হীরেন পণ্ডিত: প্রতিটি দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে একজন বড় মাপের নেতা থাকেন। যেমন আমেরিকার জর্জ ওয়াশিংটন, রাশিয়ার লেনিন, চীনের মাও সেতুং, ভারতের মহাত্মা গান্ধী, ইন্দোনেশিয়ার সুকর্ণ, ভিয়েতনামের হো চি মিন এবং বাংলাদেশের বঙ্গবন্ধু। জাতির পিতা, রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা বা স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতা হিসেবে তাঁরা নিজ নিজ দেশে মর্যাদার আসনে চিরকাল অধিষ্ঠিত আছেন। যেমন আমাদের আছেন বাংলার হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সন্তান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বাংলাদেশ ও বঙ্গবন্ধু এক ও অভিন্ন, একে অপরের পরিপূরক। একটিকে বাদ দিয়ে আরেকটিকে কল্পনা করা যায় না। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের মূল নেতা বা নায়ক হচ্ছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বাঙালি জাতির শত বছরের ইতিহাসের গৌরবজনক ঘটনা হচ্ছে ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধ। ৩০ লাখ শহীদের তাজা রক্ত, দুই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমহানি এবং সীমাহীন আত্মত্যাগের বিনিময়ে একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর এই স্বাধীনতার বিজয় অর্জিত হয়।
২৩ বছরের আন্দোলন সংগ্রাম এবং একাত্তরের নয় মাস সশস্ত্র যুদ্ধে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীকে পরাজিত করেই বিজয় ছিনিয়ে এনেছে বীর বাঙালি। বাংলার অনেক সূর্য সন্তান হয়তো বাঙালি জাতির শৃঙ্খল মোচনের স্বপ্ন দেখেছেন। কিন্তু সেই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপান্তরিত করেছেন বাঙালির হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ সন্তান, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, ইতিহাসের মহানায়ক, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বাঙালি জাতি যতদিন বেঁচে থাকবে ততদিন শেখ মুজিবের নাম শ্রদ্ধাভরে উচ্চারিত হবে। ইতিহাস বারবার প্রমাণ করেছে ‘মুজিব বাংলার বাংলা মুজিবের’। অথবা এভাবে বলা যায় যে বাংলাদেশই বঙ্গবন্ধু ‘বঙ্গবন্ধুই বাংলাদেশ’। বাংলার বিখ্যাত কবি অন্নদা শংকর রায় যথার্থই বলেছেন, ‘যতদিন রবে পদ্মা মেঘনা গৌরি যমুনা বহমান, ততদিন রবে কীর্তি তোমার শেখ মুজিবুর রহমান।’
১৭ মার্চ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শুভ জন্মদিন। ১৯২০ সালের এইদিনে গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় সম্ভ্রান্ত শেখ পরিবারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জন্মগ্রহণ করেন। পিতা শেখ লুৎফর রহমান ও মাতা সায়েরা খাতুনের চার কন্যা এবং দুই পুত্রের মধ্যে তিনি ছিলেন তৃতীয়। তাঁর বাবা মায়ের দেয়া আদুরে নাম ছিল খোকা। কিশোর বয়সেই শেখ মুজিবের প্রতিবাদী চরিত্রের বহিঃপ্রকাশ দেখা গিয়েছিল। অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী মানসিকতা, গরিব-দুঃখী মানুষের প্রতি ভালোবাসা ও তাদের দুঃখ দূর করার প্রতিজ্ঞা তাঁকে রাজনীতিতে নিয়ে আসে। স্কুল থেকেই তিনি রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। গ্রামের স্কুলে তাঁর লেখাপড়ার হাতেখড়ি। ১৯২৭ সালে শেখ মুজিব গিমাডাঙ্গা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা শুরু করেন। ১৯২৯ সালে গোপালগঞ্জ পাবলিক স্কুলে ভর্তি হন এবং এখানেই ১৯৩৪ সাল পর্যন্ত পড়াশোনা করেন। ১৯৩৭ সালে গোপালগঞ্জ মিশন স্কুলে সপ্তম শ্রেণিতে ভর্তি হন। ১৯৪১ সালে অসুস্থ শরীর নিয়েই ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেন।
পড়াশোনার থেকে রাজনীতি বেশি করেছেন। রাজনীতিতে যুক্ত হওয়ার ক্ষেত্রে তাঁর পিতা তাঁকে বাধা দেননি। অসমাপ্ত আত্মজীবনী থেকে জানা যায়, তাঁর বাবা তাঁকে বলেছিলেন, বাবা রাজনীতি কর আপত্তি করব না, পাকিস্তানের জন্য সংগ্রাম করছ এতো সুখের কথা, তবে লেখাপড়া করতে ভুলিও না। লেখাপড়া না শিখলে মানুষ হতে পারবে না। ম্যাট্রিক পরীক্ষার পরপরই কিশোর মুজিব কলকাতায় যান। কলকাতার ইসলামিয়া কলেজের ছাত্র থাকা অবস্থায় তাঁর রাজনৈতিক জীবনের বড় পরিবর্তনগুলো শুরু হয়। তিনি পাকিস্তান আন্দোলনে সক্রিয় হন এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, আবুল হাশিমের মতো নেতাদের সান্নিধ্যে আসেন। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তা রাষ্ট্র সৃষ্টি হলে শেখ মুজিবও ঢাকায় চলে আসেন। নতুন রাজনৈতিক চিন্তাচেতনা নিয়ে ১৯৪৮ সালে ছাত্রলীগ গঠন করেন। ১৯৪৯ সালে নবগঠিত পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের যুগ্ম সম্পাদক নির্বাচিত হন। বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবী নিয়ে গড়ে ওঠা আন্দোলনে অংশ নেয়ার মাধ্যমেই শেখ মুজিবের রাজনৈতিক তৎপরতার সূচনা হয়। ১৯৪৮ থেকে ১৯৫২ এর মহান ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৮ এর সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন, ১৯৬২ এর শিক্ষা আন্দোলন ও ১৯৬৬ এর ঐতিহাসিক ছয় দফা ভিত্তিক আন্দোলনের মাধ্যমে তিনি হয়ে ওঠেন বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা।
১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ছাত্র জনতার পক্ষ থেকে তাঁকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি দেয়া হয়। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বাঙালিরা বঙ্গবন্ধুর ৬ দফার পক্ষে অকুণ্ঠ সমর্থন জানায়। কিন্তু পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে বাঙালিদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের রাজনীতি শুরু করে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণে স্বাধীনতার ডাক দেন।
স্বৈরশাসক আইয়ুব ছয় দফা দেওয়াকে অপরাধ হিসেবে আখ্যায়িত করে বঙ্গবন্ধুকে ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’ বলে অভিহিত করেন এবং জাতীয় প্রতিরক্ষা আইনে আওয়ামী লীগকে গ্রেপ্তার ও নির্যাতন করেন। আওয়ামী লীগের ডাকে ১৩ মে সারা এলাকায় প্রতিবাদ দিবস পালিত হয়। প্রতিবাদ দিবসের জনসভায় ছয় দফার প্রতি জনসমর্থন ব্যক্ত করা হয়। দলের নবনির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ গ্রেফতার হলে সাংগঠনিক সম্পাদক মিজান চৌধুরী ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব নেন। ৭ জুন ধর্মঘটের সময় বাংলাদেশের বিক্ষুব্ধ জনগণ স্বাধীনতা ও বঙ্গবন্ধুসহ সকল রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তির দাবি জানায়। ৭ জুন আমাদের স্বাধীনতা চেতনার সূচনা বিন্দু রচিত হয়েছিল এই দিনে।
বঙ্গবন্ধুর উত্থাপিত ছয় দফা দাবি ‘মুক্তির সনদ’ বা বাঙালির ‘বেঁচে থাকার দাবি’ নয়; বরং এটা বাংলাদেশের স্বাধীনতার ভিত্তি। ৭ জুনের প্রেক্ষাপটে অর্থাৎ ছয় দফা দিবসে বাঙালি জাতির বিসর্জন, সংগ্রাম ও প্রতিবাদের দিকটি সামনে আসে। ১৯৭১ সালের এই দিনে ছয় দফা দাবি আদায়ের আন্দোলনে বাঙালি জাতি জীবন দিয়েছে, রক্তে রঞ্জিত হয়েছে রাজপথ, প্রেপ্তার হয়েছে ছয় শতাধিক মানুষ, বিচার হয়েছে অগণিত মানুষের। ছয় দফা দাবি করার পর বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগ বা অন্য কোনো দলের নেতা থাকেননি; হয়ে ওঠেন আমাদের বাঙালিদের একমাত্র নেতা। পরবর্তীকালে বাঙালির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার এবং স্বাধীনতা আন্দোলন, স্বাধীনতা-উত্তর রাজনীতি ও রাজনীতি সবই এক ব্যক্তিকে ঘিরে আবর্তিত হয় এবং তিনি ছিলেন বঙ্গবন্ধু। তিনি আর ব্যক্তি ছিলেন না; একটি প্রতিষ্ঠান হয়ে ওঠে।
১৯৪৭ সাল থেকেই তিনি ছিলেন বাঙালি জাতির প্রধান আকর্ষণ। বাঙালি জাতির মুক্তির ইতিহাস তাকে ঘিরে আবর্তিত হয়েছে। তরুণ শেখ মুজিব ধীরে ধীরে হয়ে উঠলেন বাঙালি জাতির মুক্তিদাতা। নতুন রাজনৈতিক চিন্তাচেতনা নিয়ে ১৯৪৮ সালে ছাত্রলীগ গঠন করেন। ১৯৪৯ সালে নবগঠিত পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের যুগ্ম সম্পাদক নির্বাচিত হন। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি আন্দোলনে অংশ নেয়ার মাধ্যমেই রাজনৈতিক তৎপরতার সূচনা হয়। এরপর ১৯৫২ এর মহান ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪ এর যুক্তফ্রন্ট গঠন, ১৯৫৮ এর সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন, ১৯৬২ এর শিক্ষা আন্দোলন ও ১৯৬৬ এর ঐতিহাসিক ছয় দফা ভিত্তিক আন্দোলনের মাধ্যমে তিনি হয়ে ওঠেন বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা।
১৯৭০ সালের নির্বাচনে বাঙালিরা দফার পক্ষে অকুণ্ঠ সমর্থন জানায়। কিন্তু পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে ষড়যন্ত্রের রাজনীতি শুরু করে। তাঁর দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নেতৃত্বের কারণে একাত্তরের মার্চ মাসের শুরুতেই তিনি বুঝতে পেরেছিলেন পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ অনিবার্য। তাই তিনি একাত্তরের ৭ মার্চ বাংলাদেশের মানুষকে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার নির্দেশ দেন। তিনি বলেন ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। এ ভাষণে বাঙালির প্রতি পাকিস্তানিদের হত্যা-নিপীড়ন-নির্যাতনের চিত্র মূর্ত হয়ে উঠে। শত্রুর মোকাবিলায় তিনি বাঙালি জাতিকে নির্দেশ দেন, ‘তোমাদের যা কিছু আছে, তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো।’ এই সম্মোহনী ভাষণে অনুপ্রাণিত হয়ে বাঙালি জাতি সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে শুরু করে।
৭ মার্চের মাত্র ১৯ মিনিটের এই পৃথিবী কাঁপানো বজ্রকণ্ঠের ঐতিহাসিক জ্বালাময়ী ভাষণ ছিল বাঙালির হাজার বছরের আবেগ, স্বপ্নের বাণী, আকাক্সক্ষার প্রতিফলন, যা ছিল বাঙালিকে মুক্ত করার দৃঢ় প্রতিজ্ঞা। দীপ্তকণ্ঠে বঙ্গবন্ধু উচ্চারণ করেন, ‘রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেব, এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাআল্লাহ।’ এ ঐতিহাসিক ভাষণই মুক্তিপাগল বাঙালি জাতিকে হানাদার পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে মহান মুক্তিযুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়তে উদ্বুদ্ধ করে এবং এই ভাষণের মধ্য দিয়েই বাঙালির ভবিষ্যৎ ভাগ্য স্পষ্ট নির্ধারিত হয়ে যায়।
বঙ্গবন্ধু অত্যন্ত প্রতীকী স্টাইলে ভাষণটি দিয়েছিলেন। একদিকে মুক্তিকামী মানুষকে দীর্ঘ সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত হতে বলেছেন, অন্যদিকে পাকিস্তানি শাসকদের বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে দিয়েছেন। তিনি একজন বিজ্ঞ রাজনীতিবিদ ছিলেন না, তিনি ছিলেন বিশ্বমাপের কূটনীতিবিদ। ৭ মার্চের ভাষণে তিনি সবকিছুকে প্রকাশ করেন একজন কূটনীতিবিদের মতো। তিনি বলেন, বিগত ২৩ বছরের বঞ্চনার ইতিহাস। তিনি ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪-এর নির্বাচন, ১৯৫৮-এর সামরিক শাসন, ১৯৬৬-এর ছয় দফা, ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭০-এর নির্বাচনসহ তৎকালীন পাকিস্তানে বাঙালি বঞ্চনার কথা জানান, অন্যদিকে যুদ্ধকৌশলও বলে দেন এবং একটি সাজানো গোছানো অলিখিত ভাষণ দেন।
অনেকে বলেন, বঙ্গবন্ধু আমাদের মুক্তিযুদ্ধে অনুপস্থিত ছিলেন। কখনও তারা বিচার করেন না, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ছিল একটি নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি দ্বারা পরিচালিত স্বাধীন দেশের অভ্যন্তর থেকে বিদেশি হানাদার-শত্রুদের বিতাড়িত করার একটি যুদ্ধ। ২৬ মার্চ ১৯৭১ সালে স্বাধীন হওয়ার পর আমাদের ৯ মাস সময় লেগেছিল ওই শত্রুদের বিতাড়িত করতে। আমরা তা করতে সক্ষম হই ১৬ ডিসেম্বর তাই এ দিবস আমাদের বিজয় দিবস।
২৬ মার্চ বাংলাদেশের নেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন, ওই ঘোষণাই বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের ভিত্তি, এই ঘোষণাকে ভিত্তি ধরে ১০ এপ্রিল স্বাধীনতার পূর্ণাঙ্গ ঘোষণাপত্র বা সংবিধানের মাতৃকোষ ঘোষিত হয় এবং স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার গঠিত হয়। এই ঘোষণাপত্রের ওপর ভিত্তি করেই বাংলাদেশের পূর্ণাঙ্গ সংবিধান রচিত হয়। ১৯৭০ এর নির্বাচনের ভেতর দিয়ে আসা বাংলাদেশের ওপর গণহত্যা শুরু ও যুদ্ধ চাপিয়ে দেওয়ার পরেই বাংলাদেশের জনগণের নির্বাচিত নেতা হিসেবে ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। সেটাকেই স্বাধীনতা ঘোষণাপত্রের মাধ্যমে সব জনপ্রতিনিধি বাংলাদেশের জনগণের পক্ষ থেকে বৈধ ঘোষণা হিসেবে মেনে নেন। আর বঙ্গবন্ধু ঘোষিত স্বাধীন দেশের জন্য সরকার গঠন করেন। বঙ্গবন্ধুকে ওই সরকারের প্রধান অর্থাৎ রাষ্ট্রপতি ও সৈয়দ নজরুল ইসলামকে উপরাষ্ট্রপতি হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। বৈধ সরকার তখন দেশের ওপর ওই ঘোষণাপত্র অনুযায়ী সব আইন প্রণয়ন ও রাজস্ব-সংক্রান্ত সব অধিকার পায়। এই পথে দুটি মাত্র বাধা থাকে। প্রথম হলো দেশের অভ্যন্তরে বেশ কিছু স্থান তখন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর দখলে ছিলো এবং দ্বিতীয়ত বাংলাদেশের জন্য অন্য রাষ্ট্রের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দরকার।
এই আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতির জন্য দুটি বিষয় জরুরি ছিল। প্রথমত যারা এই রাষ্ট্র গঠন করেছে তাদের প্রমাণ করতে হবে তারা বিচ্ছিন্নতাবাদী নয় এবং দ্বিতীয়ত রাষ্ট্র নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে কি না? কোনো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের জন্য অন্য একটি গণতান্ত্রিক নতুন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দিতে গেলে প্রথমেই দেখতে হয় যারা নতুন রাষ্ট্র গঠন করেছে বলে দাবি করছেন, তারা বিচ্ছিন্নতাবাদী কি না? যদি তারা বিচ্ছিন্নতাবাদী প্রমাণিত না হয় তাহলে স্বীকৃতি পাওয়ার বেশির ভাগ শর্ত তারা পূরণ করেন।
বাংলাদেশের এই পাকিস্তানি হানাদার বিতাড়িত করার যুদ্ধে বঙ্গবন্ধু যদি পালিয়ে যেতেন বা আন্ডার গ্রাউন্ডে গিয়ে বিপ্লবীদের মতো যুদ্ধ পরিচালনা করার চেষ্টা করতেন, তাহলে পাকিস্তানের সামরিক শাসক তাঁকে বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসেবে প্রমাণ করার যথেষ্ট সুযোগ পেত। কিন্তু দেশ আক্রান্ত হওয়ার পরও বঙ্গবন্ধু নিজ বাসভবনে বসেই স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। তিনি দেশের জনগণকে আক্রমণকারীদের প্রতিহত করার আহ্বান জানান এবং বিশ্ববাসীর কাছে ওই নতুন রাষ্ট্রের জন্য স্বীকৃতি চান।
এই ঘোষণা ও স্বীকৃতি চাওয়ার কাজটি ছিল প্রকাশ্যে এবং নির্বাচিত নেতা হিসেবে। তাই পাকিস্তানি সেনাবাহিনী যখন বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করে তখন তারা একটি স্বাধীন দেশের নির্বাচিত সরকার প্রধানকে গ্রেপ্তার করে। তিনি বা তাঁর দল বিচ্ছিন্নতাবাদী নয়। অর্থাৎ বঙ্গবন্ধু প্রকাশ্যে এভাবে গ্রেপ্তার হওয়ার ভেতর দিয়ে, স্বাধীনতা ঘোষণার পরে এই দেশটির আর বাকি যে বিজয় অর্জন করার ছিল তার বেশির ভাগ তিনি একাই করেন। অর্থাৎ তিনি বিশ্ববাসীর কাছে প্রমাণ করেন, তিনি ও তাঁর দল বিচ্ছিন্নতাবাদী নয়, তাঁরা মূলত নিজস্ব ভূমি থেকে হানাদার মুক্তির জন্য যুদ্ধ করছেন।
১৯৭১-এর ৯ মাসে পাকিস্তানের জেলে থেকে তিনি যেমন বেশির ভাগ যুদ্ধে জিতিয়ে দেন বাঙালিকে, তেমনি জেলে বসেও তিনি আগরতলা মামলার মতো নিজেকে রূপান্তরিত করেন; তাঁর আকৃতি আরও বিশাল হয়। গণতান্ত্রিক বিশ্ব প্রশ্ন করে এই নির্বাচিত নেতাকে গ্রেপ্তার করার অধিকার পাকিস্তানি সামরিক কর্তৃপক্ষের রয়েছে কিনা? মার্কিন প্রেসিডেন্ট পাকিস্তানের পক্ষ নিলেও সিনেটে বার বার বাধাগ্রস্ত হন পাকিস্তানের পক্ষে অবস্থানের জন্য। সবাই বলেন একমাত্র বঙ্গবন্ধুই তাঁর দেশ সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকারী। পাকিস্তানি সামরিক কর্তৃপক্ষ নয়। তাই মুক্তিযুদ্ধে যেমন বজ্রকণ্ঠের মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধাদের রাইফেলে, মাইন, গ্রেনেডে সবখানে ছিলেন বঙ্গবন্ধু, তেমনি আন্তর্জাতিক বিশ্বে প্রায় এককভাবে লড়াই করেন গ্রেপ্তার হওয়া নেতা বঙ্গবন্ধু।
যে কোনো মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা সংগ্রাম যেমন দেশের মানুষের আত্মত্যাগের মাধ্যমে হয়, তেমনি তার সঙ্গে সহযোদ্ধা হিসেবে পাশে দাঁড়ায় সারা পৃথিবীর মুক্তিকামী মানুষ। সারা পৃথিবীর মুক্তিকামী মানুষকে সেদিন বাংলাদেশের পক্ষে দাঁড়ানোর নায্যতা দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। কূটনীতিতে সেদিন ইয়াহিয়াকে পরাজিত করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির মধ্য দিয়ে সরকার গঠন করে, সশস্ত্র পথে হানাদার তাড়ানোর যুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর কূটনীতির কাছে হেরে যায় পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ। বিজয়ী হন বঙ্গবন্ধু, রূপান্তরিত হন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান থেকে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এ।
অনেকেই ভুল করে বলেন, বঙ্গবন্ধু মুক্তিযুদ্ধে অনুপস্থিত ছিলেন। ইচ্ছে করলেই একজন নেতা একটি দেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করতে পারেন না। স্বাধীনতা ঘোষণা করার অধিকার থাকতে হয়। যিনি ঘোষণা করবেন, তাঁর প্রতি দেশের এবং আন্তর্জাতিক বিশ্বের সমর্থন থাকতে হবে। স্বাধীনতার ডাক দিলেই জনগণ এতে সমর্থন দেবে না। সত্তরের নির্বাচনে বিজয়ী দলের নেতা হিসেবে একমাত্র বঙ্গবন্ধুরই স্বাধীনতার ঘোষণা দেবার অধিকার ছিল।
বাংলার অনেক সূর্য সন্তান হয়তো বাঙালি জাতির শৃঙ্খল মোচনের স্বপ্ন দেখেছেন। কিন্তু সেই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপান্তরিত করেছেন ইতিহাসের মহানায়ক, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু। তাই বলা যায় বাংলাদেশ ও বঙ্গবন্ধু এক ও অভিন্ন, একে অপরের পরিপূরক। একটিকে বাদ দিয়ে অন্যটিকে কল্পনা করা যায় না।
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন। রেসকোর্সে লাখো জনতার মাঝ থেকে বঙ্গবন্ধু বাসায় পৌঁছেন সন্ধ্যা ৬টায়। দীর্ঘ পথযাত্রা, দীর্ঘ আনুষ্ঠানিকতা, জনসভা, আবেগ-উচ্ছ্বাস-কান্না বিনিময়ের পর ১১ জানুয়ারি থেকে বঙ্গবন্ধু সব ক্লান্তি-ভাবাবেগ উপেক্ষা করে এক মুহূর্ত বিলম্ব না করে দেশ পরিচালনা শুরু করেন। সেদিনই মন্ত্রিসভার সঙ্গে দু’দফা বৈঠক করেন এবং বৈঠকে সংবিধান প্রণয়নসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
তিনি বলেন, সংবিধানের ভিত্তি হবে বাঙালি জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা। বঙ্গবন্ধুর কিছু মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য ছিল, স্বনির্ভরতা অর্জন, দেশের অভ্যন্তরীণ সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার, বৈদেশিক সহায়তা গ্রহণ ও ব্যবহার, যা হতে হবে শর্তবিহীন এবং ক্রমে এ নির্ভরতার অংশ কমিয়ে আনতে হবে। বেসরকারি খাতকেও উন্নয়ন কর্মকা- ও শিল্পায়নে সম্পৃক্ত করা। স্থানীয় শাসনসংক্রান্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর উন্নয়ন, জাতীয় জীবনে নারীদের অংশগ্রহণ।
যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে পুনর্গঠন এবং সফলভাবে অর্থনৈতিক ও অন্যান্য খাতের বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করেন। সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে দেখলেন গুদামে খাদ্য নেই, মাঠে ফসল নেই, কেন্দ্রীয় ব্যাংকে রিজার্ভ শূন্য। বস্তুত কোনো ব্যাংকের কার্যকারিতা নেই। সড়ক ও রেলপথ বিচ্ছিন্ন, নৌ ও সমুদ্রবন্দরগুলো বিধ্বস্ত। স্কুল-কলেজগুলো ছিল পরিত্যক্ত সেনাছাউনি। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী পরাজয় নিশ্চিত জেনে সম্ভাব্য সবকিছু ধ্বংস করে দিয়েছিল।
বঙ্গবন্ধু গুরুত্ব দিয়েছেন জোটনিরপেক্ষ অবস্থান বজায় রেখে দ্রুততম সময়ের মধ্যে বিশ্বের বেশির ভাগ দেশের স্বীকৃতি আদায় এবং আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার সদস্যপদ লাভ করার। উদ্দেশ্য ছিল আন্তর্জাতিক পরিম-লে বাংলাদেশকে দাঁড় করানো। তাঁর শাসনামলে মাত্র সাড়ে তিন বছর সময়ে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশকে ১২১ টি দেশের স্বীকৃতি এবং জাতিসংঘসহ ৩৬টি আন্তর্জাতিক সংস্থার সদস্যপদ লাভ করিয়েছেন।
মুক্তিযুদ্ধে পরিবহন ব্যবস্থা প্রায় সম্পূর্ণভাবেই বিধ্বস্ত হয়ে পড়ে। এর ফলে মুক্তিযুদ্ধ-উত্তর অর্থনীতি খাদ্যশস্য, শিল্পে ব্যবহৃত কাঁচামাল, কৃষিজাত দ্রব্য এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র আমদানি ও বিতরণ প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। এই পরিস্থিতিতে পুনর্গঠন কাজকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা, নৌপরিবহন এবং অন্যান্য ক্ষতিপূরণের উদ্যোগ নেন এবং বেসামরিক বিমান চলাচলের ওপর গুরুত্ব দেন। বিদ্যুৎ ব্যবস্থাও ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত ছিলো। দ্রুত সময়ের মধ্যে ট্রান্সমিশন ও বিতরণ লাইন নির্মাণের মাধ্যমে বিদ্যুৎ ব্যবস্থা করা হয়।
খাদ্য উৎপাদনে সবচেয়ে বেশি ভর্তুকি দিয়ে চাষাবাদে যান্ত্রিক পদ্ধতি প্রবর্তন করেন। কৃষকের মাঝে সার, ওষুধপত্র ও উন্নতমানের বীজ প্রদান করেন। শিক্ষিত ও দক্ষ মানবসম্পদে পরিণত করার পরিকল্পনা করে জাতীয় শিক্ষা কমিশন গঠন করেন। স্কুল ও কলেজগুলোকে জাতীয়করণ করে উচ্চশিক্ষার জন্য মঞ্জুরি কমিশন গঠন করেন। এই পুনর্গঠনে অনেক বন্ধুরাষ্ট্র সাহায্য দিয়েছিলো, যেগুলো পরিশোধ করার প্রয়োজন ছিল না। ভারত, রাশিয়া, যুক্তরাজ্য, কানাডা, জাপান, জার্মানি, সুইডেন, ডেনমার্ক ও নেদারল্যান্ড অন্যতম। লক্ষ্য ছিল, যত দ্রুত সম্ভব খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন।
বিজয়ের অর্ধশত বছর পর বাংলাদেশ বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে। ডিজিটাল বাংলাদেশের বীজ রোপণ করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। তিনি বাংলাদেশকে ইন্টারন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন ইউনিয়ন এর সদস্যপদ গ্রহণ করান ১৯৭৩ সালে। ১৯৭৫ সালের ১৪ জুন তিনি বেতবুনিয়ায় ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্র উদ্বোধন করেন। এই রোপিত বীজ থেকে জন্ম নেয়া চারাগাছটির বিকাশ দেখি ১৯৯৬ সালে জননেত্রী শেখ হাসিনা যখন প্রথমবারের মতো প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করার পর।
১৯৭৪ সালের ১৮ জানুয়ারি এক ভাষণে দুর্নীতির বিরুদ্ধে তিনি যুদ্ধ ঘোষণা করেন। দুর্নীতির বিরুদ্ধে কার্যকরী প্রতিরোধ গড়ে তুলতে না পারলে জাতির ভবিষ্যৎ অন্ধকার। দুর্নীতিবাজ, ঘুষখোর, চোরাচালানি, মজুদদারি, কালোবাজারি ও মুনাফাখোরদের সমাজ ও রাষ্ট্রের শত্রু, এদের শায়েস্তা করে জাতীয় জীবনকে কলুষমুক্ত করতে না পারলে আওয়ামী লীগের দুই যুগের ত্যাগ-তিতিক্ষা এবং স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতৃত্বদানের গৌরবও ম্লান হয়ে যেতে পারে।
বঙ্গবন্ধু যুবকদের নিয়ে অনেক স্বপ্ন দেখতেন, ভাবতেন যুবসমাজকে আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। যুবসমাজ হয়ে উঠবে এক আদর্শবান শক্তি। এই আদর্শ এমন মানবিক গুণাবলি ধারণ করবে যা অন্যের জন্য অনুসরণযোগ্য। অর্থাৎ সামাজিকভাবে যা কিছু ভালো, শ্রেষ্ঠ, মহৎ, কল্যাণকর সবকিছুই থাকবে যুবসমাজের মধ্যে।
যুবসমাজকে সৎ, নিষ্ঠাবান, পরিশ্রমী, পরোপকারী, মানবদরদী, সহমর্মী, নির্লোভ-নিরহংকার, সাহসী হতে বলেন। যুবসমাজই শারীরিক ও মানসিকভাবে শক্তিশালী, জাগ্রত জ্ঞানের অধিকারী এবং রাষ্ট্র-সমাজের পরিবর্তন ও সংগ্রামের অগ্রনায়ক। মহান মুক্তিযুদ্ধে জীবন উৎসর্গকারীদের বিশাল একটি অংশ ছিল যুবক। বঙ্গবন্ধুর পাঠশালা ছিল বাংলা, বাঙালি ও বাংলাদেশ। বাঙালির হাজার বছরের আশা-আকাক্সক্ষা, বেদনা-বিক্ষোভ ও ঐতিহ্যকে তিনি নিজের চেতনায় আত্মস্থ করেছিলেন। যুবকরা ছিল তাঁর প্রাণ। যুবকদের ওপর ভর করেই তিনি এঁকেছিলেন সাফল্যের নকশা। নিজেদেরকে দক্ষ, কর্মমুখী, দায়িত্ব-কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন করে সোনার বাংলা গড়তে পারে, আজীবন এই কামনা করেছেন।
গণমুখী, বিজ্ঞানভিত্তিক ও কারিগরি শিক্ষাব্যবস্থার পাশাপাশি বিভিন্ন দায়িত্ব-কর্তব্য পালনের তাগিদ দিতেন। ১৯৭৩ সালের ১৯ আগস্ট এক সভায় যুবকদের উদ্দেশে বলেন, “বাবারা একটু লেখাপড়া শিখ। যতই জিন্দাবাদ আর মুর্দাবাদ করো, ঠিকমতো লেখাপড়া না শিখলে কোনো লাভ নেই। আর লেখাপড়া শিখে যে সময়টুকু পাবে বাবা মাকে সাহায্য করেবে। প্যান্ট পরা শিখছ বলে বাবার সাথে হাল ধরতে লজ্জা করো না। দুনিয়ার দিকে চেয়ে দেখ। গ্রামে বাড়ির পাশে বেগুনগাছ, মরিচগাছ, লাউগাছ ও কয়টা নারিকেলের চারা লাগাও। বাপ-মাকে একটু সাহায্য করো। শুধু বিএ-এমএ পাস করে লাভ নেই। দেশের মানুষের কল্যাণে কাজ করতে হবে”।
যুবসমাজকে দেশপ্রেমের আদর্শে উদ্দীপ্ত করতে তিনি উপদেশ-নির্দেশ দিতেন। ১৯৭৩ সালে ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে বলেন, ‘বাংলার মানুষ, বিশেষ করে তরুণ সম্প্রদায়কে আমাদের ইতিহাস জানতে হবে। বাংলার যে ছেলে তার অতীত বংশধরদের ঐতিহ্য সম্পর্কে জানতে পারে না, সে ছেলে সত্যিকারের বাঙালি হতে পারে না।’ তিনি এ বিষয়ে বিভিন্ন পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন। কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার গুরুত্ব বর্তমানেও অধিক। চতুর্থ শিল্প বিপ্লব উপযোগী দক্ষ যুবশক্তি গড়ে তোলার ক্ষেত্রেও বঙ্গবন্ধুর যুবভাবনা ও চিন্তা-চেতনা প্রাসঙ্গিক। এখন বর্তমান চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের জন্য প্রয়োজন প্রযুক্তি, রোবটিকস, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও আইওটি জানা নতুন প্রজন্ম ও দক্ষ যুবসমাজ গড়ে তোলা। তবে এ ক্ষেত্রে কৃত্রিম চেতনা ও কৃত্রিম মনোভাবের প্রজন্ম যেন গড়ে না ওঠে, সে ব্যাপারে অধিক সচেতনতা প্রয়োজন। বঙ্গবন্ধুর ভাবনার খাঁটি, দক্ষ, সৎ ও বাঙালি চেতনায় উদ্বুদ্ধ দেশপ্রেমী যুবসমাজই হলো আমাদের সম্পদ, সোনার বাংলা গড়ার দক্ষ কারিগর।
তরুণ শেখ মুজিবুর রহমান যেভাবে ধীরে ধীরে বাঙালি জাতির মুক্তিদাতা ও স্থপতি হয়ে উঠেছেন তাতে যোগাযোগ কৌশল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। আওয়ামী লীগের নেতা হিসেবে দেশের সংবাদপত্র ও সাংবাদিকদের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। ১৯৪২ সালে উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষা শেষ করার পর, যখন তরুণ শেখ মুজিব কলকাতার ইসলামিয়া কলেজে পড়তে যান, তখন তিনি সরাসরি ছাত্র রাজনীতির সাথে যুক্ত হন। কিন্তু তাঁর লক্ষ্য ছিল ভবিষ্যতে জাতীয় পরিসরে রাজনীতি করা। সুতরাং, তিনি অবিভক্ত বাংলার কিংবদন্তী নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর আদর্শে নিজেকে গড়ে তোলেন। তরুণ নেতা হিসেবে শেখ মুজিব জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। এই সময় থেকে সংবাদপত্র অফিসে তার যাতায়াত শুরু হয়। কলকাতায় দৈনিক আজাদের কার্যালয়ে, সাংবাদিক বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতেন সময় পেলেই। বঙ্গবন্ধু তখন থেকেই মিডিয়ার বন্ধু ছিলেন। সাংবাদিক এবং সংবাদপত্র অফিসের অবস্থান ছিল তার হৃদয়ে। তিনি বিশ্বাস করতেন, বাংলাদেশের সকল আন্দোলন-সংগ্রামে এবং মহান মুক্তিযুদ্ধে গণমাধ্যমের ভূমিকা অবিস্মরণীয় ছিল। মহান নেতা স্বাধীনতার সময় সংবাদপত্র এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়াকে আখ্যা দিয়েছিলেন সংগ্রামের প্রতিভু হিসেবে। ভাষা আন্দোলনে গণমাধ্যমের অবদান, ছয় দফা দাবি বাংলাদেশের জনগণের বেঁচে থাকার দাবি হিসেবে উপস্থাপনে গণমাধ্যমের অসামান্য অবদান।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছাত্রজীবন থেকেই মিডিয়াতে অনেক বন্ধু ছিলেন। সাংবাদিক এবং সংবাদপত্র অফিসের অবস্থান ছিল তার হৃদয়ের কাছাকাছি। সাংবাদিকদের মধ্যেও তার অনেক বন্ধু ছিল। তার অমর সৃষ্টি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে মিডিয়ার প্রতি তার গভীর আগ্রহ ও বিশ্বাস। কারণ বাংলাদেশের সকল আন্দোলন-সংগ্রামে এবং মহান মুক্তিযুদ্ধে গণমাধ্যমের ভূমিকা ছিল অসীম। এই মহান নেতা মুক্তিযুদ্ধের সময় সংবাদপত্র এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়াকে ‘গণমাধ্যম বলে আখ্যায়িত করেছেন, শুধু সংবাদ মাধ্যম নয়। বঙ্গবন্ধু সারাজীবন মত প্রকাশের স্বাধীনতার কথা বলেছেন। গণমাধ্যমের গুরুত্ব সম্পর্কে কথা বলার সময় বঙ্গবন্ধু তার স্মৃতিতে উল্লেখ করেন যে, “আমার বাবা বাড়িতে সংবাদপত্র রাখতেন; আনন্দবাজার, বসুমতী, আজাদ, মাসিক মোহাম্মদী এবং সৌগত। তারপর তিনি পূর্ব বাংলার গণমাধ্যমের রাজনীতি এবং ইতিহাস সম্পর্কে কথা বলেন। তৎকালীন জনগণের কল্যাণে এই ধারার নেতৃবৃন্দ কর্তৃক গৃহীত পদক্ষেপ।
তরুণ মুজিব কোলকাতায় তার জীবনে মুসলিম লীগের রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন, তাই তাঁকে প্রায়ই মুসলিম লীগের প্রেস রিলিজ দিতে পত্রিকার অফিসে যেতে হতো। এক পর্যায়ে তিনি বুঝতে পারেন যে, মাওলানা আকরাম খান সম্পাদিত দৈনিক আজাদ মুসলিম লীগের প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীকে সমর্থন করে। সুতরাং, ১৯৪৮ সালের জানুয়ারিতে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর আর্থিক সহায়তায় তারা দৈনিক ইত্তেহাদ প্রকাশ করেন। এই পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন আবুল মনসুর আহমেদ। ম্যাগাজিনটি ওই সময় সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল আধুনিক ম্যাগাজিন হিসেবে সম্পূর্ণ নতুন রূপে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব নিজেই অক্লান্ত পরিশ্রম করে পত্রিকাটি বাজারজাত করেন। তিনি পত্রিকার ব্যবস্থাপনায় একজন দায়িত্বশীল পরামর্শকও ছিলেন।
১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির পরেও, কাগজটি কলকাতায় প্রকাশিত হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সংবাদপত্রের ঢাকা অফিসে কাজ করেন এবং পূর্ববঙ্গে এজেন্ট নিয়োগ করে এর ব্যাপক প্রচারের ব্যবস্থা করেন। কিন্তু খাজা নাজিমুদ্দিনের সরকার কোলকাতা থেকে প্রকাশিত হওয়ার পূর্ব বাংলায় এই পত্রিকার প্রকাশনা নিষিদ্ধ করে। ১৯৪৯ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠিত হলে সাপ্তাহিক ইত্তেফাক পাত্রিকার মুখপাত্র হিসেবে প্রকাশিত হয়। মওলানা ভাসানী সম্পাদক ছিলেন, ইয়ার মোহাম্মদ খান প্রকাশক ছিলেন, তোফাজ্জল হোসেন (মানিক মিয়া) পত্রিকা পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী পত্রিকার অর্থায়ন করতেন। দলীয় কর্মীদের সঙ্গে শেখ মুজিবও সমধুর সম্পর্ক থাকায় এই পত্রিকার বিক্রির ব্যবস্থা করেছিলেন।
১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনের আগে ইত্তেফাক সাপ্তাহিক থেকে দৈনিক পত্রিকায় রূপান্তর হয়ে যায় এবং তোফাজ্জল হোসেন (মানিক মিয়া) সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৫৫ সালে, পূর্ব বাংলায় ধারা ৯২ (ক) চালু করা হয়েছিল, রাজনৈতিক নেতাদের গ্রেফতার করা এবং তাদের কার্যালয় বন্ধ করা। দৈনিক ইত্তেফাকও তখন বন্ধ ছিল। কারাবন্দী শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে তোফাজ্জল হোসেন বলেছিলেন যে তিনি আর কোনো কাগজপত্র বের করবেন না। চাকরি নিয়ে করাচি যাচ্ছেন। সেদিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব তাকে অনুরোধ করেছিলেন- তুমি যাবে না। তুমি চলে গেলে কেউ ইত্তেফাক চালাতে পারবে না। তোফাজ্জল হোসেন পরের দিন তাকে বার্তা পাঠান যে তিনি করাচিতে যাচ্ছেন না।
বঙ্গবন্ধুর সকল আন্দোলন-সংগ্রামে এবং মহান মুক্তিযুদ্ধে গণমাধ্যমের ভূমিকা ছিল অসীম। ভাষা আন্দোলন, ছয় দফা, দেশের জনগণের বেঁচে থাকার দাবি হিসেবে উপস্থাপনে গণমাধ্যমের অসামান্য অবদান। মুক্তিযুদ্ধের সময় সংবাদপত্র এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়াকে ‘গণমাধ্যম বলে আখ্যায়িত করেন, শুধু সংবাদ মাধ্যম নয়। বঙ্গবন্ধু সারাজীবন মত প্রকাশের স্বাধীনতার কথা বলেছেন। গণমাধ্যমের গুরুত্ব সম্পর্কে কথা বলার সময় বঙ্গবন্ধু তার স্মৃতি উল্লেখ করেন যে, “আমার বাবা বাড়িতে সংবাদপত্র রাখতেন; আনন্দবাজার, বসুমতী, আজাদ, মাসিক মোহাম্মদী এবং সওগাত”।
বঙ্গবন্ধু ১৯৪৮ সালের জানুয়ারিতে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর আর্থিক সহায়তায় তারা দৈনিক ইত্তেহাদ প্রকাশ করেন। এই পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন আবুল মনসুর আহমেদ। ম্যাগাজিনটি ওই সময় সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল আধুনিক ম্যাগাজিন হিসেবে সম্পূর্ণ নতুন রূপে। বঙ্গবন্ধু নিজেই অক্লান্ত পরিশ্রম করে পত্রিকাটি বাজারজাত করেন। তিনি পত্রিকার ব্যবস্থাপনায় একজন দায়িত্বশীল পরামর্শকও ছিলেন।
১৯৪৯ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠিত হলে সাপ্তাহিক ইত্তেফাক পাত্রিকার মুখপত্র হিসেবে প্রকাশিত হয়। মওলানা ভাসানী সম্পাদক ছিলেন, ইয়ার মোহাম্মদ খান প্রকাশক ছিলেন, তফাজ্জল হোসেন (মানিক মিয়া) পত্রিকা পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী পত্রিকার অর্থায়ন করতেন। দলীয় কর্মীদের মাঝেও বঙ্গবন্ধু এই পত্রিকার বিক্রির ব্যবস্থা করেন।
সংবাদপত্রগুলি সংবাদ, কলাম এবং সম্পাদকীয়তে, শোষণ, নির্যাতন এবং বৈষম্যের সঠিক চিত্র তুলে ধরেছিল। পরবর্তীতে ১৯৭০ সালের নির্বাচন এবং একাত্তরের অসহযোগ আন্দোলনের সময় দৈনিকগুলোও দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করে। তারা বঙ্গবন্ধুর সকল সিদ্ধান্ত, নির্দেশনা, বিবৃতি এবং বক্তৃতা প্রথম পৃষ্ঠায় ছাপিয়েছে। সংবাদপত্র জনগণকে অনুপ্রাণিত করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে, তারা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নেতৃত্বকে পূর্ণ সমর্থন দিয়েছে। অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে গণমাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব গ্রহণযোগ্য ছিল। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক স্বদেশ প্রত্যাবর্তনকে সংবাদপত্রগুলি ‘সেই মহান মানুষ আসে’ বলে বর্ণনা করে। বঙ্গবন্ধু প্রথম সাংবাদিকদের বাক স্বাধীনতা রক্ষা করেন। গণমাধ্যমকে শক্তিশালী করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন এবং সাংবাদিকদের বেতন ভাতা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা এবং গণমাধ্যমের জাতীয় স্বীকৃতির ব্যবস্থা করেন।
তোফাজ্জল হোসেনের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সঙ্গে গভীর হৃদয়ের সম্পর্ক ছিল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের অনুরোধে সোহরাওয়ার্দী প্রথমে তাকে দৈনিক ইত্তেফাকের সাথে যুক্ত করেন এবং তাকে পত্রিকাটির প্রশাসন ও নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব দেন। ১৯৬৬ সালে যখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব তার ঐতিহাসিক ছয় দফা দাবি উত্থাপন করেন, তখন দৈনিক ইত্তেফাক তার পক্ষে জনমত গড়ে তুলে পাকিস্তানি জেনারেলের ক্ষমতা ভেঙে দেয়। ১৯৬৯ সালে আইয়ুব বিরোধী আন্দোলনের সময় এ দেশের সংবাদপত্রগুলো সাহসী ভূমিকা পালন করেছিল। বিশেষ করে শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়য়ন্ত্র মামলার আদালত রিপোর্টিং, যা দেশদ্রোহিতার অভিযোগে শুরু হয়েছিল, দৈনিক পত্রিকায় তা ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছিল। একদিকে ছাত্র গণআন্দোলন, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহারের দাবি, অন্যদিকে রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তির দাবিতে পূর্ব পাকিস্তানে প্রতিদিন মিছিল-সমাবেশ শুরু হয়। জেনারেল আইয়ুুব সকল দাবি মেনে নিতে বাধ্য হন। সেই সময়, সংবাদপত্রগুলি, তাদের সংবাদ, কলাম এবং সম্পাদকীয়তে, পাকিস্তানের শাসক শ্রেণীর শোষণ, নির্যাতন এবং বৈষম্যের সঠিক চিত্র তুলে ধরেছিল। পরবর্তীতে ১৯৭০ সালের নির্বাচন এবং একাত্তরের অসহযোগ আন্দোলনের সময় দৈনিকগুলোও দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করে। তারা শেখ মুজিবের সকল সিদ্ধান্ত, নির্দেশনা, বিবৃতি, এবং বক্তৃতা প্রথম পৃষ্ঠায় ছবিসহ প্রথম পৃষ্ঠায় ছাপিয়েছে। বলা হয়ে থাকে যে, সংবাদপত্র জনগণকে অনুপ্রাণিত ও জনমনে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে, তারা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নেতৃত্বকে পূর্ণ সমর্থন দিয়েছে।
১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ শেখ মুজিবের রেসকোর্সে ময়দানের ঐতিহাসিক ভাষণের পর থেকে বাঙালি জাতির প্রতিষ্ঠা এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা নিয়ে কেউ কোনো প্রশ্ন উত্থাপন করেনি। সমগ্র জাতি এক হয়ে গেল। শেখ মুজিব দৈনিক পত্রিকায় অবিসংবাদিত নেতা ছিলেন, তার নেতৃত্ব গ্রহণযোগ্য ছিল।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাত থেকে ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর, পর্যন্ত পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর নির্দেশে সংবাদপত্রগুলি প্রকাশ করতে বাধ্য হয়। ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি সেনাদের আত্মসমর্পণের খবর এবং মুক্তিযোদ্ধাদের বিজয়ের খবর পাওয়ার জন্য তারা আবার আগের মতো সাহসী ভূমিকা পালন করে। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক স্বদেশ প্রত্যাবর্তনকে সংবাদপত্রগুলি ‘সেই মহান মানুষ আসে’ বলে বর্ণনা করে।
স্বাধীনতার পর শেখ মুজিবুর রহমান প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতি হিসেবে মাত্র সাড়ে তিন বছর দেশ শাসন করেন। সেই স্বল্প সময়ে তিনি ৩০ লাখ শহীদের রক্ত এবং দুই লাখ নারীর অসম্মানের বিনিময়ে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের ভিত্তি স্থাপন করেন।
বঙ্গবন্ধুর শেখ মুজিবুর রহমানই প্রথম সাংবাদিকদের বাক স্বাধীনতা রক্ষা করেন। গণমাধ্যমকে শক্তিশালী করতে বঙ্গবন্ধু গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। এবং স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের ইতিহাসে তিনিই প্রথম ব্যক্তি যিনি মিডিয়ার জন্য কাজ করেছিলেন। এবং তিনি সাংবাদিকদেরও বেতন ভাতা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা এবং গণমাধ্যমের জাতীয় স্বীকৃতির ব্যবস্থাও করেছিলেন। এক কথায়, বাংলাদেশ এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, রাজনীতির কবি হলেন সেই চূড়ান্ত মুক্তি যাঁর চেতনা অসীমভাবে প্রত্যাশার উর্ধ্বে নিয়ে গেছে।
‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ থেকে আমরা জানতে পারি, মুসলিম পরিবারের সন্তান হিসেবে ইসলাম ছিল বঙ্গবন্ধুর প্রিয় ধর্ম। কিন্তু অন্য সব ধর্মের প্রতিও তাঁর শ্রদ্ধা ছিল। সত্যিকারের বাঙালি ও মুসলমান হওয়ার পথে তিনি কখনো কোনো বিতর্কের সম্মুখীন হননি। সংবিধানে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের পবিত্রতা রক্ষার গ্যারান্টি থাকবে। সর্বস্তরে ধর্মীয় শিক্ষার প্রসারের জন্য পর্যাপ্ত ব্যবস্থা করা হবে। সংখ্যালঘুরা আইনের চোখে পূর্ণ সমান অধিকার ভোগ করবে। সংখ্যালঘুদের তাদের ধর্মের চর্চা ও প্রচার, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা, পরিচালনা এবং নিজ নিজ ধর্মের অনুসারীদের ধর্মীয় শিক্ষার অধিকার সাংবিধানিকভাবে সংরক্ষিত হবে। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কোনো ব্যক্তিকে তাঁর নিজের ধর্ম ছাড়া অন্য কোনো ধর্ম প্রচারের জন্য দায়িত্ব দিতে বাধ্য করা হবে না। কোনো ব্যক্তিকে কোনো ধর্মীয় নির্দেশ গ্রহণ করতে বা কোনো ধর্মীয় উপাসনা বা অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতে বাধ্য করা হবে না যদি না সে তার ধর্মের সঙ্গে যুক্ত থাকে। ধর্মীয় সহনশীলতার এই ধারণা বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগের অন্যতম মৌলিক স্তম্ভ।
১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে লন্ডন হয়ে ৯ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু দেশের উদ্দেশে রওনা হলেন। ১০ জানুয়ারি সকালে বঙ্গবন্ধু দিল্লিতে সংক্ষিপ্ত যাত্রাবিরতি করে যাত্রা করেন ঢাকার উদ্দেশে। বিমানটি তেজগাঁও বিমানবন্দর স্পর্শ করে বিকেল ৩টায়। সেখান থেকে ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে লাখ লাখ বাঙালির ভালোবাসা আর স্নেহের পরশ ভেদ করে পৌঁছাতে বঙ্গবন্ধুর সময় লেগেছিল আড়াই ঘণ্টা। রেসকোর্সে লাখো জনতার মাঝ থেকে বঙ্গবন্ধু বাসায় পৌঁছেন সন্ধ্যা ৬টায়। এত দীর্ঘ পথযাত্রা, দীর্ঘ আনুষ্ঠানিকতা, জনসভা, আবেগ-উচ্চ¦াস-কান্না বিনিময়ের পর ১১ জানুয়ারি থেকে বঙ্গবন্ধু সব ক্লান্তি-ভাবাবেগ উপেক্ষা করে এক মুহূর্ত বিলম্ব না করে দেশ পরিচালনা শুরু করেন। সেদিনই মন্ত্রিসভার সঙ্গে দু’দফা বৈঠক করেন এবং বৈঠকে সংবিধান প্রণয়নসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
সংবিধানের শুরুতেই তিনি বলেন বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থার ভিত্তি হবে বাঙালি জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা। ১৯৭০ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে উল্লেখ করা ছিল দেশের অর্থনীতিতে সমাজতান্ত্রিক উন্নয়ন ও পরিবর্তন আনতে হবে। অর্থনীতিবিদরা এটিকে ব্যাখ্যা করেছিলেন দারিদ্র্য বিমোচন ও বৈষম্য দূরীকরণ এবং পরিকল্পিত উন্নয়ন ব্যবস্থার মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিকে উন্নয়নের পথে নিয়ে যাওয়া। এ ভিত্তিতেই তদানীন্তন অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীনের ১৯৭২-৭৩ সালের বাজেট প্রণীত হয়েছিল, যেটিতে সংবিধানের মূলনীতিগুলোর প্রতিফলন ছিল। বঙ্গবন্ধুর অর্থনৈতিক দর্শনের কিছু মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য ছিল, স্বনির্ভরতা অর্জন, দেশের অভ্যন্তরীণ সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার, বৈদেশিক সহায়তা গ্রহণ ও ব্যবহার, যা হতে হবে শর্তবিহীন এবং ক্রমে এ নির্ভরতার অংশ কমিয়ে আনতে হবে। বেসরকারি খাতকেও উন্নয়ন কর্মকা- ও শিল্পায়নে সম্পৃক্ত করা। ১৯৭২ সালে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগের উচ্চসীমা নির্ধারণ করা হয়েছিল ২৫ লাখ টাকা, যা ১৯৭৪ সালে ৩ কোটিতে বর্ধিত করা হয়।
সংবিধানে বঙ্গবন্ধুর দেশের সার্বিক উন্নয়নের যে চিন্তা ও নির্দেশনা ছিল, সেগুলো বর্ণিত হয়েছে সংবিধানের দ্বিতীয় ভাগের অনুচ্ছেদগুলোতে। স্থানীয় শাসনসংক্রান্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর উন্নয়ন, জাতীয় জীবনে নারীদের অংশগ্রহণ। ১২ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু অস্থায়ী সংবিধান অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং নতুন মন্ত্রিপরিষদ গঠন করেন। বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণের পর থেকে বস্তুত তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে সরকারি-বেসরকারি সব সংস্থাসহ সারা দেশ বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে চলতে থাকে এবং সেনাবাহিনীর বাঙালি অংশ বঙ্গবন্ধুর নির্দেশের অপেক্ষায় থাকে।
যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ পুনর্গঠন শুরু করেন এবং সফলভাবে অর্থনৈতিক ও অন্যান্য খাতের বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করেন। বঙ্গবন্ধু সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে দেখলেন গুদামে খাদ্য নেই, মাঠে ফসল নেই, কেন্দ্রীয় ব্যাংকে রিজার্ভ শূন্য। বস্তুত কোনো ব্যাংকের কার্যকারিতা নেই। সড়ক ও রেলপথ বিচ্ছিন্ন, নৌ ও সমুদ্রবন্দরগুলো বিধ্বস্ত। স্কুল-কলেজগুলো ছিল পরিত্যক্ত সেনাছাউনি। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী পরাজয় নিশ্চিত জেনে সম্ভাব্য সবকিছু ধ্বংস করে দিয়েছিল।
বঙ্গবন্ধু প্রথমেই তিনি গুরুত্ব দিয়েছেন জোটনিরপেক্ষ অবস্থান বজায় রেখে দ্রুততম সময়ের মধ্যে বিশ্বের বেশির ভাগ দেশের স্বীকৃতি আদায় এবং আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার সদস্যপদ লাভ করানোর বিষয়ে। বঙ্গবন্ধুর উদ্দেশ্য ছিল আন্তর্জাতিক পরিম-লে আগে বাংলাদেশকে দাঁড় করানো। তাঁর শাসনামলে মাত্র সাড়ে তিন বছর সময়ে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশকে ১২১ টি দেশের স্বীকৃতি এবং জাতিসংঘসহ ৩৬টি আন্তর্জাতিক সংস্থার সদস্যপদ লাভ করিয়ে দিয়ে গেছেন।
মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসে পরিবহন ব্যবস্থা প্রায় সম্পূর্ণভাবেই বিধ্বস্ত হয়ে পড়ে। এর ফলে মুক্তিযুদ্ধ-উত্তর অর্থনীতি খাদ্যশস্য, শিল্পে ব্যবহৃত কাঁচামাল, কৃষিজাত দ্রব্য এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র আমদানি ও বিতরণ প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। এমন এক পরিস্থিতিতে বঙ্গবন্ধু পুনর্গঠন কাজে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে বন্দরের সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা, নৌপরিবহন উন্নয়ন এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে ক্ষতিপূরণের উদ্যোগ নেন এবং বেসামরিক বিমান চলাচল শুরুর ওপর গুরুত্ব দেন। মুক্তিযুদ্ধে বিদ্যুৎ ব্যবস্থাও ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। দ্রুত সময়ের মধ্যে বঙ্গবন্ধু ট্রান্সমিশন ও বিতরণ লাইন নির্মাণের মাধ্যমে বিদ্যুৎ ব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠার কাজে জোর দেন।
খাদ্য উৎপাদনে সবচেয়ে বেশি ভর্তুকি দিয়েছিলেন। চাষাবাদের ক্ষেত্রে নতুন যান্ত্রিক পদ্ধতি প্রবর্তনের লক্ষ্য স্থির করেন। কৃষি উৎপাদন বাড়াতে কৃষকের মাঝে সার, ওষুধপত্র ও উন্নতমানের বীজ প্রদান করেন। ১৯৭৩ সালে প্রতিষ্ঠা করেন বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল।
বঙ্গবন্ধু পরিবার পরিকল্পনার ওপর জোর দিয়েছিলেন। দেশের ১২ থানায় জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির পাইলটিং শুরু করেছিলেন তিনি। আমরা এখন সাত শতাংশের উপরে প্রবৃদ্ধি নিয়ে কথা বলি। অথচ বঙ্গবন্ধুর সময়ই বাংলাদেশে প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৭ দশমিক ৮ শতাংশ।
জনসংখ্যাকে শিক্ষিত ও দক্ষ মানবসম্পদে পরিণত করার পরিকল্পনাও নিয়েছেন। সেজন্য তিনি জাতীয় শিক্ষা কমিশন গঠন করেন। স্কুল ও কলেজগুলোকে জাতীয়করণ করেন। উচ্চশিক্ষার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন গঠন করেন এবং ১৯৭০ সালেই তিনি বলেছিলেন, আমাদের শিক্ষা-স্বাস্থ্যে গুরুত্ব দিতে হবে। আমাদের মেডিক্যাল কলেজ এবং মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তুলতে হবে। কারিগরি শিক্ষার দিকে জোর দিতে হবে।
বিজ্ঞানবিষয়ক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতেও তিনি গভীর গুরুত্ব দিয়েছেন। আণবিক শক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহারের মাধ্যমে জনস্বাস্থ্য, খাদ্য, কৃষি, শিক্ষা, শিল্পসহ জাতীয় অর্থনীতির বিভিন্ন খাতকে সহায়তা করার কথা ভেবে বঙ্গবন্ধু ১৯৭৩ সালে প্রতিষ্ঠা করেন বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন। এ প্রতিষ্ঠান বর্তমানে দেশের বৃহত্তম বিজ্ঞান গবেষণা প্রতিষ্ঠান। একই সময়ে বাংলাদেশ কাউন্সিল অব সায়েন্টিফিক অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিসার্চ (বিসিএসআইআর) গঠন করেন। মুক্তিযুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের জন্য গৃহনির্মাণের কাজে তিনি হাত দেন। তিনি চেয়েছিলেন তাঁর দেশের একজন মানুষও যাতে গৃহহীন না থাকে। তাই তিনি গৃহনির্মাণ, পুনর্বাসন ও পুনর্গঠনে মনোযোগ দেন।
মাত্র সাড়ে তিন বছরের মধ্যে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ও চিকিৎসাবিজ্ঞানের সব ক্ষেত্রে একটি শক্ত নীতিমালা, পরিকল্পনা, অবকাঠামো রেখে গেছেন। স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় এবং ১৯৭২ সাল মিলে পরপর তিনটি শস্য উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল এবং দেশে খাদ্যাভাব ছিল। ভারত ও অন্যান্য উন্নত দেশ থেকে বেশকিছু খাদ্য সাহায্য পাওয়া যায়। জাতিসংঘের মহাসচিবের ১০ লাখ টন সাহায্যের আহ্বানে, জাপান সরকারের অনুদান এবং কিছু বার্টার চুক্তির মাধ্যমে ও বিভিন্ন স্তওে রেশনিংয়ের মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ ও প্রত্যাগত নাগরিকদের খাদ্য বিলির ব্যবস্থা করা হয়। ১৯৭২ সালের আগস্টে বাংলাদেশ এ দুই সংস্থার সদস্যপদ লাভ করে এবং এ প্রসঙ্গে যে বৈদেশিক মুদ্রা ও স্বর্ণের প্রয়োজন ছিল, তা অনুদান হিসেবে দিয়েছিল কানাডা ও সুইডেন। তার আগে ভারত সরকার কিছু বৈদেশিক মুদ্রা ঋণ হিসেবে পৃথক করে রাখে।
পুনর্গঠন ও পুনর্র্নিমাণের কাজের বর্ণনা ছিল ১৯৭২-১৯৭৩ সালের বাজেটে। এ পুনর্গঠনে অনেক বন্ধুরাষ্ট্র বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাহায্য দিয়েছিলেন, যেগুলো পরিশোধ করার প্রয়োজন ছিল না। এসব সাহায্যকারী দেশের মধ্যে ছিল ভারত, (সোভিয়েত ইউনিয়ন) রাশিয়া, যুক্তরাজ্য, কানাডা, জাপান, জার্মানি, সুইডেন, ডেনমার্ক ও নেদারল্যান্ড। বঙ্গবন্ধুর লক্ষ্য ছিল, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন। এছাড়া ১৯৭২-৭৩ সালের বাজেটে গুরুত্ব দেয়া হয়েছিল পুনর্বাসনের পরই শিক্ষা খাতে। বাংলার দরিদ্র মানুষের জন্য দুঃখ বিমোচন এবং সবার জন্য যাতে অন্ন-বস্ত্র-শিক্ষা, সুস্বাস্থ্য ও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়, উন্নয়নের সঙ্গে একটি বৈষম্যহীন সমাজ গড়ে ওঠে এই ছিল বঙ্গবন্ধুর চিন্তা ও রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক কাঠামো গঠনের প্রচেষ্টা ও অবদানের লক্ষ্য।
বিজয়ের অর্ধশত বছর পর বাংলাদেশ বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে। ডিজিটাল বাংলাদেশের বীজ রোপণ করেছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি বাংলাদেশকে ইন্টারন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন ইউনিয়ন (আইটিইউর) সদস্যপদ গ্রহণ করান ১৯৭৩ সালে। ১৯৭৫ সালের ১৪ জুন তিনি রাঙামাটির বেতবুনিয়ায় ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্র উদ্বোধন করেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রোপিত বীজ থেকে জন্ম নেয়া চারাগাছটির বিকাশ দেখি ১৯৯৬ সালে জননেত্রী শেখ হাসিনা যখন প্রথমবারের মতো প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন তখন। তিনি স্পষ্টতই বলেছেন যে, ডিজিটাল বাংলাদেশ এর ধারণাটি পেয়েছেন তিনি তাঁর পুত্র এবং তার তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়ের কাছ থেকে।
অন্যান্য রাষ্ট্রের সঙ্গে বন্ধুত্বমূলক সম্পর্ক গড়ে তোলা, শান্তিতে সহাবস্থানের নীতিমালা ও মানুষের জন্য সংগ্রামের প্রমাণ দেখেই অন্যান্য রাষ্ট্র বাংলাদেশকে, বঙ্গবন্ধুকে, সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেয় স্বাধীন বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকেই। গণতন্ত্র ও মানবাধিকার, মালিকানার নীতি: রাষ্ট্রীয় মালিকানা, সমবায়ী মালিকানা ও ব্যক্তিগত মালিকানা, কৃষক ও শ্রমিকের মুক্তি, জনগণের মৌলিক প্রয়োজন মেটানোর ব্যবস্থা: অন্ন, বস্ত্র, আশ্রয়, শিক্ষা ও চিকিৎসাসহ জীবনধারণে মৌলিক উপকরণের ব্যবস্থা, কর্মের অধিকার, যুক্তিসংগত মজুরির বিনিময়ে কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তা। যুক্তিসংগত বিশ্রাম, বিনোদন ও অবকাশের অধিকার, সামাজিক নিরাপত্তার অধিকার, গ্রামীণ উন্নয়ন ও কৃষি বিপ্লব, অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষা, সমাজ ও অর্থনীতির প্রয়োজনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে শিক্ষা ব্যবস্থার কাঠামো নির্ধারণ এবং নিরক্ষরতা দূর করার জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ, জনস্বাস্থ্য ও পুষ্টিসমৃদ্ধ খাবার, সব নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা নিশ্চিতকরণ। মুক্তি বাহিনীর জওয়ানদের কাজে লাগানোর জন্য বঙ্গবন্ধু ব্যাপক পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। তিনি বাংলাদেশের পুলিশ বাহিনী, মিলিশিয়া, রিজার্ভ বাহিনী সংগঠনের বিষয়ে বিশেষ ব্যবস্থা নেন। মুক্তিযোদ্ধাদের রাষ্ট্রীয় মর্যাদা প্রদান, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা এবং পুনর্বাসনের ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। এ ছাড়া দেশ গড়ার বিভিন্ন কাজে যোগ্যতা অনুযায়ী নিয়োগ প্রদান করেন। এবং ধনী-গরিবের বৈষম্য ও ব্যবধান কমিয়ে এনে সামাজিক অর্থে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে জমি মালিকানার সিলিং পুনর্র্নিধারণ ছিল ঐতিহাসিক পদক্ষেপ। বঙ্গবন্ধু সরকার নগরভিত্তিক ও গ্রামীণ জীবনের মধ্যে বিদ্যমান বৈষম্য দূরীকরণের পদক্ষেপ হিসেবে প্রাথমিকভাবে ৫০০ ডাক্তারকে গ্রামে নিয়োগ করেন। তৃণমূল পর্যায়ে স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে থানা স্বাস্থ্য প্রকল্প গ্রহণ বিশ্বে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে আজও স্বীকৃত।
১৯৭৪ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু জাতীয় আশা-আকাক্সক্ষার সঙ্গে সংগতি রেখে বাংলাদেশকে শিল্প-সংস্কৃতি সমৃদ্ধ সৃজনশীল মানবিক বাংলাদেশ গঠন এবং বাঙালির হাজার বছরের কৃষ্টি-সংস্কৃতি-ঐতিহ্য ধরে রেখে আরো সমৃদ্ধ করার লক্ষ্যে বাংলাদেশি শিল্পকলা একাডেমি গঠন করেন। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি বাংলাদেশের শিল্প-সংস্কৃতি বিকাশের একমাত্র জাতীয় প্রতিষ্ঠান। ১৯৭৪ সালের ১৮ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণে দুর্নীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, দুর্নীতির বিরুদ্ধে কার্যকরী প্রতিরোধ গড়ে তুলতে না পারলে জাতির ভবিষ্যৎ অন্ধকারে ছেয়ে যাবে। দুর্নীতিবাজ, ঘুষখোর, চোরাচালানি, মজুদদারি, কালোবাজারি ও মুনাফাখোরদের সমাজ ও রাষ্ট্রের শত্রু বলে আখ্যায়িত করে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, এদের শায়েস্তা করে জাতীয় জীবনকে কলুষমুক্ত করতে না পারলে আওয়ামী লীগের দুই যুগের ত্যাগ-তিতিক্ষা এবং স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতৃত্বদানের গৌরবও ম্লান হয়ে যেতে পারে।
বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে কলঙ্কজনক ট্র্যাজেডি ছিল বাংলাদেশের স্থপতি ও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাকা-। বঙ্গবন্ধু সারা জীবন দেশবাসীর জন্য সংগ্রাম করেছেন এবং পাকিস্তানি অত্যাচারের সীমালঙ্ঘন ঘটিয়ে তাদের ঐক্যবদ্ধ করে স্বাধীনতার পথে নিয়ে গেছেন।
১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু ও তার সপরিবারে হত্যা বিশ্ব মানব সভ্যতার ইতিহাসে সবচেয়ে জঘন্য, বর্বর ও নৃশংস হত্যাকা-ের একটি। এটি শুধু হত্যা ছিল না। সদ্য স্বাধীন জাতির অগ্রযাত্রাকে চিরতরে স্তব্ধ করার ষড়যন্ত্রও ছিল। একজন প্রতিশ্রুতিশীল রাজনীতিবিদ যিনি তাঁর সমগ্র জীবন তার জাতির সেবায় উৎসর্গ করেছিলেন তাঁকে এত নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছিল যে আমাদের দেশের মানুষ এখনও কাঁদে। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর মুক্তিযুদ্ধের চার মূলনীতি ধর্মনিরপেক্ষতা, বাঙালি জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রকে বাদ দিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলকারীরা স্বাধীনতার চেতনা ও মূল্যবোধকে পদদলিত করে বাংলাদেশকে উল্টো পথে নিয়ে যায়।
জাতির অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য বঙ্গবন্ধু যে পদক্ষেপ নিয়েছিলেন তা বন্ধ হয়ে যায়। দেশে শুরু হয় সামরিক অভ্যুত্থান, পাল্টা অভ্যুত্থান, গুপ্তহত্যা ও ষড়যন্ত্রের রাজনীতি। একের পর এক সামরিক স্বৈরতন্ত্র পরিবর্তন হতে থাকে। একই সময়ে সামরিক স্বৈরশাসকদের ছত্রছায়ায় পরাজিত স্বাধীনতা বিরোধী দল, উগ্র সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী জঙ্গি গোষ্ঠীর উত্থান ঘটে দেশে।
তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হচ্ছে, বঙ্গবন্ধু তা জানতেন। কিন্তু দেশের মানুষ তাঁকে হত্যার ষড়যন্ত্র করছে, মনে হয় বঙ্গবন্ধু কল্পনাও করতে পারতেন না। জ্যামাইকায় কমনওয়েলথ সম্মেলনে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বঙ্গবন্ধু যেখানে বসে ছিলেন সেখানে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘শেখ সাহেব, আমাদের কাছে ভীতিকর খবর আছে। আপনার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র চলছে। উত্তরে বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘ম্যাডাম ইন্দিরা, চিন্তা করবেন না। কোন বাঙালি আমাকে স্পর্শ করবে না। যদি তারা করে, আমি গলায় চাদর জড়িয়ে গ্রামে ফিরে যাব। শেখ মুজিব ক্ষমতার অধিকারী নন।’
বিশ্লেষকরা মনে করেন, রাজনৈতিক হত্যাকা- এবং সামরিক অভ্যুত্থানের জন্য প্রয়োজন দীর্ঘ প্রস্তুতি, সতর্ক পরিকল্পনা এবং তা কার্যকর করা। কিছু সংখ্যক অভ্যন্তরীণ ব্যক্তির অংশগ্রহণ এবং বিদেশি শক্তির সমর্থন এই বিষয়গুলোকে সহজ করে তোলে। সে ক্ষেত্রে ভুক্তভোগী বা লক্ষ্য যদি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মতো কেউ হন, সেখানে কাজটি আরও চ্যালেঞ্জিং হতে পারে ঘাতকরা হয়তো এমনটিই ভেবেছে। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীরা সতর্কতার সাথে পরিকল্পনা করেছিল এবং পেশাগতভাবে সতর্ক হয়েই কাজটি করছিলো। দুর্ভাগ্যবশত, খুনিদের জন্য বিষয়গুলো বঙ্গবন্ধু নিজে কখনো বিশ্বাস করেননি, যে তাঁর বা তাঁর পরিবারের কোন ক্ষতি হতে পারে এ দেশের কোন মানুষের দ্বারা। বঙ্গবন্ধুর কিছু শুভাকাক্সক্ষী তাঁকে সতর্ক করার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু তিনি তাদের সতর্কবাণীগুলোকে পাশ কাটিয়ে বা এড়িয়ে গিয়ে বলেছিলেন, বাংলাদেশের মানুষ কখনোই তাঁর কোন ক্ষতি করবে না।
জীবনের জন্য হুমকি আছে তা জানা সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব কখনো বিষয়টির প্রতি মনোযোগ ও গুরুত্ব কোনটাই দেননি। বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংস্থা বারবার সতর্ক করা সত্ত্বেও তিনি কখনো কল্পনা করেননি, যে বাংলার মানুষ তাঁকে হত্যা করতে পারে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন যে, অসহিষ্ণু রাজনৈতিক পরিবেশ বঙ্গবন্ধুর হত্যার পথ প্রশস্ত করেছিলো। সদ্য স্বাধীন দেশে বিরোধী রাজনৈতিক শক্তির উত্থান, একাত্তরের পরাজিত বাহিনীর গোপন কর্মকা-, অন্যদিকে চরমপন্থী বাম দলের উত্থান, থানা আক্রমণ, ব্যাংক ডাকাতি, খুন ইত্যাদির কারণে মানুষ বিভ্রান্ত হয়ে পড়ছিলো। যন্ত্রকারীরা এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করে। খুনিরা তাদের লক্ষ্য পূরণ করে। সফল মিশন শেষে বাংলাদেশকে পেছনের দিকে নিয়ে যাওয়া শুরু হয়। ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সালের মধ্যে চরম বামপন্থী শক্তিগুলো বঙ্গবন্ধুর হত্যার জন্য পরিস্থিতি তৈরির জন্য অনেকাংশে দায়ী। সদ্য স্বাধীন দেশের ব্যবস্থাপনা নিয়ে একটি মতাদর্শিক দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। আওয়ামী লীগ নেতারা গণতন্ত্রকে তাদের প্রথম পছন্দ বলে মনে করতেন।
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার একবার বলেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে তার তিনজন শত্রু রয়েছে। একজন শেখ মুজিবুর রহমান এবং অন্য দুজন হলেন চিলির প্রেসিডেন্ট সালভাদর আলেন্দে এবং ভিয়েতনামের রাষ্ট্রনায়ক এনগুয়েন ভ্যান থু। তার রাজনৈতিক লক্ষ্য ছিল যেভাবেই হোক তাঁদের তিনজনকে উৎখাত করা। তিনজনের মধ্যে তিনি বঙ্গবন্ধুর প্রতি সবচেয়ে বেশি অসন্তুষ্ট ছিলেন, কারণ শেখ মুজিবের কারণে ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের ফলে পাকিস্তানের সাহায্যে চীন-মার্কিন সম্পর্ক গড়ে তোলার তার পরিকল্পনাকে মারাত্মকভাবে ব্যাহত করেছিল। শুধু তাই নয়, বঙ্গবন্ধুর সাথে সে সময় মার্কিন রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী ভারত ও রাশিয়ার ভালো সম্পর্ক ছি, যা মার্কিনদের জন্য নেতিবাচক ছিল। তাই তিনি যে কোন মূল্যে তিনি মুজিবকে উৎখাত করে বাংলাদেশে তাদের নিজের অনুকূল শাসন প্রতিষ্ঠা করার ইচ্ছা পোষণ করেন।
বঙ্গবন্ধুর নৃশংস হত্যাকা-ে বাংলাদেশের বেসামরিক প্রশাসনকেন্দ্রিক রাজনীতিতে প্রথম সরাসরি সামরিক বাহিনীর কিছু পথভ্রষ্ট মধ্যম ও নি¤œসারির অফিসার ও সামরিক বাহিনীর সদস্যদের হস্তক্ষেপ ছিল। তবে এর পরের ইতিহাস ভিন্ন। এই হত্যাকা-কে বাংলাদেশে একটি আদর্শিক মোড় হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বিশ্লেষকরা একমত যে এটি নিছক একটি হত্যাকা- নয়, এর পেছনে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ছিল। হত্যা মামলার রায়ে সংক্ষেপে রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের কথাও বলা হয়েছে। যাই হোক, নির্মম হত্যাকা-ের পিছনে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য এবং তৎকালীন রাজনীতিবিদদের সাথে জড়িত থাকার বিষয়টি বিচারের পরেও অস্পষ্ট ছিল।
বিশ্লেষকদের মতে, এটা মোটেও সহজ কাজ নয় যে, কিছু সংখ্যক সেনা সদস্য জাতির পিতাকে তাদের পরিবারসহ নিরস্ত্র মানুষদের ট্যাঙ্ক নিয়ে গিয়ে সপরিবারে হত্যা করবে পাশাপাশি রেডিও এবং টেলিভিশনে গিয়ে জাতির কাছে বঙ্গবন্ধু হত্যার খবর দেবে। বঙ্গবন্ধু ছিলেন একজন জাতীয়তাবাদী নেতা। জাতির স্বার্থে, দেশের স্বার্থে অনেক কিছু করেছেন, জীবনে বেশিরভাগ সময় জেলে কাটিয়েছেন। মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশ, যুক্তরাষ্ট্র, চীন এবং সৌদি আরব যুদ্ধে পাকিস্তানের পক্ষে ছিল। মূলত ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের পরাজয়ের সঙ্গে সঙ্গে সমর্থন প্রদানের কারণে তারাও পরাজিত হয়েছিল। অন্যদিকে, সারা বিশ্বে কোল্ড ওয়ার চলছিল। বিশ্ব রাজনীতি তখন অশান্ত। বঙ্গবন্ধু আঞ্চলিক রাজনীতিতে একটি বিশাল ফ্যাক্টর ছিলেন। স্বাভাবিকভাবেই বঙ্গবন্ধু ছিলেন এই কোল্ড ওয়ারের শিকার। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার ফলে উপমহাদেশের রাজনীতি দুর্বল হয়ে পড়ে।
গবেষকদের মতে, মুজিব হত্যার দু’টি মাত্রা রয়েছে। একটি অভ্যন্তরীণ রাজনীতি এবং অন্যটি আন্তর্জাতিক। বিচারে এর কোনোটাই আসেনি। দেশের প্রথাগত আইনে অন্যান্য দশটি হত্যার মতোই বঙ্গবন্ধুর হত্যার বিচার হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর নৃশংস হত্যার পটভূমি প্রসঙ্গে তেমন কিছু উঠে আসেনি। ঘাতকরা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে রাষ্ট্রের আত্মাকেই হত্যা করতে চেয়েছে। হত্যা করে জাতীয়তাবাদ, অসাম্প্র্রদায়িক, গণতান্ত্রিক, শোষণমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্নকে। সামরিক শাসনের মাধ্যমে রাষ্ট্রের চার নীতিকে অবমাননা করা হয়। বঙ্গবন্ধুর হত্যার বিচার হয়েছে। কিন্তু বিচারে ষড়যন্ত্রের কথা উঠে আসেনি।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নৃশংস হত্যাকা-ের পর, আওয়ামী লীগের জন্য একটি কঠিন সময় ছিল। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর তাঁর পরিবারের সদস্যদেরও হত্যা করা হয় যাতে কেউ আওয়ামী লীগের হাল ধরতে না পারে। বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে হত্যার জন্য, দলের চার জাতীয় নেতাকেও ৩রা নভেম্বর কারাগারে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। দলের নেতারা বিভিন্ন গ্রুপে বিভক্ত ছিলেন। প্রবীণ নেতাদের কেউ কেউ বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলেন। নেতৃত্বের অস্থিরতা ছিল। নেতৃত্বের কাপুরুষতা ছিল। কেউ কেউ বঙ্গবন্ধুর রক্তের সিঁড়ি বেয়ে খন্দকার মোশতাকের মন্ত্রিসভায় যোগ দেন। সারাদেশে দলের নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার করা হয় সেই সময়ে । চালানো হয় অমানবিক নির্যাতন। তাদের ঘরবাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়। অনেক নেতাকর্মীকে হত্যা করা হয়।
এ ধরনের মর্মান্তিক ঘটনা রোধের আহবান জানাতে পারেননি তারপরেও দলের তৃণমূল নেতারা হাল ছাড়েননি। তারা চেয়েছিল কেউ একজন প্রতিরোধে এগিয়ে আসুক। কিন্তু সেই আহবান জানানোর জন্য কেউ ছিলেন না। ফলে কঠিন হয়েছিলো আওয়ামী লীগের রাজনীতি। বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা বিদেশে অনেক কষ্টে জীবন-যাপন করেছেন।
বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিশোধের আগুন ছিলো আওয়ামী লীগের হৃদয়ে। সাংগঠনিক কার্যক্রম ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে। আওয়ামী লীগের তৎকালীন কাউন্সিলকে ঘিরে সারাদেশে নেতাকর্মীরা চাঙ্গা ও সংগঠিত হয়েছিল। অধিবেশনে অবিলম্বে সামরিক আইন প্রত্যাহার এবং সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে জনপ্রতিনিধিদের ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবি জানানো হয়। তারা কারাগারে থাকা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের মুক্তি এবং ১৫ আগস্ট হত্যাকা- ও জেলহত্যার বিচার দাবি করেন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং তাঁর পরিবারকে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট রাতে হত্যা করা হয়, তখন বঙ্গবন্ধু স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি ছিলেন। ১৫ আগস্ট শুধু বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি বড় দুর্যোগ নয়, এটি বিশ্বের ইতিহাসের একটি কলঙ্কজনক অধ্যায়। স্বাধীনতার মহান স্থপতি বঙ্গবন্ধু এবং তার স্ত্রী ও সন্তানদের দেশ স্বাধীন হওয়ার মাত্র সাড়ে তিন বছর পর হত্যা করা হয়, যা পৃথিবীর ইতিহাসে কোন নজির নেই।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারকে হত্যার পর সারা বিশ্বে তীব্র শোকের ছায়া নেমে আসে এবং বিদ্বেষের বিষ ছড়িয়ে পড়ে। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর বাংলাদেশের মানুষ বিশ্বজুড়ে মানুষ হিসেবে তাদের বিশ্বাসযোগ্যতা ও বিশ^স্ততা হারায়। বিদেশীরা মনে করতো যে বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে হত্যা করতে পারে তারা যে কোনো জঘন্য কাজ করতে পারে।
১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মাধ্যমে, সাহসী বাঙালিরা নিজেদের একটি কাপুরুষ-আত্মঘাতী জাতি হিসেবে এবং বিশ্বাসঘাতক হিসেবে বিশ্বের কাছে পরিচয় করিয়ে দেয়। বাঙালি জাতির স্বপ্নদ্রষ্টা শেখ মুজিবকে হত্যার মাধ্যমে বাঙালি জাতি তার আত্মঘাতী চরিত্র বিশ্ববাসীকে দেখিয়েছে। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে স্বাধীনতার চেতনাকে নির্বাসন দেওয়া হয়েছিলো। মানুষ মনে করেছে বঙ্গবন্ধু ছাড়া বাংলাদেশের প্রকৃত অস্তিত্ব নেই। এটা সহজেই বলা যেতে পারে যে, বাঙালি জাতির চেতনার নাম, একটি স্বপ্নের নাম, সৃষ্টির ইতিহাসের নাম, আকাক্সক্ষার নাম, সংগ্রামের নাম এবং সাফল্যের নাম – তাহলে তার মূর্ত প্রতীক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি ইতিহাসের মহানায়ক। বঙ্গবন্ধু চিরকাল বাঙালির হৃদয়ে অমর হয়ে আছেন থাকবেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার ষড়যন্ত্রের পেছনের অপরাধীরা একদিন প্রকাশ পাবে। তিনি ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করেছেন।
বঙ্গবন্ধু আজ আমাদের মধ্যে নেই। যদি বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকতেন তাহলে আজ শতবর্ষী হতেন তিনি। জনতার নেতা মুজিব না থাকলেও তাঁর আদর্শ ও অনুপ্রেরণা আজও বাঙালির মননে গেঁথে আছে। শ্রদ্ধায়, ভালোবাসায়, কৃতজ্ঞচিত্তে আজ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্মরণ করে বাঙালি। কিন্তু তাঁর আদর্শ আমাদের চিরন্তন প্রেরণার উৎস। তাঁর নীতি ও আদর্শ প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে ছড়িয়ে পড়ছে, গড়ে উঠছে সাহসী, ত্যাগী ও আদর্শবাদী নেতৃত্ব যাঁরা জাতির পিতার অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করার প্রত্যয়ে অঙ্গীকারবদ্ধ। রূপকল্প ২০২১, ২০৩০ সালের মধ্যে এসডিজি অর্জন, ২০৪১ সমৃদ্ধ দেশে পরিণত করা এবং ডেল্টা প্ল্যান-২১০০ বাস্তবায়নের মাধ্যমে জাতির পিতার স্বপ্নের ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত ও সুখী-সমৃদ্ধ সোনার বাংলা গড়ে তুলতে নিরলসভাবে কাজ করছে তাঁরই সুযোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে।
লেখক : প্রাবন্ধিক, গবেষক ও কলামিস্ট