হীরেন পণ্ডিত: মার্কিন নির্বাচনকে সামনে রেখে বিকৃত ও অপতথ্য ছড়ানোর পাশাপাশি ব্যঙ্গাত্মক কন্টেন্ট ছড়ানোর এক মহোৎসব চলেছিলো পুরো যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তি ব্যবহার করে এই সব কন্টেন্ট ছড়ানো হয় মর্মে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থার পক্ষ থেকে বারবার সতর্ক করা হয়। এই বিষয়টি নিয়ে সতর্ক থাকার তাগিদ দেয়া হয়েছে বার বার। যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তি নিয়ে সতর্কতা জারি করা হয়।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এক্সে একটি ভিডিও বার্তায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তানির্ভর সাংবাদিকতায় অনেক বেশি সাবধানী হওয়ার তাগিদ দিয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র নীতি ও জাতীয় নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ ডক্টর হেথার আসবি।
মার্কিন নির্বাচনে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তি ব্যবহার করে ভুল তথ্য ছড়ানো নিয়ে কূটনৈতিক সাংবাদিকদের আরও সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়ে আসবি বলেছিলেন, বিষয়টি সাংবাদিকতার নতুন চ্যালেঞ্জ এবং প্রচলিত গণমাধ্যমগুলোকে আরও সতর্ক হতে হবে। পররাষ্ট্রনীতি ও নির্বাচনী সংবাদ পরিবেশনের ক্ষেত্রে প্রযুক্তি এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে হেথার আসবি তুলে ধরেন যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে ভুয়া ও বিকৃত তথ্যের অতি ব্যবহারের বিষয়টি।
যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনকে ঘিরে ভুয়া ভিডিও নিয়ে এফবিআইয়ের সতর্কতা জারি করা হয়। যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ঠিক আগে হঠাৎ করে অনলাইনে ছড়িয়ে পড়া দু’টি ভুয়া ভিডিও সম্পর্কে সতর্ক করেছিলো দেশটির ফেডারেল ব্যুরো অফ ইনভেস্টিগেশন বা এফবিআই।
সংস্থাটি উল্লেখ করে, ওই ভিডিওগুলোর লক্ষ্য ছিলো যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন নিয়ে সন্দেহ তৈরি করা। সংস্থাটির শীর্ষ কর্মকর্তারা এর আগেও এ বিষয়ে অনেকবার সতর্ক করেছেন এ বিষয়ে। বিবিসি ভেরিফাই প্রমাণ পেয়েছিলো, কয়েক মাস আগে থেকেই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এমন শত শত ভুয়া ভিডিও তৈরি হয়েছে, যার উৎস রাশিয়া বলে ধারণা করা হয়। প্রসঙ্গত, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন এলেই রাশিয়ার ‘হস্তক্ষেপ’ কিংবা এ ধরণের অভিযোগ ব্যাপকভাবে আলোচনায় আসে। বিশেষ করে, ২০১৬ সালের এবং ২০২০ সালের নির্বাচনে এ ধরনের তথ্য বেশি আলোচনায় এসেছিলো।
এবারেও নির্বাচনকে সামনে রেখেও ‘রুশ তৎপরতা’র কথা বলছে যুক্তরাষ্ট্রের সংস্থাগুলো। ৫ নভেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের টেভাটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। দেশটির সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং বর্তমান ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস এ নির্বাচনে প্রতিদ্ব›িদ্বতা করেন এবং ট্রম্প বিপুল ভেটে জয়লাভ করেন।।
সামাজিক মাধ্যম ‘এক্স’-এ এফবিআই জানায়, দু’টি ভিডিও- ব্যালট প্রতারণা এবং ডেমোক্র্যাট দলীয় প্রাার্থী কমলা হ্যারিসের স্বামী ডাগ এমহফকে নিয়ে নিয়ে গুজব ছড়াচ্ছে। ভুয়া ওই দু’টি ভিডিও দেখে মনে হবে এগুলো এফবিআই বানিয়েছে। ভিডিওর সাথে সংস্থাটির লোগো জুড়ে দেয়া হয়েছে। তবে এটি এক্স এ বেশী মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেনি বা খুব বেশী মানুষ এটি দেখেনি। এসব ভিডিও অথেনটিক নয়, এফবিআই এগুলো করেনি এবং এগুলোতে মিথ্যা বলা হয়েছে, এফবিআই এক বিবৃতিতে জানায়।
এফবিআই কার্যক্রম নিয়ে ভুয়া কনটেন্ট তৈরি করে মানুষের সাথে প্রতারণার চেষ্টা হলো গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে হেয় করার মাধ্যমে নির্বাচনী প্রক্রিয়া সম্পর্কে অবিশ্বাস তৈরি করা,” বিবৃতিতে বলা হয়েছে। এফবিআই যেভাবে ভিডিওগুলোর কনটেন্টের বর্ণনা দিয়েছে, তার সাথে এর আগে বছরের শুরুতে বিবিসি ভেরিফাই যে তিনশর মতো ভিডিও পেয়েছিলো তার মিল ছিলো।
একটি অনলাইন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের অনুসন্ধানের অংশ হিসেবে তখন এসব ভিডিও পাওয়া গিয়েছিলো। ভিডিওতে বিশ্বাসযোগ্য করে প্রাফিক্স উপস্থাপন করা হয়েছে। এয়াড়া টেক্সটগুলো দেখে মনে হবে, এগুলো যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি সংস্থার পাশাপাশি বিবিসি, ফ্রান্স ২৪ ও ফক্স নিউজসহ অন্তত পঞ্চাশটি সংবাদ মাধ্যম থেকে নেয়া।
২০১৬ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময় রাশানরা হ্যাকিং-এর চেষ্টা চালিয়েছিল বলে জানিয়েছিলো একজন মার্কিন কর্মকর্তা। গত কয়েক মাস ধরে প্রায় প্রতিদিনই অনলাইনে ভিডিও পোস্ট করা হচ্ছে এবং সাম্প্রতিক সময়ে এটা করা হয় যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনকে জোর দিয়ে। এতে মিস হ্যারিস সম্পর্কে মিথ্যা দাবি ও বিশৃঙ্খলা এবং ‘গৃহযুদ্ধ’ সম্পর্কে বার্তা দেয়া হচ্ছে। চেকফার্স্ট, ফিনল্যান্ড ভিত্তিক একটি অনলাইন অ্যানালিটিকাল কোম্পানি ওই ভিডিওগুলোর নেটওয়ার্ক সম্পর্কে স্বাধীনভাবে অনুসন্ধান করেছে। তারা দেখেছে যে এর পেছনে আছে একটি রুশ মার্কেটিং এজেন্সি ও একটি রুশ আইপি এড্রেস।
“আমরা এর সাথে রাশিয়ার যোগসূত্র করতে পারি এবং কিছু বিষয় থেকে আমরা জানতে পারি যে এগুলো তৈরি করেছে রুশ একটি কোম্পানি,” বলছিলেন চেকফার্স্টের প্রধান নির্বাহী গুইলাউমে কুস্টার।
“প্রমাণের আরেকটি সূত্র হলো ডেটা সেট। সেখানে প্রবেশ করে আমরা প্রমাণ পাই যে যেখান থেকে ইমেইল পাঠানো হয়েছে সেটিও রাশিয়ায়”।
চ্যাটজিপিটি দিয়ে মার্কিন নির্বাচনে প্রভাব ফেলতে চেয়েছিলোছ ইরান।
সেইসব অ্যাকাউন্টের সঙ্গে ‘স্টর্ম ২০৩৫’ নামের এক গোপন ইরানি অভিযানের যোগসূত্র পেয়েছে ওপেনএআই। সম্প্রতি ইরানের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকা বেশ কিছু চ্যাটজিপিটি অ্যাকাউন্ট নিষিদ্ধ করেছে ওপেনএআই, যেখানে অন্যান্য বিষয়াদির পাশাপাশি মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ভুয়া কনটেন্ট বানিয়ে সেগুলো ছড়িয়ে দেওয়া হতো।
ওপেনএআইয়ের দাবি, এ কাজের মূল লক্ষ্য, চ্যাটজিপিটি ব্যবহার করে দীর্ঘ নিবন্ধের পাশাপাশি এক্স ও ইনস্টাগ্রামের মতো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভুয়া মন্তব্য তৈরি করা। সেইসব অ্যাকাউন্টের সঙ্গে ‘স্টর্ম ২০৩৫’ নামের এক গোপন ইরানি সংগঠনের যোগসূত্র পেয়েছে ওপেনএআই, যা রাজনৈতিক সংবাদ প্রকাশকের ছদ্মবেশে ওয়েবসাইট চালু করে মার্কিন ভোটারদের প্রভাবিত করার চেষ্টা করেছে। রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নিলে, এ অপারেশনে মার্কিন নির্বাচনের উভয় পক্ষ নিয়ে ভাষ্য দেওয়ার পাশাপাশি ইসরাইল-হামাস যুদ্ধ, অলিম্পিক গেইমসে ইসরাইল, ভেনেজুয়েলায় রাজনীতি ও যুক্তরাষ্ট্রে ‘লাতিন সম্প্রদায়ের অধিকার’ নিয়েও কনটেন্ট তৈরি হয়েছে।
ওপেনএআই বলছে, তাদের তদন্তে উঠে এসেছে, এ প্রচারণায় ‘তেমন দর্শক সম্পৃক্ততা দেখা যায়নি’। এধাই কোম্পানিটি আরও যোগ করে, তাদের ট্র্যাক করা বেশিরভাগ পোস্টে ‘লাইক, শেয়ার বা কমেন্ট’ নেই বললেই চলে। মে মাসে ওপেনএআই ও মেটা ঘোষণা দিয়েছিল, তারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি প্রচারণা রুখে দিয়েছে, যেখানে এআই ব্যবহার করে ইনস্টাগ্রাম ও ফেইসবুকে বিভিন্ন ইসরায়েলপন্থী বার্তা পোস্ট হতো।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন শুরু হতে আর কয়েক মাস বাকি থাকলেও এমন হস্তক্ষেপ করার ঘটনা বেড়ে যেতে পারে বলে প্রতিবেদনে লিখেছে প্রযুক্তি সাইট এনগ্যাজেট। নির্বাচনের আগের সপ্তাহে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডেনাল্ড ট্রাম্প নিশ্চিত করেন, তার নির্বাচনী প্রচারণা সাইবার আক্রমণের শিকার ও ইরানের এক হ্যাকার দলের পাঠানো ‘ফিশিং’ ইমেইলের সঙ্গে এর যোগসূত্র আছে।
জুন মাসে ট্রাম্পের পাশাপাশি বাইডেন-হ্যারিসের প্রচারণায় সাইবার হামলা চালানোর অভিযোগে তদন্ত করে শুরু করেছে এফবিআই। এর সাথে ভিডিও তৈরি করা হয়েছিলো সেগুলো ব্যাপকভাবে ছড়ানো হয়েছিলো রাশিয়ান ভাষার টেলিগ্রাম চ্যানেলে।
চেকফার্স্ট যে স্টাইল, বার্তা ও থিম ভিডিওর সাথে পেয়েছে সেটি ক্রেমলিনের সাথে যোগসূত্র আছে এমন আরেকটি কার্যক্রমের সাথে মেলে বলে বিবিসি ভেরিফাই গবেষণা সমর্থিত একটি ধারণা। তবে এটা এখনো পরিষ্কার নয় যে কারা ওই কার্যক্রম পরিচালনা করছে এবং এটি রাশিয়ার সরকারের আর্থিক সহায়তায় পরিচালিত কি-না।
ওয়াশিংটনে রাশিয়ার দূতাবাস এক বিবৃতিতে জানিয়েছিলো নির্বাচনে হস্তক্ষেপের যে অভিযোগ তার দেশের বিরুদ্ধে সেটি ‘ভিত্তিহীন’। রাশিয়ার কৌশলের দিকে যত ইঙ্গিত দেয়া হচ্ছে তা একটি অপবাদ, যা যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির লড়াইয়ে ব্যবহারের জন্য তৈরি।
এক্স-এর হিসেব অনুযায়ী ওই ভিডিও ক্লিপ দেখা হয়ে লাখ লাখ বার। তবে যারা পোস্ট করেছে তাদের অনুসারী কম এবং অল্প মানুষই তাতে কমেন্ট করেছে। কিছু ‘বট’ অ্যাকাউন্ট থেকেও এটি দেখা হচ্ছে বলে বোঝা যায়।
এফবিআই এ বিষয়ে মন্তব্য করতে রাজি হয়নি। তবে এর বাইরেও তারা সাম্প্রতিক রাশিয়ার সাথে যোগসূত্র আছে এমন প্রভাবশালী নেটওয়ার্ক সম্পর্কে সতর্কতা জারি করেছে। শুক্রবার যুক্তরাষ্ট্রের তিনটি সংস্থা এফবিআই, অফিস অফ দ্য ডিরেক্টর অফ ন্যাশনাল ইনটিলিজেন্স এবং দ্য সাইবার সিকিউরিটি অ্যান্ড ইনফ্রাস্ট্রাকচার সিকিউরিটি এজেন্সি একটি ভাইরাল ভিডিও মন্তব্য করে বলেছে এতে হাইতি থেকে আসা একজন ভোট দিয়েছে এমন একটি মিথ্যা বর্ণনা দেয়া হয়েছে এবং এটি ‘রাশিয়া প্রভাবিত লোকজন’ তৈরি করেছে।
নির্বাচনের আগের সপ্তাহে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো জানায় একটি ভিডিও দেখানো হয়েছে যে নির্বাচনী কর্মী মেইলে আসা ব্যালট ধ্বংস করছে যেগুলোতে পেনসিলভানিয়ায় ডোনাল্ড ট্রাম্পকে ভোট দেয়া হয়েছে বলে বোঝানো হয়েছে। সংস্থাগুলো বলছে এগুলো রাশিয়ানদের তৈরি ও প্রচার করা।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ভোট চলাকালীন রাশিয়ার বিষয়ে সতর্ক করেছে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা। ইউএস ইন্টেলিজেন্স কমিউনিটি (আইসি) জানিয়েছে, এবারের নির্বাচনে জনগণের আস্থা কমাতে ‘সবচেয়ে সক্রিয় হুমকি’ হয়ে দাঁড়াতে পারে রাশিয়ার বিভ্রান্তিকর তথ্য। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ইন্টেলিজেন্স, দ্য ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন, দ্য সাইবার সিকিউরিটি অ্যান্ড ইনফ্রাস্ট্রাকচার সিকিউরিটি এজেন্সি নির্বাচনের আগে এক যৌথ বিবৃতিতে এ তথ্য জানায়। তারা জানায় মার্কিন গোয়েন্দারা ভোটের ক্ষেত্রে বিদেশি শক্তিগুলোর উপর কড়া নজর রাখছে। বিশেষ করে রাশিয়ার কর্মকাÐের উপর বেশ তৎপর রয়েছে মার্কিন গোয়েন্দারা।
এতে বলা হয়, মার্কিন ইন্টেলিজেন্স কমিউনিটির বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে জানায়, নির্বাচনের দিন এবং এরপরেও আরও এক সপ্তাহ পর্যন্ত তৎপরতা চালানোর চেষ্টা করতে পারে রাশিয়া। বিশেষ সুইং স্টেটগুলোতে তারা প্রভাব বিস্তার করতে পারে।
বিবৃতিতে বলা হয়, মার্কিন নির্বাচনের জন্য সবচেয়ে সক্রিয় হুমকি হচ্ছে রাশিয়া। বিশেষ করে মস্কোর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ইনফ্লুয়েন্স অভিনেতারা ভিডিও তৈরি করছে এবং নির্বাচনের বৈধতা ক্ষুণœ করার জন্য ফাঁদ তৈরির চেষ্টা করছে। এর মাধ্যমে তারা নির্বাচন প্রক্রিয়া সম্পর্কে ভোটারদের মধ্যে ভীতি জাগিয়ে তুলছে এবং পরামর্শ দিচ্ছে যে আমেরিকানরা রাজনৈতিকভাবে একে অপরের বিরুদ্ধে সহিংসতা ব্যবহার করছে। বিভিন্ন তথ্যের ভিত্তিতে এমনটাই মনে করছে মার্কিন গোয়েন্দারা।
নির্বাচনের চূড়ান্ত লড়াই শুরুর মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে এমন তথ্য দিল মার্কিন গোয়েন্দারা। গত সপ্তাহে অনলাইনে প্রচারিত ভিডিওগুলোতে ভোট জালিয়াতির মিথ্যা তথ্য চিত্রিত করার চেষ্টা করা হয়েছে বলে অভিযোগ মার্কিন গোয়েন্দাদের। একটি ভিডিওতে হাইতিয়ান এক অভিবাসীকে দেখানো হয়। সেখানে বলা হয়েছে ওই অভিবাসী জর্জিয়া অঙ্গরাজ্যে ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিসকে একাধিক ভোট দেওয়ার পরিকল্পনা করেছেন। তবে মার্কিন গোয়েন্দারা জানান এসব তথ্য ভুয়া। আরেকটি ভিডিওতে কমলা হ্যারিস এবং তার স্বামীর বিরুদ্ধে নারী পাচারের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, তারা উভয়ই এসব কাজের জন্য একজনের কাছ থেকে ৫ লাখ ডলার ঘুষ নিয়েছেন। এ তথ্যটিকেও বিভ্রান্তিকর এবং ভুয়া বলে জানিয়েছে মার্কিন গোয়েন্দারা।
মার্কিন গোয়েন্দাদের দাবি এমন ভুয়া প্রতিটি ভিডিওর পেছনে কাজ করেছে রাশিয়ার ইনফ্লুয়েন্স অভিনেতারা। আর এর পেছনে মস্কোর ইন্ধন রয়েছে বলেও অভিযোগ করেছে ইউএস ইন্টেলিজেন্স কমিউনিটি।
মার্কিন নির্বাচন নিয়ে এক্স-এ ভুয়া তথ্য ছড়িয়েছেন ইলন মাস্ক। যুক্তরাষ্ট্রের এবারের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে মিথ্যা বা বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়িয়েছেন মার্কিন প্রযুক্তি উদ্যোক্তা ইলন মাস্ক। তার করা পোস্টগুলো অন্তত ২ বিলিয়ন তথা ২০০ কোটি ভিউ হয়েছে। অলাভজনক প্রতিষ্ঠান ‘সেন্টার ফর কাউন্টারিং ডিজিটাল হেট’র এক প্রতিবেদনে এমনটাই জানানো হয়েছে।
মার্কিন প্রযুক্তি উদ্যোক্তা ও বিলিয়নিয়ার ব্যবসায়ী ইলন মাস্ক ভুল তথ্য ছড়িয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এবারের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন সামনে রেখে যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি কর্মকর্তা ও ভোটাধিকার নিয়ে কাজ করা কর্মীরা আগেই ভুল তথ্য প্রকাশের ব্যাপারে সতর্ক করেন। সেই সঙ্গে এক্সসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোর কর্তৃপক্ষকে নির্বাচন নিয়ে যেকোনো ধরনের ভুল তথ্য সরিয়ে ফেলতে পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন।
এরপরও অনেক ভুয়া তথ্য ছড়িয়েছে বলে অভিযোগ। এমনকি অভিযোগ উঠল খোদ এক্স-এর মালিক ইলন মাস্কের বিরুদ্ধেও। নির্বাচনের মাত্র একদিন আগে সোমবার (৪ নভেম্বর) একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে ‘সেন্টার ফর কাউন্টারিং ডিজিটাল হেট’। ইলন মাস্ক আজ ৫ নভেম্বরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্পকে সমর্থন দিয়েছেন।
প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রেসিডেন্ট নির্বাচন নিয়ে নিজ মালিকানাধীন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্স-এ মিথ্যা বা বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়িয়েছেন ইলন মাস্ক। প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে, চলতি বছর মাস্কের অন্তত ৮৭টি পোস্ট মিথ্যা বা বিভ্রান্তিমূলক হিসেবে চিহ্নিত করেছেন ফ্যাক্ট চেকাররা।
প্রতিবেদনে মাস্কেও যেসব পোস্টকে মিথ্যা বা বিভ্রান্তিকর বলে চিহ্নিত করা হয়েছে, সেগুলো মূলত ‘ভোটার আমদানি’ করা। যেমন প্রতিদ্ব›িদ্বতাপূর্ণ রাজ্যগুলোয় গত চার বছরে অনিবন্ধিত অভিবাসীর সংখ্যা ‘তিন অঙ্কের’ কোটায় বেড়ে যাওয়া, ‘ভোটপ্রক্রিয়ার সুসংহত’ অবস্থা নিয়ে প্রশ্ন তোলা প্রভৃতি বিষয় সংশ্লিষ্ট।
এর আগে গত সপ্তাহে একই প্রতিষ্ঠান বলেছে, নির্বাচন নিয়ে মিথ্যা দাবি চ্যালেঞ্জ জানাতে এক্সেও যে ফ্যাক্ট চেকিং বৈশিষ্ট্য রয়েছে, সেটি কাজ করছে না।
অধ্যাপক ক্যাথলিন কার্লি বলেছেন, এক্স-প্ল্যাটফর্মে মাস্কের প্রায় ২০ কোটির ওপর অনুসারী আছেন। ফলে তার যেকোনো পোস্ট নেটওয়ার্ক ইফেক্টের’ কারণে রেডিট বা টেলিগ্রামের মতো অন্যান্য প্ল্যাটফর্ম ব্যবহারকারীদের কাছেও পৌঁছে যায়। অর্থাৎ ভিন্ন ভিন্ন প্ল্যাটফর্মের মধ্যে সংযোগ মাধ্যম হিসেবে কাজ করছে এক্স।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে অনলাইনে মিথ্যা তথ্য শনাক্তকারী প্রতিষ্ঠান সিয়াব্রা জানিয়েছে, ১ লাখ ১৭ হাজার অনুসারী আছে এমন একটি এক্স অ্যাকাউন্ট থেকে ভুয়া একটি ভিডিও প্রচার করা হয়। ওই ভিডিওতে দেখানো হয়, পেনসিলভিনিয়াতে ট্রাম্পের পক্ষের মেইল-ইন ব্যালট ধ্বংস করা হচ্ছে।
নির্বাচনি অধিকার নিয়ে কাজ করা নির্দলীয় প্রতিষ্ঠান ‘কমন কজ’-এর নির্বাহী পরিচালক ফিলিপ হেন্সলি রবিন বলেছেন, অনেক এক্স ব্যবহারকারী ভোট জালিয়াতির গুজব ছড়িয়েছেন। কিন্তু দেশজুড়ে নির্বাচনি কর্তৃপক্ষ ও কর্মকর্তারা আইন মেনে নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করেছেন, যেন কেবল বৈধ ভোটাররাই অংশ নিতে পারেন।
ভোট দেওয়া ও গণনা
যুক্তরাষ্ট্রে ভোট দেওয়া বাধ্যতামূলক নয়। মেইল বা ডাকযোগে ভোট দেওয়া গেলেও দেশটিতে অনলাইনে ভোট দেওয়ার কোনো ব্যবস্থা নেই। আমাদের দেশের মতোই দেশটির বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যের প্রত্যেক ভোটারের জন্য নির্দিষ্ট ভোটকেন্দ্র বরাদ্দ করা হয়। এসব কেন্দ্র সাধারণত সরকারি ভবন, যেমন কনভেনশন সেন্টার, লাইব্রেরি, স্কুল বা কমিউনিটি সেন্টারে স্থাপন করা হয়ে থাকে। ভোটাররা এসব কেন্দ্রে গোপন বুথে গিয়ে ব্যালট পূরণ করেন।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও বেশির ভাগ ভোটারই ‘হাতে পূরণ করা যায়’ এমন কাগজের ব্যালট ব্যবহার করেন। সাধারণত, ভোটাররা প্রার্থীর নামের পাশে থাকা গোল বা বর্গ চিহ্ন পূরণ করেন। ফিলাডেলফিয়ার বেসরকারি সংস্থা ‘ভেরিফায়েড ভোটিং’ এর তথ্য অনুসারে, প্রায় ৭০ শতাংশ নিবন্ধিত ভোটার এমন অঞ্চলে বসবাস করেন যেখানে হাতে চিহ্নিত কাগজের ব্যালট ব্যবহার করা হয়।
কাগজের ব্যালটের পাশাপাশি কিছু ভোটার ডিজিটাল ডিভাইস দিয়েও ভোট দেন। কিছু এলাকায় ভোটারদের জন্য ডিজিটাল ডিভাইসে ভোট দেওয়ার ব্যবস্থা আছে। এই ডিভাইসকে বলা হয় ব্যালট মার্কিং ডিভাইস বা বিএমডি। ভোটাররা এতে ভোট দেওয়ার পর সেটি থেকে একটি কাগজে প্রিন্ট বের হয়। যা পরে ব্যালট বাক্সে ফেলা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের ২৫ শতাংশ ভোটার এ ধরনের ব্যবস্থায় ভোট দেন।
যুক্তরাষ্ট্রের কাউন্সিল অব স্টেট গভর্নমেন্টস ওয়েবসাইটের তথ্য অনুসারে, নির্বাচনে ভোটগ্রহণের আরেকটি ব্যবস্থা হলো রেকর্ডিং ইলেকট্রনিক ভোটিং সিস্টেম। ২০২০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ইন্ডিয়ানা, কানসাস, কেনটাকি, লুইসিয়ানা, মিসিসিপি, টেনেসি এবং টেক্সাসে ভোটাররা সরাসরি রেকর্ডিং ইলেকট্রনিক ভোটিং সিস্টেম ব্যবহার কওে ভোট দিয়েছেন। এই সিস্টেমে ভোটাররা বোতাম চাপেন বা টাচস্ক্রিন ব্যবহার করেন। তাদের ভোট সরাসরি কম্পিউটার সিস্টেমে রেকর্ড হয়।
কিছু রেকর্ডিং ইলেকট্রনিক ভোটিং সিস্টেম একটি প্রিন্টারের সঙ্গে যুক্ত থাকে। যেখানে ভোটার ভোট দেওয়ার পর তাঁর ভোট ঠিক আছে কি না তা যাচাই করতে পারেন। এটি প্রতিটি ভোটের একটি কাগুজে রেকর্ড তৈরি করে। রেকর্ড একবার তৈরি হয়ে যাওয়ার পর তা আর বদলানোর সুযোগ থাকে না। যুক্তরাষ্ট্রের ৫ শতাংশ ভোটার রেকর্ডিং ইলেকট্রনিক ভোটিং সিস্টেম ব্যবহার করে ভোট দেন।
এদিকে, ভোট দেওয়ার সময় পরিচয়পত্র দেখানোর বিষয়টিও যুক্তরাষ্ট্রের অঙ্গরাজ্যভেদে ভিন্ন। যেমন, ৩৫টি রাজ্যে ভোটারদের বৈধ আইডি দেখাতে হয়। এর মধ্যে ২৫টি রাজ্যে ছবিযুক্ত আইডি দেখানো বাধ্যতামূলক। তবে, সাধারণত ড্রাইভিং লাইসেন্স বা পাসপোর্টও গ্রহণযোগ্য।
আবার, ১৫টি রাজ্যে ভোট দেওয়ার সময় কোনো আইডি দেখানোর প্রয়োজন নেই। উদাহরণস্বরূপ, নেভাদায় ভোটারদের আইডি আনতে হয় না। ভোটকেন্দ্রে গিয়ে শুধু নাম সই করতে হয়। তারপর সেই সই ভোটার রেজিস্ট্রেশনের সময় দেওয়া সই ও আইডির সঙ্গে মেলানো হয়। তবে কিছু রাজ্যে, যেখানে সাধারণত আইডি লাগে না। প্রথমবার ভোট দেওয়ার সময় বা রেজিস্ট্রেশনের সময় আইডি না দিলে, ভোটারদের আইডি দেখাতে হতে পারে।
ভোট গণনা হয় যেভাবে
আগেই বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাচন ব্যবস্থা কেন্দ্রীয়ভাবে পরিচালনা করা হয় না। ভোটগ্রহণের সঙ্গে যেমন ফেডারেল নির্বাচন কমিশনের সরাসরি কোনো সম্পর্ক নেই, তেমনি ভোট গণনার সঙ্গেও নেই।
হাতে পূরণ করা যায় এমন কাগজের ব্যালট এবং ব্যালট মার্কিং ডিভাইস দিয়ে দেওয়া ব্যালট সাধারণত অপটিক্যাল স্ক্যানার দিয়ে গণনা করা হয়। এরপর ডিজিটালভাবে চূড়ান্ত ফলাফল তৈরি করা হয়। ভোট পুনর্গণনা এবং ফলাফল যাচাইয়ের পদ্ধতি রাজ্যভেদে ভিন্ন হয়। রাজ্যগুলোকে ১১ ডিসেম্বরের মধ্যে তাদের নির্বাচনের ফলাফল নিশ্চিত করতে হয়। তবে, সাধারণত ভোটগ্রহণের কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ফলাফল প্রকাশিত হয়।
হীরেন পণ্ডিত: প্রাবন্ধিক ও গবেষক