুল হক সাহেবকে আমি বললাম, হক সাহেব ঐ দেখুন, আমাদের বোনেরা বেরিয়ে এসেছে। আর বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা না করে পারবে না। হক সাহেব আমাকে বললেন, ‘তুমি ঠিকই বলেছ, মুজিব’।” (পৃষ্ঠা-৯৩, ৯৪)। বাংলার মানুষের প্রতি বঙ্গবন্ধুর অবিশ্বাস্য আত্মপ্রত্যয় ছিল! তখন কে জানতো যে, ১৯৪৮-এর এই ১১ মার্চের পথ ধরেই ১৯৫২, ১৯৬৯ এবং ১৯৭১-এর একুশে ফেব্রুয়ারির চেতনায় স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটবে! কিন্তু জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব জানতেন! কারণ তিনি দূরদর্শী নেতা ছিলেন, লক্ষ্য স্থির করে কর্মসূচি নির্ধারণ করতেন। যেদিন পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা হয়, সেদিনই তিনি বুঝতে পেরেছিলেন এই পাকিস্তান বাঙালিদের জন্য হয়নি; একদিন বাংলার ভাগ্যনিয়ন্তা বাঙালিদেরই হতে হবে। আর তাই ধাপে ধাপে সমগ্র জাতিকে প্রস্তুত করেছেন চূড়ান্ত সংগ্রামের জন্য। পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিনের ‘উর্দু এবং শুধুমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা’ এই বক্তব্যের প্রতিবাদে ১৯৫২ সালের ৩১ জানুয়ারি যৌথ উদ্যোগে ‘অল-ইউনিয়ন সেন্ট্রাল স্টেট ল্যাঙ্গুয়েজ স্ট্রাগল কাউন্সিল’ গঠিত হয়। সব রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক দল এবং কাজী গোলাম মাহবুবের আহ্বায়ক করে গঠিত সংগ্রাম পরিষদ ২১ ফেব্রুয়ারিকে ‘ভাষা দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করে এবং সারাদেশে ধর্মঘটের ডাক দেয়। অন্যদিকে তৎকালীন নুরুল আমিন সরকার ১৪৪ ধারা জারি করেও ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা মেডিকেল কলেজ প্রাঙ্গণে জড়ো হওয়া শিক্ষার্থীদের ওপর অন্যায় ও অগণতান্ত্রিকভাবে গুলি চালায়, যার ফলে রফিক উদ্দিন আহমেদ, আবুল বরকত, আবদুল জব্বার, আবদুস সালাম, শফিউর রহমানসহ আরো অনেকে শহীদ হন। বঙ্গবন্ধু তখন কারারুদ্ধ। কারাগারেই তিনি রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে একাত্মতা প্রকাশ করে অনশন করেন। ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ গ্রন্থে তিনি আরো লিখেছেন, ‘মাতৃভাষার অপমান কোন জাতি সহ্য করতে পারে না। পাকিস্তানের জনগণের শতকরা ৫৬ জন বাংলা ভাষাভাষী হয়েও শুধুমাত্র বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা বাঙালীরা করতে চায় নাই। তারা চেয়েছে বাংলার সাথে উর্দুকেও রাষ্ট্রভাষা করা হোক, তাতে আপত্তি নাই। কিন্তু বাঙালীর এই উদারতাটাই অনেকে দুর্বলতা হিসেবে গ্রহণ করে নিয়েছে।’ (পৃষ্ঠা-১৯৮)। ১৯৫২-এর একুশে ফেব্রুয়ারির আন্দোলন দেশের গ্রামে-গঞ্জে ছড়িয়ে পড়েছিল। গ্রামে গ্রামে মিছিল হতো। সেই মিছিলে স্কুলের ছাত্রদের ব্যাপক ও স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ছিল। তখনকার সেøাগান, ‘শহীদ স্মৃতি অমর হউক’, ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’, ‘আমার ভাষা তোমার ভাষা, বাংলা ভাষা বাংলা ভাষা’। ১৯৫২ সালে দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকায় মওলানা ভাসানীর একটি বিবৃতি প্রকাশিত হয়। ওই বিবৃতিতে তিনি বলেন, ‘বাংলা ভাষার পক্ষে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মতো পরিবর্তনে মুজিব সফল না হলে শুধু ভাষা আন্দোলন নয়, আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়ত।’ এ বক্তব্য ভাষা আন্দোলনে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অনবদ্য অবদানের প্রামাণ্য দলিল। বঙ্গবন্ধু প্রথম গ্রেপ্তার হয়েছিলেন রাষ্ট্রভাষা বাংলা দাবির আন্দোলনে অংশ নিয়ে। ১১ মার্চ ‘বাংলা ভাষা দাবি দিবস’ পালনের কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে পুলিশি নির্যাতনের পর গ্রেপ্তার হন তিনি। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি জেলে থাকার কারণে সক্রিয় আন্দোলনে অংশ নিতে না পারলেও আন্দোলন-সংগ্রাম হয়েছিল তারই নির্দেশনা ও পরামর্শে। এমনকি ১৯৪৭ সালে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে বাংলা ভাষার দাবির পক্ষে স্বাক্ষর সংগ্রহ অভিযানেও অংশ নেন তিনি। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টির পর পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী সচেতনভাবে বাঙালির কাছ থেকে ভাষার অধিকার হরণ করতে চেয়েছিল। তারা চেয়েছিল সংখ্যালঘু জনগণের ভাষা উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চাপিয়ে দিতে। কিন্তু তাদের সেই অপতৎপরতার বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছিলেন বাঙালির ত্রাণকর্তা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের জন্মের পরপর কলকাতায় পূর্ব পাকিস্তানের পরবর্তী কর্তব্য নির্ধারণে সমবেত হয়েছিলেন কিছুসংখ্যক রাজনৈতিক কর্মী। সেখানে পাকিস্তানে একটি অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক আন্দোলন ও সংগঠন করার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। সে প্রক্রিয়ার সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এ প্রসঙ্গে গাজীউল হক ‘ভাষা আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা’ গ্রন্থে উল্লেখ করেন, ‘সম্মেলনের কমিটিতে গৃহীত প্রস্তাবগুলো পাঠ করেছিলেন সেদিনের ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমান।’ প্রস্তাবগুলো ছিল, ‘বাংলা ভাষাকে পূর্ব পাকিস্তানের লেখার বাহন ও আইন আদালতের ভাষা করা হউক। সমগ্র পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কী হইবে তৎসম্পর্কে আলাপ-আলোচনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ভার জনসাধারণের ওপর ছাড়িয়া দেওয়া হউক এবং জনগণের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত বলিয়া গৃহীত হউক।’ এভাবেই ভাষার দাবি বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠে প্রথম উচ্চারিত হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ভারত থেকে তৎকালীন পূর্ববাংলায় প্রত্যাবর্তন করার পর সরাসরি ভাষা আন্দোলনে শরিক হন। ১৯৪৭ সালের ডিসেম্বর মাসে সমকালীন রাজনীতিবিদসহ ১৪ জন ভাষাবীর সর্বপ্রথম ভাষা আন্দোলনসহ অন্যান্য দাবিসংবলিত ২১ দফা দাবি নিয়ে একটি ইশতেহার প্রণয়ন করেছিলেন। ওই ইশতেহারে ২১ দফা দাবির মধ্যে দ্বিতীয় দাবিটি ছিল রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই। ঐতিহাসিক এই ইশতেহারটি একটি ছোট পুস্তিকা আকারে প্রকাশিত হয়েছিল, যার নাম ‘রাষ্ট্রভাষা-২১ দফা ইশতেহার-ঐতিহাসিক দলিল।’ ওই পুস্তিকাটি ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে একটি ঐতিহাসিক প্রামাণ্য দলিল হিসেবে স্বীকৃত। এই ইশতেহার প্রণয়নে শেখ মুজিবুর রহমানের অবদান ছিল অনস্বীকার্য এবং তিনি ছিলেন অন্যতম স্বাক্ষরদাতা। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের সময় জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কারাগারে বন্দি ছিলেন। একুশে ফেব্রুয়ারি ভাষা আন্দোলনের আগে বঙ্গবন্ধু জেলে থাকা অবস্থায় বুঝতে পেরেছিলেন তখনকার রাজনৈতিক পরিস্থিতি ক্রমেই অস্থিতিশীল হয়ে উঠছে। জেলে থেকেই তিনি আন্দোলনের নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন। পরামর্শ দিতেন। ১৯৫২ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি ফরিদপুর জেলে যাওয়ার আগে ও পরে ছাত্রলীগের একাধিক নেতার কাছে চিরকুট পাঠিয়েছেন। একুশে ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ সালে ফরিদপুর জেলে ছিলেন বঙ্গবন্ধু। দিনটি উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা নিয়ে কাটিয়েছিলেন বলে অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে উল্লেখ করেছেন। রাতে সিপাহিদের কাছ থেকে ঢাকায় ভীষণ গোলমালের খবর পান। জানতে পারেন কয়েকজন প্রাণ হারিয়েছেন। ফরিদপুরে ছাত্রছাত্রীরা ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই, বাঙালিদের শোষণ করা চলবে না, শেখ মুজিবের মুক্তি চাই, রাজবন্দিদের মুক্তি চাই’- এসব সেøাগান দিচ্ছিলেন। ঢাকার খবর পেয়ে বঙ্গবন্ধু চিন্তিত হয়ে পড়েন। ২২ তারিখের খবরের কাগজ পড়ে বিস্তারিত জানতে পারেন তিনি। এ বিষয়ে বঙ্গবন্ধুর বর্ণনা ছিল, ‘মাতৃভাষার আন্দোলনে পৃথিবীতে এই প্রথম বাঙালিরাই রক্ত দিল। দুনিয়ার কোথাও ভাষা আন্দোলনে গুলি করে হত্যা করা হয় নাই। ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করলেও গুলি না করে গ্রেপ্তার করলেই তো চলত। আমি ভাবলাম, দেখব কি না, জানি না, তবে রক্ত যখন আমাদের ছেলেরা দিয়েছে, তখন বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা না করে আর উপায় নাই। মানুষের যখন পতন আসে, তখন পদে পদে ভুল হতে থাকে।’ পরবর্তী সময়ে মুক্তি পেয়ে একুশের প্রথম বার্ষিকী পালনেও বঙ্গবন্ধুর অবদান অস্বীকার করার উপায় নেই। ভাষা আন্দোলনের সেই ধারাবাহিক জোয়ারের ফলেই পরবর্তী সময়ে স্বাধীন এক দেশের অভ্যুদয় ঘটাতে পেরেছিলেন। একটি সুন্দর, নিষ্কলুষ, নির্যাতন-নিপীড়নহীন শোষণমুক্ত সমাজব্যবস্থা কায়েমের লক্ষ্যে ১১ দফার ভিত্তিতে সমগ্র জাতিকে এক মোহনায় শামিল করতে সক্ষম হয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। সেদিনের একুশে ফেব্রুয়ারি বাংলার ঘরে ঘরে স্বাধিকার ও স্বাধীনতার এক নতুন বার্তা পৌঁছে দিয়েছিলেন। দিনটি ছিল শুক্রবার। একুশে ফেব্রুয়ারি শহীদদের স্মরণে প্রথম সরকারি ছুটি অর্জিত হয়েছিল। কালো পতাকা উত্তোলন, আজিমপুর কবরস্থানে শহীদদের সমাধিতে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ, প্রভাতফেরি এবং কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে পুষ্পাঞ্জলি অর্পণের মধ্য দিয়ে সেদিন কর্মসূচি শুরু হয়। শহীদ দিবস উপলক্ষে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে শহীদ মিনারের পাদদেশে শপথ অনুষ্ঠান পরিচালিত হয়। ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দ সমাবেশ থেকে সরকারের উদ্দেশে চরমপত্র ঘোষণা করে সমস্বরে বলেন, ‘আগামী ৩ মার্চের পূর্বে দেশবাসীর সার্বিক অধিকার কায়েম, আইয়ুব সরকারের পদত্যাগ, রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিব মামলা প্রত্যাহার, ১১ দফা দাবির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন, ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সবার প্রিয় নেতা শেখ মুজিবসহ সব রাজবন্দির নিঃশর্ত মুক্তি, সংবাদপত্র ও বাক-স্বাধীনতার ওপর হতে সর্বপ্রকার বিধি-নিষেধ প্রত্যাহার করা। শেখ মুজিবের জনপ্রিয়তাকে কেউ যেন নিজেদের রাজনৈতিক হাতিয়ার না করেন।’ স্বৈরশাসকের প্রতি চরমপত্র ঘোষণার পর সন্ধ্যায় দেশবাসীর উদ্দেশে এক বেতার ভাষণে আইয়ুব খান নতি স্বীকার করে ঘোষণা করেন। ২২ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবসহ সব রাজবন্দিকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয় এবং ২৩ তারিখ রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) বাঙালি জাতির পক্ষ থেকে ১০ লাখ মানুষের উপস্থিতিতে কৃতজ্ঞচিত্তে প্রিয় নেতাকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়। এরপর ১৯৫২ ও ১৯৬৯-এর রক্তস্রোত পথ বেয়ে আসে ১৯৭১-এর একুশে ফেব্রুয়ারি। ১৯৭০-এর ঐতিহাসিক নির্বাচনে বিজয়ী সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর প্রশ্নে জেনারেল ইয়াহিয়া খান তখন নানামুখী ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। সেসব ষড়যন্ত্রের বেড়াজাল ছিন্ন করে ১৯৭১-এর একুশে ফেব্রুয়ারির প্রথম প্রহরে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শহীদ মিনারের পবিত্র বেদিতে পুষ্পমাল্য অর্পণের পর বলেছিলেন, ‘শহীদের রক্ত বৃথা যেতে দিব না। চূড়ান্ত ত্যাগ স্বীকারের জন্য আমাদের প্রস্তুতি নিতে হবে। জননী জন্মভূমির বীর শহীদদের স্মরণে শপথ নিয়ে বলছি যে, রক্ত দিয়ে হলেও বাংলার স্বাধিকার আদায় করবো। যে ষড়যন্ত্রকারী দুশমনের দল ১৯৫২ সাল হতে শুরু করে বারবার বাংলার ছাত্র-যুবক-কৃষক-শ্রমিককে হত্যা করেছে। যারা ২৩ বছর ধরে বাঙালিদের শোষণ করেছে, বাংলার স্বাধিকার আন্দোলন বানচালের জন্য, বাঙালিদের চিরতরে গোলাম করে রাখার জন্য তারা আজো ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছে। শহীদের আত্মা আজ বাংলার ঘরে ঘরে ফরিয়াদ করে ফিরছে, বলছে, বাঙালি তুমি কাপুরুষ হইও না। স্বাধিকার আদায় করো। আমিও আজ এই শহীদ বেদি হতে বাংলার জনগণকে আহ্বান জানাচ্ছি, আমি যদি হুকুম দিবার নাও পারি, প্রস্তুত হও, দরকার হয় রক্ত দিবো। কিন্তু স্বাধিকারের দাবির প্রশ্নে কোনো আপস নাই।’ অমর একুশে পালনে শহীদ মিনারে ব্যক্ত করা জাতির জনকের এই অঙ্গীকার অক্ষরে অক্ষরে পালন করে প্রিয় মাতৃভূমিকে স্বাধীন করেছে এ দেশের মানুষ। একুশে ফেব্রুয়ারি যুগে যুগে আমাদের প্রেরণার উৎস হয়ে আছে। বিশেষ করে ১৯৫২, ১৯৬৯ এবং ১৯৭১-এর একুশে ফেব্রুয়ারি বাঙালির জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাসে অনন্য উচ্চতায় আসীন। একুশের চেতনার পতাকা হাতে নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ সুন্দরভাবে সামনের দিকে অগ্রসর হয়ে একের পর এক লক্ষ্যপূরণ করছে। একুশে ফেব্রুয়ারিকে এখন জাতিসংঘের শিক্ষা, সংস্কৃতি ও বিজ্ঞানবিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কো ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করেছে। এই স্বীকৃতিও আমাদের জন্য সম্মানের। আমরা যদি শিক্ষা, সংস্কৃতিতে অগ্রসর হতে না পারি এবং উন্নত মানবসম্পদ হতে না পারি তাহলে আমরা আমাদের ভাষা ও দেশকে মহিমান্বিত করতে পারব না। দেশকে এগিয়ে নিতে পারব না। এক্ষেত্রে সুযোগের সমতা নিশ্চিত করতে বৈষম্য দূরীকরণের পদক্ষেপ নিতে হবে এবং নতুন প্রজন্মকে সেভাবেই গড়ে তুলতে হবে। যা খুব জরুরি।